প্রাচীনকাল থেকেই পাথরের প্রাচীর নির্মাণের ব্যাপারে চীনা কারিগররা বেশ দক্ষ। চীনের এক প্রাচীরের কথা তো আমরা সবাই-ই জানি, পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম দুর্গপ্রাচীর; ২১,১৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ চীনের মহাপ্রাচীর। কিন্তু আমরা কি বিশ্বের দীর্ঘতম নগর প্রাচীর সম্পর্কে জানি? এটিও কিন্তু চীনেই অবস্থিত। ‘মিং নগর প্রাচীর’ বা ‘নানজিং প্রাচীর’ হলো বিশ্বের দীর্ঘতম নগর প্রাচীর, যা চীনের জিয়াংসু প্রদেশের নানজিং নগরে অবস্থিত। চীনের মহাপ্রাচীরের তুলনায় নাতিদীর্ঘ হলেও নানজিং নগরের প্রাচীরটি যেহেতু পৃথিবীর দীর্ঘতম নগর প্রাচীর, তাই একে অনেকে চীনের আরেক মহাপ্রাচীর বলে থাকেন।
১৩৬৬ থেকে ১৩৮৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে মিং সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানীকে শত্রুর বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য শহর ঘিরে নির্মাণ করা হয় দীর্ঘ এক প্রাচীর। কথিত আছে, মিং সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট, জু ইয়ানঝাং চীনের পাঁচটি প্রদেশের, ২০টি রাজ্যের, ১১৮টি গ্রামের জনগণকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এ নগর প্রাচীর নির্মাণের জন্য ইট তৈরি করতে। সম্রাটের আদেশে সমাজের নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষ অংশ নিয়েছিল ইট নির্মাণে। ২,০০,০০০ এরও বেশি শ্রমিক কাজ করেছিল সেই ‘মিং নগর প্রাচীর’ নির্মাণে।
নানজিং প্রাচীরের মূল বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে রয়েছে এর প্রধান নির্মাণসামগ্রী তথা ইটগুলোতে। ৪০-৫০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের প্রতিটি ইটের ওজন ১০ কিলোগ্রাম। ইটগুলোর প্রতিটির প্রস্থ ২০সেন্টিমিটার এবং উচ্চতা ১০ সেন্টিমিটার। প্রতিটি ইটেই এর কারিগরের নাম খোদাই করা আছে, খোদাই করা আছে নানা ভাষায় ইতিহাসের নানা কথা। আনুমানিক ৩৫০ মিলিয়নেরও বেশি ইট ব্যবহার করা হয়েছিল প্রাচীরটি নির্মাণে।
চীনের মিং সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক নিদর্শন নানজিং প্রাচীরকে চীনাদের স্থাপত্যশিল্পের সেরা সৃষ্টিগুলোর একটি বলে বিবেচনা করা হয়। নানজিংয়ের ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীরটির উচ্চতা স্থানভেদে ১৪ থেকে ২১ মিটার। কালের বিবর্তনে এ প্রাচীরের দৈর্ঘ্য হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ২১ কিলোমিটার অবশিষ্ট রয়েছে। নানজিং পৃথিবীর সেই অল্প সংখ্যক প্রাচীন শহরগুলোর একটি যার চারপাশ প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত। আজও পুরোপুরি না হলেও, এ শহর প্রাচীর দিয়ে ঘেরা অনেকটাই। যদিও এ প্রাচীর ৬০০ বছরেরও বেশি পুরনো, তবু এটি আজও বেশ আকর্ষণীয় এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।
চীনের ইয়াংজি নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত এই নানজিং প্রাচীর, যেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। আজ থেকে ছয়শত বছর পূর্বে উঁচু-নিচু পাহাড় ও আকাবাঁকা নদীর অববাহিকায় এমন একটি বিশাল প্রাচীর নির্মাণ যে কতটা কঠিন ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু সেই প্রাচীনকালেই চীনারা সব প্রতিকূলতাকে জয় করে এই অসাধ্য সাধন করেছিল দক্ষতা আর পরিশ্রমের জোরে। সেই প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার উপযোগী উপাদান দিয়েই তারা তৈরি করেছিল নানজিং প্রাচীর, যার কারণে আজও টিকে আছে সেটি, কালের বিবর্তনে হারিয়ে যায়নি।
