মাইক্রোনেশিয়ান দ্বীপরাষ্ট্র ইয়েপে অনন্যসাধারণ এক ধরনের মুদ্রা প্রচলিত রয়েছে। গ্রামের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশালাকার পাথরগুলো এখানকার প্রচলিত মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই মুদ্রার নাম হচ্ছে- রাই। পাথরগুলো উচ্চতা এবং ওজনের দিক দিয়ে এতটাই বিশাল যে এগুলোকে সরানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
১.
দ্বীপটিতে পৌঁছানো বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার বটে। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এই দ্বীপটিতে যেতে হলে গভীর ম্যানগ্রোভ বন, সোয়াম্প ফরেস্ট, বিশাল জলাভূমি পাড়ি দিতে হয়। প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশের এই দ্বীপটিতে প্রবেশের সাথে সাথেই আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবে ইয়েপি রমণীরা। কিন্তু এসব ছাপিয়ে এই দ্বীপের সবচাইতে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশালাকৃতির পাথরগুলো। প্রথমে দেখলে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না যে এগুলো স্থানীয় মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।
শত শত বিশাল এবং গোল চাকতির মতো পাথরগুলো পুরো দ্বীপ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিছু কিছু পাথর গ্রামের হোটেলগুলোর বাইরে অবস্থিত, আবার কিছু কিছু পাথর গভীর বনের ভেতর এবং সমুদ্র সৈকত জুড়ে আছে। প্রতিটি গ্রামেই এই পাথুরে মুদ্রার ব্যাংক রয়েছে; সাধারণত যেসব পাথরগুলো খুব ভারি এবং সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরানো যায় না, সেগুলো ব্যাংকের সামনে রাখা হয়।
২.
এই অদ্বিতীয় মুদ্রা ব্যবস্থা এখানে প্রায় কয়েকশ বছর ধরে চলে আসছে। যদিও ঠিক কীভাবে এই মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে কেউই তেমন কিছু জানে না। যতটুকু জানা যায়, প্রতিটি পাথরের চাকতি আকৃতির মুদ্রা একটি অপরটি থেকে আলাদা। এদের ওজনের উপর নির্ভর করে একটি পাথরের মূল্য এবং অর্থ নির্ধারিত হয়ে থাকে। ইয়েপিদের এই আবাসস্থল থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে, পালাউ নামক দ্বীপদেশ থেকে ইয়েপিরা এই পাথরগুলো খোদাই করে, দীর্ঘ জলপথ ভ্রমণের মাধ্যমে নিয়ে এসেছিল। সর্বপ্রথম যেই পাথরটি ইয়েপে নিয়ে আসা হয়েছিল, সেটি ছিল অনেকটা তিমি আকৃতির। যার নাম ছিলো রাই। এই নাম থেকেই মুদ্রার নামকরণ করা হয়েছিল। পাথরটি মূলত উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে বিবর্তিত হতে হতে, এই পাথরগুলো এখানকার মুদ্রা হিসেবে প্রচলিত হয়ে গেছে। এই বিশালাকৃতির মুদ্রাগুলোর ঠিক মধ্যে একটা ছিদ্র রয়েছে, যা এগুলোকে সমুদ্রপথে পরিবহণ সহজ করেছিল।
ধারণা করা হয়, সর্বপ্রথম একদল ইয়েপি নাবিক ইয়েপ থেকে পালাউতে গিয়েছিলেন নৌকার ভেলায় চড়ে এবং ইয়েপের সাথে পালাউ’র যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। তারা ছিলেন ইয়েপের সম্মানিত এবং ক্ষমতাশীল নাগরিক, তাই তাদের পক্ষে সেই সময়ে ভ্রমণের জন্য একটি নৌকা নিযুক্ত করা তেমন কোনো কঠিন কাজ ছিল না। পালাউতে ভ্রমণের সময় তারা সেখানকার মানুষের সাথে সখ্য তৈরি করেছিলেন এবং সেখানকার পাথরখনিতে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন। পালাউ থেকে ফিরে এসে, তারা ইয়েপিদের সাথে মিটিং করেছিলেন এবং স্থানীয় মদ তুবা’র বিনিময়ে পাথরের বাণিজ্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মাস খানেকের মধ্যে তারা আবার পালাউতে গিয়ে, সেখানকার খনি থেকে পাথর নিয়ে, খোদাই করে মুদ্রা হিসেবে প্রচলিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
কিন্তু এতকিছু রেখে পাথরকেই কেন মুদ্রা হিসেবেব প্রচলিত করা হলো? আসলে তখনকার সময়ে ইয়েপে মূল্যবান কোন ধাতু বা মজবুত এবং স্থিতিশীল পাথরও ছিল না, যা দিয়ে মুদ্রার প্রচলন করা যায়। এর ফলে ইয়েপের সম্পদশালী এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা, অভিজ্ঞ ইয়েপি নাবিকদেরকে পালাউতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে ছিল কাঠের বা বাঁশের তৈরি ভেলা। ভেলায় করে সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে প্রথম দিকে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির পাথরগুলো নিয়ে আসা হতো। পরের দিকে নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে, তাদের আমদানি করা পাথরের আকার আরো বড় হতে থাকে। এরপর উনিশ শতকের শেষ দিকে ইউরোপিয়ান বণিকদের মাধ্যমে তারা ধাতব যন্ত্রের সন্ধান পায়। এরপর তাদের পাথরখনি থেকে পাথর উত্তোলন সহজতর হয়েছিল। ১৮৮০ সালের একটি রিপোর্টে বলা হয়, পালাউয়ের কোরোরে অবস্থিত একটি খনিতে প্রায় ৪০০ ইয়েপি একত্রে কাজ করতো। যা তাদের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।
৩.
