মানুষ অজানাকে জানতে ও অদেখাকে দেখতে চায়। নতুন নতুন জিনিস, স্থান ইত্যাদির সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের মাঝে বিরাজ করছে। তবে নগরায়নের ফলে মানুষ দিনদিন সীমাবদ্ধতার মাঝে পড়ে গেছে। দালান-কোঠার মাঝে কর্মসূত্রে আবদ্ধ মানুষের মাঝে ক্লান্তি চলে আসাটা অতি স্বাভাবিক বিষয়। এজন্যই সীমাবদ্ধ পরিসর থেকে মানুষের আত্মিক ও মানষিক প্রশান্তির জন্য মাঝে মাঝে প্রয়োজন হয় ঘর ও কর্মক্ষেত্র থেকে কিছুদিনের জন্য অবসর নেয়া।
ভ্রমণ সর্বদাই আনন্দায়ক ও জ্ঞানার্জনের সাথে সম্পর্কিত। যারা ভ্রমণ করে তারা বাস্তব জীবন ও জগৎ থেকে জ্ঞানার্জনের সুযোগ পেয়ে থাকে। ভ্রমণের দ্বারা সহজেই সভ্যতা, সংস্কৃতি, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জ্ঞান লাভ করা যায়। আপনি যদি কোনো স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দ্ধতন কেউ হয়ে থাকেন তবে আপনার শিক্ষার্থীদের নিয়ে মাঝে মাঝে ভ্রমণের আয়োজন করতে পারেন। এই ভ্রমণের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ ও স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, চাল-চলন, সমাজ-সংস্কৃতি, ভাষা, জীবনধারণ ইত্যাদি নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে পারবে। সাধারণত ভ্রমণের জন্য দেশ-বিদেশের নানা পর্যটন স্থান, পাহাড়-পর্বত, ঝর্ণা, সাফারী পার্ক, পুরাকীর্তি, স্মৃতি বিজড়িত স্থান ইত্যাদিকে পছন্দের তালিকায় রাখা হয়। এজন্য প্রতি বছর এদেশ থেকে শত শত পর্যটক বিদেশেও পাড়ি জমায়।
তবে আপনার যদি বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ ও সামর্থ না থাকে তাহলে দেশেরই বিভিন্ন পর্যটন স্থান, পার্ক, অবকাশ কেন্দ্র ইত্যাদিতে ঘুরতে যেতে পারেন। দেশের মাঝেও এমন অনেক সৌন্দর্য-মণ্ডিত স্থান রয়েছে যেখানে গেলে আপনার মন-প্রাণ জুড়িয়ে যাবে, কেটে যাবে শহুরে জীবনের ক্লান্তি। আজকের লেখায় জানাবো এমনই এক ক্লান্তি দূরকারী ও প্রশান্তিদায়ক অবকাশ কেন্দ্র ‘গজনী অবকাশ কেন্দ্র’ এর কথা।
গজনী অবকাশ কেন্দ্র শেরপুর জেলা শহরের ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। এর উত্তরে রয়েছে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। পড়ন্ত বিকেলে গজনী থেকে উত্তর দিকে তাকালে ভারতের তুরা পাহাড় স্পষ্ট দেখা যায়। গজনী অবকাশ কেন্দ্রটি প্রায় ৯০ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। শেরপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১৯৯৩ সালে এটি নির্মিত হয়। এটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও উত্তরাঞ্চলের প্রধান এবং আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
গজনী অবকাশ কেন্দ্রে প্রবেশের পূর্বমুহূর্ত থেকেই চোখে পড়বে সবুজ গাছপালার সারি, লতাপাতার বিন্যাস, ছোট-বড় টিলা, উপজাতীয়দের ঘরবাড়ি ইত্যাদি। প্রধান প্রধান গাছপালার মধ্যে রয়েছে শাল, সেগুন ও গজারী গাছ। নানা ধরনের পাখ-পাখালির কিচিরমিচির শব্দে বিমোহিত হতে হয় পর্যটকদের।
