প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিমালয় কন্যা নেপাল। প্রকৃতি যেন তার দু’হাত ভরে দেশটিকে সাজিয়ে তুলেছে। চারদিকে উত্তুঙ্গ পর্বতের রঙের খেলা, হিমেল হাওয়া, গ্রাম্য পরিবেশের মাঝে বুঁদ হয়ে থাকার নেশায় যেকোনো পর্যটকেরই পছন্দের স্থান নেপাল।
এই নেপালের এক প্রধান আকর্ষণ পাহাড়ঘেরা সারাংকোট। এ অঞ্চলটি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর পোখরায় অবস্থিত। নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডু থেকে পোখরার দূরত্ব প্রায় ২০৩ কি.মি। কাঠমুন্ডু থেকে পোখরায় যাওযা পথটির দু’ধারে চোখ জুড়ানো সব প্রাকৃতিক দৃশ্য। নীল আকাশের সাদা মেঘ, সবুজ পাইনের বন, ঘন নীল আকাশটার বুকে পরিযায়ী পাাখিদের আনাগোনা- এসব যেকোনো পর্যটকের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। যাত্রাপথে সঙ্গী হবে ঘোলাটে ঘন সবুজ বন ও ত্রিশূল নদী। চারধারে পাহাড় আর পাহাড়। বনপাহাড়ের পদাবলী শুনিয়ে যায় নামা না জানা কত পাখি। নেপাল সত্যিই এমনই সুন্দর এক দেশ।
পোখরা যাওয়ার পথেই ত্রিশূল নদীর পাড়ের এক ছোট্ট জনপদ চেরিস। চেরিস থেকে পোখরার দূরত্ব ৯৪ কি.মি। পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলেছে ঘন সবুজ রঙা ত্রিশূল নদী আর আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হিমালয় কন্যার আর এক নৈসর্গিক শহর পোখরা পর্যটকদের স্বাগত জানায়। পোখরা শহরটি অনেকটা পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ফেউয়া লেক। পাহাড় ও লেকের মাঝখানে এক চমৎকার শহর এই পোখরা।
যেদিকে চোখ যায় সেদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। মাঝে মাঝে অসংখ্য ছোট বড় পাহাড় মাথা উঁচিয়ে আছে। এই পাহাড়ি উপত্যকা ঘিরে রয়েছে সাত-আটটি লেক। রয়েছে নামজাদা বরফমোড়া শৃঙ্গের হাতছানি। সারা পৃথিবীর দশটা শৃঙ্গের মধ্যে আটটা শৃঙ্গই নেপালে। সেই কারণে সারা বছর পর্যটকরা বারে বারে ছুটে আসেন নেপালে। এখান থেকেই হিমালয় চূড়ার দেখা মিলবে। পোখরা ভ্যালির অপরূপ সৌন্দর্য যেন কোনো চিত্রপটে আঁকা ছবি। জ্যোৎস্নায় গোটা উপত্যকা এক অপার্থিব রূপ ধারণ করে। সমস্ত নীরবতাকে ছিন্নভিন্ন করে পুরো উপত্যকা যেন এক মায়াবি আলোর খেলায় মেতে ওঠে।
পোখরায় পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ সারাংকোট। এটি একটি পর্বত চূড়া। এটি পোখারার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। স্থানটি পর্যটকদের এক প্রধান গন্তব্যস্থল। এখান থেকে পৃথিবীর সুন্দরতম সূর্যোদয় দেখা যায়। পোখরায় আসা কোনো দর্শনার্থীই সারাংকোটে প্রথম সূর্যোদয় দেখার লোভ সামলাতে পারেন না। সূর্য ওঠার অনেক আগেই এই স্থানে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। পোখরা থেকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের চড়াইউৎরাই দিয়ে মিনিট ত্রিশের পথ পেরিয়ে চলে যাওয়া যায় লোয়ার সারাংকোটে। এরপর প্রকৃতির বুকে প্রায় ৩ কি.মি ট্রেক করে যেতে হবে আপার সারাংকোটে।