পালাউ থেকে ফিরে এসে, নাবিকরা পাথরগুলো ইয়েপের হাই র্যাংক চিফদের দিয়ে দিতো এবং বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা ক্ষমতাশীল উঁচু পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা নাবিকদেরকে অভ্যর্থনা জানাতো। তারা বড় এবং ছোট পাথরগুলো দুই পঞ্চমাংশ নিজেদের কাছে রেখে দিতো। কেউ কেউ তাদের পাথরের নামও রাখতেন। নামগুলো তারা নিজের বা আত্মীয়স্বজনের নামে রাখতেন। প্রাচীন মুক্তা মুদ্রার হিসেবে প্রতিটা পাথরের একটা মূল্য নির্ধারণ করা হতো এবং এরপর এই পাথরগুলো মুদ্রা হিসেবে নির্দিষ্ট মূল্যমান বহন করতো।
সমাজের প্রধান ব্যক্তি যদি বলতেন, একটা পাথরের মূল্যমান ৫০টি মুক্তার মুদ্রার সমান; তাহলে পাথরটি নিজের করে নিতে হলে একজন ইয়েপির ৫০টি মুক্তার মুদ্রা লাগতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, দৈনন্দিন কেনাকাটার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে এই মুক্তার মুদ্রাব্যবস্থা ডলারে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঐতিহ্য বা অধিকার যা-ই বলুন না কেন, ১১ হাজার ইয়েপি জনগণের কাছে এই পাথুরে মুদ্রাই খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে থাকে।
ইয়েপের আদি পরিবার ফাল্মড, তাদের পাথুরে মুদ্রাগুলোর মাত্র দু’বার ব্যবহার করেছিলেন। এবং এর মধ্যে একটি ছিল ক্ষমা চাওয়ার জন্য বা জরিমানা পরিশোধের জন্য। ফাল্মড পরিবারের একজন অন্য একটি পরিবারে জন্য কিছুটা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, বিধায় তাদেরকে এই জরিমানা গুনতে হয়েছিল। ক্ষমতাশীল উঁচু পর্যায়ের এক প্রতিবেশীর মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর তার বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। এর ফলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কন্যার পরিবারকে একটি পাথর মুদ্রা দিতে হয়েছিল। এবং তারাও এটি গ্রহণ করেছিল।
৪.
এই পাথুরে মুদ্রার তারল্য, পশ্চিমা-পূর্বনির্ধারিত এবং স্থির অর্থ-ব্যবস্থাকে সবসময়ই অস্বীকার করে আসছে। এই চাকতির মতো গোলাকার পাথরের মূল্য নির্ধারণ করা হয় এর আকারের ভিত্তিতে। ভিন্নতা অনুসারে এই পাথরগুলোর ব্যাসার্ধ ৩.৬ সেন্টিমিটার থেকে ৭ সেন্টিমিটার। পাশাপাশি পাথরের উপর অলঙ্করণ এবং পাথর প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কষ্ট ও পরিশ্রমের ভিত্তিতে- এমনকি কে কাকে কেন পাথরটি দিয়েছে, এর উপরে পাথরের মূল্যমান নির্ভর করে।
এর পাশাপাশি, এই মুদ্রার মূল্যমান ইয়েপিদের মৌখিক ইতিহাসের উপরেও নির্ভর করে। ইয়েপি পরিবারগুলো তাদের জায়গা বা গ্রাম থেকে তেমন একটা স্থানান্তরিত হয় না। এবং পুরো ইয়েপের ১৫০টি গ্রামের, মুরুব্বী পর্যায়ের লোকেরা পাথরগুলো সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে। বলা যায়, তারা এক প্রকার স্মারক হিসেবে কাজ করে। এতে করে, কোন পাথরটি কার এবং কোনটির মূল্যমান কত, তা কেউ ভুলে যায় না! এমনকি কোন পাথরের পেছনে কোন ইতিহাস বা গল্প জড়িত আছে, তাও মনে রাখতেন তারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, কিছু পাথরের গায়ে প্রায় ২০০ বছর আগের যুদ্ধের চিহ্ন নকশাকারে খোদাই করা আছে।
প্রতিটি মুদ্রার পেছনে গোপন কিছু গল্প লুক্কায়িত রয়েছে। গ্রাম্য সম্পর্ক, বিয়ে-শাদি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ক্ষমার বিভিন্ন রকম গল্প বয়ে বেড়াচ্ছে এই পাথরগুলো। এই গল্পগুলো গ্রামের মানুষের মধ্যে প্রচলিত এবং তারা জানে, কোন পাথরটির মূল্যমান কত বেশি। আপাতত ইয়েপে আরো রাই মুদ্রা তৈরির দরকার হচ্ছে না। এখন এইখানে যে ক’টি রাই রয়েছে, সেগুলোর সবকটিই তাদের মুদ্রাব্যবস্থায় প্রচলিত আছে এবং খুব অল্প সংখ্যক রাই তাদের স্থান থেকে সরানো হয়েছে। এমনকি পুরোনো এবং ভেঙে যাওয়া পাথরগুলো এখনো সংশ্লিষ্ট ইতিহাস ধারণ করে আছে এবং নতুন রাই’র চাইতে এদের মূল্যমান এখনো বেশিই আছে। পূর্ববর্তী প্রজন্মের মাঝে যে দক্ষতা ছিল, সেগুলো নতুনরা ভুলে না যায়, সে লক্ষ্যে মাঝে মাঝে নতুন রাই পাথর তৈরি করা হয়ে থাকে।
৫.