প্রাকৃতিকভাবে সবুজ-শ্যামলে শোভিত গজনীতে পর্যটক আকর্ষণের জন্য কৃত্রিমভাবেও অনেক কিছু নির্মাণ করা হয়েছে। কৃত্রিম স্থাপনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিশালাকার ডায়নোসরের প্রতিকৃতি, ড্রাগন পাতালপুরী, মৎস্যকন্যা, আলোকের ঝর্ণাধারা, শিশুদের জন্য চুকোলুপি পার্ক, ছোট আকারের চিড়িয়াখানা, একুয়ারিয়াম ইত্যাদি। চিড়িয়াখানায় রয়েছে প্রায় ৪০ প্রজাতির প্রাণী। এগুলোর মাঝে ডায়নোসরের প্রতিকৃতি ভ্রমণকারীদের অনেক বেশি আকৃষ্ট করে।
আলোকের ঝর্ণাধারার শীতল জলে হাত মুখ ভিজিয়ে ঝর্ণার প্রবাহিত ছড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে পারবেন দীর্ঘপথ। প্রাকৃতিক পরিবেশ অবলোকন করতে করতে মন যদি চায় কবিতার জগতে হারাবেন তবে ছড়ি থেকে পদ্মসিঁড়ি বেয়ে সোঁজা উপরে উঠে ‘কবিতাঙ্গনে’ প্রবেশ করলে দেখা যাবে প্রকৃতি নির্ভর অসংখ্য কবিতা।
কৃত্রিম লেকের শান্ত জলে নৌ বিহারের জন্য রয়েছে সীমান্ত প্যাডেল বোট ও ময়ুরপঙ্খী নৌকা। এসব নৌকায় উঠে কফি পানের আড্ডাটা সেড়ে নেয়া যায় অনায়াসে।
অবকাশে বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর প্রতিকৃতি ও গারোদের বাসস্থানের ধারণা পাওয়ার জন্য প্রবেশ করতে হবে অমৃতলোকে।
অমৃতলোকের ভিতর থেকে চোখে পড়বে সীমান্তে ভারতীয় পাহাড়, গারো মা প্রতিকৃতি, উটপাখির ভাস্কর্য, ক্যাঙ্গারু ভাস্কর্য, পাখি বেঞ্চ, শিশু গার্ডেন, লাল পাহাড়, কুঁড়েঘর, ফুলের বাগান, কফি হাউজ, বিশাল আকৃতির অজগর সাপের ভাস্কর্য ইত্যাদি।
গজনী অবকাশের আরেকটি আকর্ষণ হচ্ছে ৬৪ ফুট উঁচু ‘সাইট ভিউ টাওয়ার’। এখানে উঠলে দেখা মিলবে ধূসর, আকাশী ও সবুজ গাছগাছালির মিতালি। এছাড়াও দূরে দেখা মিলতে পারে উপজাতি নারীদের ফসলের ক্ষেতে শস্য চারা রোপণ। গজনী অবকাশের পাহাড়ে সাধারণত গারো, কোট, হাজং বানাই, ডালু ও হদি উপজাতিরা বাস করে।
সবুজ গাছগাছালির ভিতর দিয়ে শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি তুলে হাঁটার সময় সতকর্তামূলক সাইনবোর্ড চোখে পড়লে বা কোথাও বাঁশ বেঁধে গতিরোধ করা হলে থেমে যেতে হবে। গভীর জঙ্গলে না যাওয়াই ভাল। গভীর জঙ্গলে ছিনতাইকারী ও বন্য হাতির আক্রমণের ভয় রয়েছে। জানা যায়, গজনীতে ৫০টিরও অধিক হাতি রয়েছে। গজনী অবকাশ, ছোট গজনী, বড় গজনী এলাকায় প্রায়ইশঃ হাতির আক্রমণে মানুষ মারা যায়। এই হাতিগুলো খাবারের সন্ধানে সবুজ ফসলের ক্ষেত ও কাঁঠালের লোভে মানব বসতির কাছাকাছি আসে। এসময় হাতি ও মানুষের সংঘর্ষে অনেক হাতিও মারা যায়। এছাড়াও পাহাড়ের ভিতর কিছু কিছু নিষিদ্ধ রাস্তা দিয়ে হাঁটলে ভারতীয় সীমান্তে অনুপ্রবেশকারী হিসেবেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের কাছে আটক হতে পারেন।