এ সময় পাহাড়ি পথে চোখে পড়বে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি গ্রাম। শেষ বাঁকের মারাত্মক চড়াই পেরিয়ে পৌঁছতে হয় আপার সারাংকোটের ভিউপয়েন্টে। ১,৫৯৫ মিটার উচ্চতায় হাড়কাঁপানো হিমেল হাওয়ার দাপটকে সহ্য করে সামনে বিস্তীর্ণ প্রকৃতির ক্যানভাসে সকলেই অপেক্ষারত সেই মহেন্দ্রক্ষণের। সূর্যোদয়ের মুহূর্তটি দর্শন করার অধীর অপেক্ষায় সকল পর্যটক। ভোর সূর্যের প্রতিটি রশ্মির কণা ঠিকরে পড়ছে অন্নপূর্ণার পাঁচটি শিখরের শরীরে। সূর্য উঁকি দেওয়ার আগেই কমলা, হলুদ রঙে রাঙাতে শুরু করে ধবধবে সাদা অন্নপূর্ণা। ফিশ টেইলের দেখা যায় এখান থেকেই। হিমালয়ের কোলে এ রকম সূর্যোদয় দেখা ভ্রমণার্থীদের কাছে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
পায়ের কাছে নতজানু হয়ে আছে পোখরা ভ্যালি। সূর্যের উদ্ভাসিত আলোয় ঝকঝকে, হাসিমুখ গোটা সারাংকোট। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সারাংকোট থেকে ফিশ টেইল, ধুলাগিরি, গনেশ, মানাসলুউ ও অন্নপূর্ণার সর্বোচ্চ শিখরের চমৎকার দর্শন পাওয়া যায়। সূর্যের বর্ণিল আলোয় শৃঙ্গরাজদের রংবদলের খেলায় সকলেই নির্বাক দর্শক হয়ে যান। সময় থাকলে অনেকে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ওয়ার্ল্ড পিচ প্যাগোডা দেখতে ভুল করেন না।
সারংকোট একটি জনপ্রিয় প্যারাগ্লাইডিং লঞ্চিং পয়েন্ট। নানা রঙের বিশাল পাখির মতো ডানায় ভর করে প্যারাগ্লাইডাররা আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও’প্রান্ত চষে ফেলেন। প্যারাগ্লাইডিং করে ফেওয়া লেকের ওপর দিয়ে উড়ে বেড়ানোর সময় পুরো পোখারা উপত্যকাটি দেখতে পাওয়া যায়। পোখরায় আটটা অনবদ্য লেক রয়েছে। ফেওয়া লেক, বেগনাস লেক তার মধ্যে অন্যতম। রয়েছে তিনটি মিউজিয়াম আর অনন্যসাধারণ কয়েকটি প্রাচীন গুহা।
ফেওয়া নেপালের দ্বিতীয় এবং পোখার উপত্যকার সবচেয়ে বৃহত্তম লেক। পোখরার দক্ষিণে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৪২ মিটার উচ্চতায় এই লেক অবস্থিত। এটি প্রায় ৫.২৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। বিদেশী পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ এই ফেওয়া লেক। রঙিন ডুঙ্গা বা নৌকায় চড়ে লেকের দু’প্রান্তের প্রাকৃতিক দৃশ্য বেশ উপভোগ্য।
লেকের জলে অন্নপূর্ণা, ফিশ টেইলের প্রতিবিম্বকে সঙ্গী করে লেকের মাঝে অবস্থিত বরাহ মন্দির থেকে ঘুরে আসা যায়। অষ্টাদশ শতকে তৈরি এ মন্দিরের আরাধ্য দেবতা হলেন বরাহরূপী ভগবান বিষ্ণু। নৌকা করে ফেওয়া লেক দিয়ে উত্তরের সারংকোট এবং কাস্কিকোট পাহাড়গুলোর চারপাশ হয়ে ছেপাং লেকের ধারে পৌঁছে যাওয়া যায়। লেকের জলে হিমালয়ের ছটি শৃঙ্গরাজের উপস্থিতির প্রতিবিম্ব যেন কোনো পিকচার পোস্টকার্ড। লেকের পাড়ে বসে, পাহাড়ের আড়ালে সূর্যাস্ত দেখা প্রতিটি ভ্রমণার্থীদের কাছে সারাজীবনের অসাধারণ স্মৃতি হয়ে থাকবে।