পাথরগুলো যদি এতই মূল্যবান হয়ে থাকে, তাহলে খোলা স্থানে রাখার পরেও; এগুলো কেন কেউ নিজের মতো করে রাখতে পারেনা বা চুরি হয়ে যায় না? আসলে পাথরগুলো সম্পর্কে সকল তথ্যই গ্রামের সকলের জানা এবং এদের পেছনের ইতিহাসও কারো অজানা নয়। তাই এই পাথরগুলো চুরি করবে, এমন লোক এখানে নেই। এজন্য আবার এমনটি ভাবার কারণ নেই যে, কেউ এই কাজ করার চেষ্টা করেনি। কেউ হয়ত দুয়েকটা চুরির করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। উল্টো ভেঙে ফেলেছিল। পাথরগুলো এত বিশাল এবং ভারি যে এদেরকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সরানো বেশ দুর্ভোগের ব্যাপার।
ইয়েপের প্রতিবেশি দ্বীপ গুয়াম, পালাউ এবং চুক; ব্রিটিশ এবং আমেরিকান ঔপনিবেশিকতার শিকার হয়েছিল। এবং এরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার প্রতীক হয়ে আছে। গুয়াম দ্বীপটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার একটি মিলিটারি বেসক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৪৪ সালের অপারেশন হেইলস্টোনের ভয়াবহতা এখনো চুক লাগুনে রয়ে গেছে। বিশ শতকের শুরুর দিকে জাপানের দখলদারিত্ব শেষ হবার পর, ইয়েপিদের উপর আমেরিকানরা বোমাবাজি চালিয়েছিল।
৬.
গ্রামে নতুন সন্তান জন্ম নিলে, সমাজের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ করা হয় এবং ক্ষুদ্রাকারের কিছু পাথরের বিনিময়ে মুরগি জবাই দেয়া হয়। জবাই করা মুরগির রক্ত দিয়ে নবজাতকের মাথা মুছে দেয়া হয়। এরপর সন্তানের নাম রেখে, সে নামানুসারে পাথরটির নামকরণ করা হয়। পাথরের উপর কোনো নাম লেখা না থাকলেও, এমনকি এই উপহারের কোনো রেকর্ড না থাকলেও; সকলেই জানে পাথরটি কার জন্মের সময় নামকরণ করা হয়েছিল।
যদিও সম্প্রতি ইয়েপিরা আনুষ্ঠানিকভাবে ইউ এস ডলারকে তাদের স্বীকৃত মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেছে; তবুও এই পাথরের মুদ্রার স্থায়িত্ব এবং সত্যতার কারণে এগুলো ইয়েপিদের শত বছরের শিল্প ও সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করে থাকে। ইয়েপিরা তাদের এই মুদ্রাগুলোকে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে চায়। তাই এখনো সামাজিক সম্প্রীতি, অনুষ্ঠান, সংস্কৃতি ও শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে, তারা তাদের এই পাথরের রাই মুদ্রাকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। মঙ্গায়ল অঞ্চলের একটি পাথুরে মুদ্রার ব্যাংকের সামনে দাঁড়ালে দেখা যায় ছোট-বড় কয়েক ডজন পাথর সাজানো রয়েছে। এই স্থানে গ্রামবাসী তাদের কেনাবেচা, আচার-অনুষ্ঠান এবং শিক্ষালাভের জন্য জড়ো হয়ে থাকেন। এই বিশালাকার মুদ্রাগুলো বর্তমানে ইয়েপিদের জাতীয় প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে।
Feature Image: BBC