নানজিং শহরের প্রাচীরটি সাংস্কৃতিকভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এর ইটগুলোতে খোদাইকৃত নাম এবং লিপির কারণে। যারা ইটগুলো খোদাই করেছিল, খোদাইয়ের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সেই কারিগরদের দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। প্রথমভাগে ছিল সেসময়ের বুদ্ধিজীবী এবং চাকরীজীবী শিক্ষিত শ্রেণী ও পেশার মানুষেরা। অন্যভাগে ছিল অশিক্ষিত শ্রমিক শ্রেণী এবং সাধারণ জনগণ। প্রথমশ্রেণীর মানুষদের দ্বারা যে ইটগুলো নির্মাণ ও খোদাই করা হয়েছিল সেগুলো ছিল খুবই চিত্তাকর্ষক এবং মার্জিত। সেই ইটগুলোতে মূল হস্তলিপির রীতিনীতি অনুসরণ করা হয়েছিল। নানজিং প্রাচীরের ইটগুলোতে খোদাই করা ভাষার মধ্যে বৈচিত্র্য লক্ষ্যণীয়। এই খোদাইকৃত ইটগুলো নানজিংয়ের ইতিহাসের এক অকাট্য দলিল। এগুলোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় সেই মিং সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে তার পরবর্তী সাম্রাজ্যগুলোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ লিখিত তথ্য-উপাত্ত, যেগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।
মিং সাম্রাজ্যের শাসনামলে নানজিং নগরকে সুরক্ষিত করার জন্য চার ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। শহরের বহির্ভাগ, অভ্যন্তরভাগ, রাজকীয় অংশ এবং মূল প্রাসাদ। নগরের বহির্ভাগে ১৩৯০ সালে ১৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চারকোণা আকৃতির প্রাচীর নির্মাণ করা হয় শহরের সুরক্ষা জোরদার করার লক্ষ্যে। এ প্রাচীরটির আর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না বর্তমানে। শহরের দ্বিতীয় ভাগে, অর্থাৎ অভ্যন্তরভাগে রাজকীয় অংশের চারপাশে নির্মাণ করা হয়েছিল একটি নগর প্রাচীর। এটিই বর্তমানে নানজিং প্রাচীর বলে পরিচিত। এরই ধ্বংসাবশেষ আজও টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। নানজিং প্রাচীরের ভেতরে ছিল নগরের রাজকীয় অংশ। এই রাজকীয় অংশই চীনের ‘নিষিদ্ধ নগরী’ বলে পরিচিত। নিষিদ্ধ নগরীর কেন্দ্রস্থলে রয়েছে নগরের চতুর্থ এবং প্রধান অংশ- মূল রাজপ্রাসাদ। নগরের বহির্ভাগের সুরক্ষা প্রাচীরের কোনো চিহ্ন আজ আর না থাকলেও অভ্যন্তরভাগের নানজিং প্রাচীর, নিষিদ্ধ নগরী এবং মূল রাজপ্রাসাদ টিকে আছে আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে, যেগুলো বর্তমানে নানজিংয়ে পর্যটকদের কাছে অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে জনপ্রিয়।
নানজিং প্রাচীরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে, এ শহরের অধিবাসীরা বর্তমানে এ প্রাচীর রক্ষার ব্যাপারে খুবই সতর্ক। কিন্তু সবসময় এমন অবস্থা ছিল না। যদি থাকতো তাহলে নানজিং প্রাচীর হয়তো পুরোপুরিই অক্ষত থাকতে পারতো।