ফেওয়া লেকের পর পোখরার আরেকটি জনপ্রিয় লেক হচ্ছে বেগনাস লেক। পোখড়া উপত্যকার আটটি হ্রদের মধ্যে এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম। এটি ৩.২৮ বর্গ কি.মি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এ লেকের গভীরতা প্রায় ১০ মিটার। হ্রদটি পর্যটকদের প্রিয় জায়গাগুলোর একটি। এখানে অনেক দেশী-বিদেশী পর্যটকের দেখা মেলে। লেকের স্বচ্ছ পানি, সবুজের সমারোহ আর চারপাশের শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ অনেককেই মোহিত করে রাখে। প্রিয়জনকে নিয়ে নৌবিহার করা কিংবা যাদের মাছ ধরার নেশা আছে তারা টিকিট কেটে মাছ ধরতেও বসে যেতে পারেন লেকের ধারে।
পোখরা উপত্যকার আরেক আকর্ষণ মহেন্দ্র কেভ। মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেবের নামে এই গুহাটির নামকরণ করা হয়েছে। ৬০ মিটার দীর্ঘ গুহার অন্দরমহল রীতিমতো রোমাঞ্চকর। গুহার ভেতরে নির্মিত প্রাকৃতিক টানেলটি দিয়ে গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা যায়। টানেলে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা রাখা রয়েছে। গুহার ভেতরের পাথরগুলো বিভিন্ন ধরনের শিলা ও চকমকি পাথর দিয়ে তৈরি। সূর্যের আলো যখন পড়ে তখন বিভিন্ন পাথরে সে আলো পড়ে গুহার ভেতরটি ঝলমল করতে থাকে।
মহেন্দ্র কেভ থেকে ফিশ টেইল ও অন্নপূর্ণার গ্লেসিয়ার থেকে সৃষ্ট হওয়া দুধ সাদা, সফেন খরস্রোতা শ্বেতি নদীর দেখা পাওয়া যায়। মহেন্দ্র কেভের পাশেই আরেকটি গুহা ব্যাট কেভ বা বাদুর গুহা। এর প্রবেশদ্বার সংকীর্ণ হলেও গুহার ভেতরের অংশ যথেষ্ট প্রশস্ত। এই গুহা বিভিন্ন প্রজাতির হাজার হাজার বাদুরের আবাসভূমি।
পোখারা শহরটির জলপ্রপাতের জন্য বিখ্যাত। এখানে বেশ কয়েকটি জলপ্রপাত রয়েছে। তার মধ্যে ডেভিস ফলস অন্যতম। এই অনিন্দ্যসুন্দর জলপ্রপাতের পানি ফেওয়া লেকে এসে মিশেছে। জলপ্রপাতের কাছে যেতেই আবার দেখা মিলবে দুরন্ত শ্বেতি নদীর। স্থানীয়দের কাছে ডেভিস ফলস পাতালদাঙ্গে নামেই বেশি পরিচিত। চারধারে রেলিং দিয়ে ঘেরা ডেভিস ফলস দেখে চলে আসা যায় প্রায় ৫০০ বছরের এক পুরনো গুপ্তেশ্বর মহদেব গুহায়। ঘোরানো সিঁড়ি নেমে গেছে প্রায় ১০০ মিটার গভীরে।
পোখরার আরেক আকর্ষণ ইন্টারন্যাশনাল মাউন্টেইন মিউজিয়াম। তথ্যবহুল অসাধারণ এক মিউজিয়াম। এখানে এলে নেপাল, জাপান, স্লোভাকিয়া এবং অন্যান্য দেশের পর্বতারোহণের অতীত-বর্তমানের অন্বেষণ করতে পারেন। জানতে পারবেন নানা পর্বতারোহীর গল্প। এখানে মাউন্ট এভারেস্টের একটি থ্রিডি মডেলের ছবিও রয়েছে।
এই যাদুঘরে এভারেস্টের বাইরেও হিমালয়ের অন্যান্য পর্বতগুলো সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যাবে। কয়েক দশক আগেও পর্বতারোহীরা বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গগুলো জয় করার জন্য যেসব উপকরণ ব্যবহার করতেন তার রেপ্লিকা জাদুঘরে সাজানো রয়েছে।
পোখরার সাইড সিনও দেখার মতো। অনেক গোছানো এক শহর। পুরনো পোখরা শহরের দিকটা এখনও সেই প্রাচীন মোড়ক ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি। কাঠের কারুকাজ, ইট কাঠ নিয়ে পুরনো ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে আছে। ২০০ বছরের প্রাচীন দোতলা ভীমসেন মন্দিরের কারুকাজ যে কাউকে মুগ্ধ করবে। দুর্দান্ত সৌন্দর্যে ভরা পোখরা আর অল্পচেনা সারাংকোট সত্যিই অসাধারণ।