রঙিন জিনিস পছন্দ করেন না এমন মানুষও আছে? প্রকৃতি থেকে শুরু করে সেলুলয়েডের নকল জগৎ, সর্বত্রই রঙের ছড়াছড়ি। যা কিছু রঙিন, তা-ই যেন সুন্দর। মানুষ রং ভালোবাসে বলেই তো নর্দার্ন লাইটের প্রতি এত আকর্ষণ, অস্তগামী সূর্যের আভার এত মহিমা, রংধনু দেখবার জন্য এত ব্যাকুলতা। সিনেমা আর অ্যানিমেশনগুলোতেও আজকাল বাহারি রঙের ছড়াছড়ি চোখে পড়ার মতো। আর বাস্তব জগতে এমন অভিজ্ঞতা চাইলে আপনার জন্য রয়েছে পৃথিবীর অনেক শহর, যারা রঙে রঙে রাঙিয়েছে তাদের পুরো শহরটাকে। এই ফটোব্লগটি সাজানো হয়েছে এমনই কিছু শহরের মনোহর সব ছবি দিয়ে, যেগুলো আপনাকে নিয়ে যাবে হলিউড নির্মাতা ওয়েজ এন্ডারসনের সিনেমাগুলোর রঙিন সেটে।
সেন্ট জন, কানাডা
প্রচলিত আছে যে, সেন্ট জন সবসময় নিজের বাড়িটি রঙিন করে রাখতেন, যেন বিষণ্ণ আবহাওয়ায়ও সেটির সৌন্দর্য না কমে যায়। উল্লেখ্য, সেন্ট জন যিশু খ্রিস্টের ১২ জন দূতের একজন। সেই ঐতিহ্য রক্ষা করতেই কানাডার সেন্ট জন শহরের বাড়িগুলো বাহারি রঙে রাঙা। রং-বেরঙের জেলির মতো দেখতে বাড়িগুলোর একেকটি সারিকে তাই বলা হয় ‘জেলিবিন রো’। পর্যটকদের জন্য একটি দর্শনীয় স্থান এই শহর।
লা বোকা, আর্জেন্টিনা
আর্জেন্টিনার রাজধানী শহর বুয়েনস এইরেসের একটি অংশ লা বোকা এর ঐতিহ্যবাহী বর্ণময়তার জন্য বিখ্যাত। নিছক সৌন্দর্যের জন্য নয়, এখানে শত শত বছর ধরে চলে আসা ঐতিহ্য রক্ষার্থেই রঙে রঙে রাঙা প্রতিটি বাড়িঘর আর রাস্তাঘাট।
লংইয়ারবিয়েন, নরওয়ে
শ্বেত শুভ্র বরফ, দিগন্ত প্রসারিত নীল আকাশ আর তার মাঝে একটুকরো বর্ণালী! নরওয়ের লংইয়ারবিয়েন শহরের বর্ণনা এভাবেই দিতে হবে। পৃথিবীর সর্ব উত্তরে অবস্থিত এই শহরের রঙিন বাড়িঘরগুলো প্রকৃতির রঙের সাথে মিশে একাকার হয়েছে, সৃষ্টি করেছে মায়াময় সৌন্দর্যের। ভ্রমণপিপাসু হলে এ শহর আপনার জন্যই।
বো কাপ, দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে অবস্থিত বো কাপ শহরের রঙিন হয়ে ওঠার ইতিহাস সম্ভবত সবচেয়ে সুন্দর এবং গৌরবময়। ১৬ শতকে ডাচ বণিকেরা শহরের কাজের জন্য মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক দাস নিয়ে আসে এখানে। ধীরে ধীরে দাসদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তার সৃষ্টি হতে থাকে, যা প্রথম সর্বাত্মক রূপ নেয় ১৭৬০ সালে। সে বছর এ শহরে প্রথম রঙিন বাড়ি নির্মাণ করে দাসরা। এই রং ছিল তাদের স্বাধীনতা এবং স্বকীয়তার প্রতীক।
উইলেমস্টেড, কুরাসাও
ক্যারিবিয়ান দ্বীপ রাষ্ট্র কুরাসাওয়ের রাজধানী উইলেমস্টেডের রঙিন হবার কাহিনী বেশ মজার। ১৯ শতকের শেষার্ধে এখানকার গভর্নর আলবার্ট কিকার্ট ছোট্ট এই শহরকে রঙিন করে তোলেন। কারণ ছিল তার মাথাব্যথা! কিকার্ট নিজের মাথাব্যথ্যার কারণ খুঁজে পান শহরের সাদা রঙের বাড়িগুলোর মধ্যে। বাড়ির রং সাদা হওয়া সূর্যরশ্মি অতিরিক্ত প্রতিভাত হতো, যার দরুন তার মাথাব্যথা হতো। তাই তিনি পুরো শহরের রংই বদলে ফেলেন!