গজনী অবকাশ কেন্দ্র থেকে বের হয়ে প্রথমেই যে স্থানীয় বাজারটি চোখে পড়বে সেখানে এক কাপ চা পান করতে করতে মালিঝি নদীর প্রবেশ মুখে যাওয়ার পথ অথবা আদর্শ গুচ্ছ গ্রামের পথটি জেনে নিতে পারেন। এরপর মাত্র দশ থেকে পনেরো মিনিট হাঁটলেই পেয়ে যাবেন মনোরম পাহাড়ী গাছপালার ভিতর দিয়ে ভারত থেকে নেমে আসা মালিঝি নদী। নদীর পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তা ধরে চলে গেলেই দেখা যাবে মেঘালয় রাজ্যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এর ক্যাম্প। স্থানীয়দের কাছে সীমান্ত পরিস্থিতি জেনে নিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন সীমান্ত পিলার থেকেও কিছুটা ভিতরে।
গজনী গিয়ে মালিঝি নদীর সৌন্দর্য উপভোগ না করলে হয়তো আপনার ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যাবে। তাই নদীটি দেখতে যাওয়ার উপায় বলে দেয়া হল। তবে স্থানটি খুবই নির্জন ও গা ছমছম করা পরিবেশের মাঝে হওয়ায় সেখানে না যাওয়াই ভাল। তাছাড়াও এসব এলাকা থেকে মাঝে মাঝেই গোলাবারুদ উদ্ধার হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। ধারণা করা হয়, গোলাবারুদ গুলো ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) পরিত্যাগকৃত। তবে স্থানীয়দের মতে, অস্ত্র পাচারকারীদেরও কাজ হতে পারে।
গজনী এলাকা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটারের ব্যবধানে রয়েছে মধুটিলা ইকোপার্ক। হাতে সময় থাকলে দুটো দর্শনীয় স্থান একইসাথে ভ্রমণ করতে পারবেন। গজনী অবকাশ কেন্দ্রে বিকেল ৫টা পর্যন্ত থাকার অনুমতি রয়েছে। এলাকাগুলোতে এখনও শহুরে ছোঁয়া তেমন লাগেনি। অসামাজিক কার্যকলাপ মুক্ত হওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে ভ্রমণ করতে পারবেন। ভ্রমণের সময় অনেকগুলো সতকর্তার পাশাপাশি ছবি তোলার সময়ও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সে সময় ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড বা পিছনে অপরিচিত মেয়ের ছবি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা প্রয়োজন।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সহজেই সড়ক পথে গজনী অবকাশে যাওয়া যায়। ঢাকার মহাখালি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসযোগে যাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গ থেকে টাঙ্গাইল-জামালপুর হয়ে যেতে পারবেন গজনীতে। এছাড়াও শেরপুর থেকে সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দিয়ে অনায়াসে যাওয়া যায় গজনী অবকাশ কেন্দ্রে।
গজনী অবকাশ কেন্দ্রটি নির্মাণের পর থেকে শত শত পর্যটকের ভীড়ে মুখোরিত থাকছে। সাধারণত শীতের শুরু ও শেষে ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণা অধিক লক্ষ্য করা যায়। সে সময় দূর-দূরান্তের স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিকনিক বাস আসে। আপনিও হাতে সময় নিয়ে চলে আসতে পারেন গজনী অবকাশ কেন্দ্র ভ্রমণে। শহুরে ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে শরীর ও মনকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে পারবেন।
ফিচার ইমেজ – লেখক।