নানজিং শহরের অধিবাসী ৯০ বছর বয়সী শি জিরু নানজিং নগর প্রাচীরের ছোট একটি অংশের রক্ষণাবেক্ষণের সাথে জড়িত। তিনি নানজিং নগর প্রাচীর সম্পর্কে বলতে গিয়ে ব্রিটিশ প্রচার মাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
নানজিংয়ের এই নগর প্রাচীরে অতীতে অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, তবু আজ অবধি এ প্রাচীর টিকে আছে। কেউ এটি ধ্বংস করতে পারেনি। জাপান যখন নানজিং আক্রমণ করেছিল, তারাও এ নগর প্রাচীর ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছিল। অথচ আজ আমরা নিজেরাই, আমাদের এই মহাপ্রাচীর অনেকটাই ধ্বংস করে ফেলেছি, যা খুবই দুঃখজনক।
শি জিরু জানান, উনিশশো পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে নানজিং নগর প্রাচীরকে নিতান্ত অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছিল। সরকারি বা বেসরকারি কোনো পদক্ষেপই সে সময় নেওয়া হয়নি এ ঐতিহাসিক নগর প্রাচীর রক্ষায়। সেসময়ই প্রাচীরের অনেক অংশ ধ্বসে পড়ে। ধ্বসে পড়া ইটের অনেকগুলোই লোকজন কুড়িয়ে নিয়ে নিজেদের ঘরবাড়ির দেয়াল নির্মাণে কাজে লাগায়। শি জিরু নিজেও প্রাচীরের দুটি ইট চুরি করে নিজের কাছে রেখেছিলেন বলে জানান। এছাড়াও, নানজিং নগরের অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত করতে প্রাচীরের একাংশ ভেঙে রাস্তা নির্মাণ করে সরকার। এভাবেই তিলে তিলে ক্ষয় হতে থাকে নানজিংয়ের ঐতিহাসিক নগর দেয়াল।
২০১৬ সালের দিকে চীন সরকারের নজর পড়ে নানজিংয়ের নগর দেয়ালের বেহাল দশার দিকে। সেসময় সরকার এ নগর দেয়াল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এরই অংশ হিসেবে সরকারি কর্তৃপক্ষ এক বিশেষ প্রচারণার আয়োজন করে। সে প্রচারণায় নগর প্রাচীরের ঐতিহ্য রক্ষার প্রয়োজনে হারানো বা লুট হয়ে যাওয়া ইটগুলো ফিরিয়ে দেবার জন্য নগরবাসীকে অনুরোধ করা হয়। সাথে এ ঘোষণাও দেওয়া হয় যে, প্রাচীরের ইট ফিরিয়ে দিলে কাউকে কোনো জরিমানা করা হবে না। সরকারি এই প্রচারণা একরকম সফলই বলা চলে। কেননা, এই প্রচারণার ফলে নানজিং নগরবাসীরা মোট আশি হাজার ইট ফিরিয়ে দেয় সরকারি কর্তৃপক্ষকে। ইটগুলো বর্তমানে প্রাচীরের নিম্নদেশে একটি বিশাল গুদামে সংরক্ষিত আছে। ইটগুলো এখন প্রাচীরের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামতের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রাচীরের অনেক অংশ তো ইতিমধ্যে পূর্বের আকৃতি ফিরে পেয়েছে।
নানজিং নগর প্রাচীরের উপরের দিকে নির্মাণের সময় শহরের সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে প্রচুর খাঁজ রাখা হয়েছিল। তাই স্থানীয় প্রশাসন দর্শনার্থীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে নানজিং প্রাচীরের একপাশে পাঁচ মিটার চওড়া একটি ফুটপাতও নির্মাণ করেছে নতুন করে। প্রাচীরটি স্থানীয়দের জন্য এখন একটি বিনোদন পার্ক হিসেবে উন্মুক্ত করা হয়েছে।
নানজিং নগর প্রাচীরটি যেন নানজিং শহরের প্রাণভোমরা। শি জিরুর মতে, নানজিং শহরের বয়োবৃদ্ধ অনেক অধিবাসী আজও বিশ্বাস করে, নগরের বাড়িঘরগুলো হয়তো একদিন ভেঙে গুড়িয়ে যাবে, সবকিছু ধ্বসে যাবে, কিন্তু সেদিনও নানজিং প্রাচীরটি দাঁড়িয়ে রবে স্বমহিমায়। এ প্রাচীরের ছায়াতলে রক্ষা পাবে নানজিং শহরের ইতিহাস-ঐতিহ্য। চীনের নানজিং নগরীর ঐতিহ্যকে যুগ যুগ ধরে মহিমান্বিত করে রাখবে দীর্ঘতম এ নগর প্রাচীর।