নায়হাভান, ডেনমার্ক
ড্যানিশ রাজধানী কোপেনহেগেনের নায়হাভান পৃথিবীর অন্যতম চিত্তাকর্ষক ট্যুরিস্ট স্পট। কারণ একটাই, এর বর্ণময় বাড়িঘর। পোতাশ্রয়ের নিকট অবস্থিত এই শহরের আরো একটি বড় আকর্ষণ হচ্ছে এর ঐতিহ্য। এখানকার প্রায় ৮০ ভাগ বাড়িই ১৭ শতকে নির্মিত, যেগুলোর অধিকাংশ আবার এখন রেস্টুরেন্ট বা গেস্ট হাউজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বুরানো, ইতালি
লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, কমলা, আসমানি…… ভেনিসের বুরানো শহরের যেকোনো গলি ধরে হাঁটা শুরু করলে এভাবেই বিভিন্ন রঙের নাম আওরাতে থাকবেন একে একে! ছোট্ট এই শহরটির আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে মৎস্য শিকার। তবে আজকাল এর রঙিন সৌন্দর্যের কথা চাউর হয়েছে পর্যটকদের জগতেও। তাই পর্যটন শিল্পটাও জমে উঠছে বেশ।
শেফসাউয়েন, মরক্কো
কষ্টের রং নীল, বেদনার রং নীল? মরক্কোর শেফসাউয়েন শহরে ঘুরে আসবার পর ব্যাপারটি দাঁড়াবে, “শান্তির রং নীল, সৌন্দর্যের রং নীল!” হ্যাঁ, এই শহরের নীলাভ সৌন্দর্য এক মনোহারিণী মায়াময় সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে রেখেছে, যা স্বচক্ষে না দেখলে বোঝা যাবে না। এত নীল একসাথে আর কোথায় দেখা যাবে? আকাশের নীল যেন এই শহরের নীলেরই প্রতিফলন!
গ্যামশেয়ন, দক্ষিণ কোরিয়া
দক্ষিণ কোরিয়া এমনিতেই একটি সুশোভন, সুসজ্জিত দেশ। পর্যটকদের আকর্ষণ করবার মতো বহু স্থানই রয়েছে সেখানে। কিন্তু বাকেট লিস্টে যোগ করার মতো অভিজ্ঞতা চাইলে অবশ্যই যেতে হবে বুসানের গ্যামশেয়ন গ্রামে। পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত রঙিন এই গ্রামটি নিঃসন্দেহে কোরিয়ার সবচেয়ে সুন্দর স্থানগুলোর একটি।
কার্টাজেনা, কলম্বিয়া
‘জুয়েল অব কলম্বিয়া’ নামে পরিচিত কার্টাজেনা শহরটি পর্যটনের জন্য একটি পরিপূর্ণ শহর। মন মাতানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে শুরু করে বিশাল সমুদ্র সৈকত, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর সুস্বাদু সামুদ্রিক খাবার, ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আর কী চাই এ শহরে ভ্রমণের জন্য? আর শহরের অলিতে গলিতে রঙের বিস্ফোরণে নতুনত্ব যোগ করেছে প্রতিটি বাড়ির দেয়াল থেকে উঁকি দেয়া গাছগুলো। এ রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে ভ্রমণ করতে পারেন এই শহরে।
সান্তোরিনি, গ্রিস
গ্রিসের এই ছোট্ট দ্বীপ শহরটি এক পলক দেখলেই যে কারো মনে পবিত্র অনুভূতির সৃষ্টি হবে। শরতের আকাশ দেখেছেন নিশ্চয়ই। স্বচ্ছ নীল আকাশের মাঝে ভেসে বেড়ায় টুকরো সাদা মেঘ। গ্রিসের সান্তোরিনি দ্বীপটি দক্ষিণ অ্যাজিয়ান সাগর নামক এক নীলাকাশের মাঝে এক টুকরো মেঘ!
নটিং হিল, ইংল্যান্ড
বিশ্বের নানা প্রান্তের ঝকঝকে তকতকে সব শহরের আলোচনা হচ্ছে আর ইংল্যান্ডের কোনো শহরের নাম থাকবে না সে তালিকায়, তা অসম্ভব। রংহীন নিরস এক শহর হিসেবে কুখ্যাতি আছে লন্ডনের, বৃষ্টি আর বিষণ্ণতাই যেখানকার নিত্যকার চিত্র। কিন্তু, লন্ডনের মাঝে এক টুকরো প্রাণ যেন এই নটিং হিল শহর, যেখানকার সৌন্দর্যে আবহাওয়ার কোনো প্রভাব থাকে না।
সিংক টেরি
বিস্তৃত উঁচু পাহাড়ের ঢালে রঙের কারুকাজ দেখেছেন কখনো? না দেখে থাকলে যেতে হবে ইতালির সিংক টেরিতে। শত শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এক গুচ্ছ সমুদ্র উপকূলবর্তী গ্রামকে একত্রে বলা সিংক টেরি। ভূমধ্যসাগরের তীর অবস্থিত এ গ্রামগুলো দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। উঁচু পাহাড়ের ঢালে, রংধনুর সাত রঙে রাঙা বাড়িগুলো একে একে নীচে নেমে এসেছে এমনভাবে, যে পাহাড়ে কেউ ছবি এঁকেছে বলে মনে হয়।
ব্রাইটন সমুদ্র সৈকত, অস্ট্রেলিয়া
ভাবছেন, সমুদ্র সৈকতে আবার শহর আসলো কোত্থেকে? অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অবস্থিত সুদীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ব্রাইটন প্রতি বছর লাখো পর্যটকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। এর কারণ যতটা না দিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র, তার চেয়ে বেশি এর উপকূলজুড়ে বিস্তৃত বাহারি রঙের ‘বেদিং বক্স’ তথা ছোট ছোট স্নান-কামরাগুলো। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে একটানা কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই সারি সারি বক্স দেখতে যে কারো ভালো লাগবে।
প্যারাডাইজ আইল্যান্ড, বাহামা
বাহামার ছোট দ্বীপ শহর প্যারাডাইজ আইল্যান্ডের স্থানীয় অধিবাসীদের বাড়ি ঘর রঙিন সে ১৭ শতকের মাঝামাঝি থেকেই। এখানকার লোকজন সবকিছু ছাড় দিতে রাজি আছে, তবে বাড়ির রঙের ক্ষেত্রে কোনোরকম কার্পণ্য করতে তারা নারাজ। সেজন্যই ছোট এই শহরের অবকাঠামোগত সৌন্দর্য চোখে পড়ার মতো।
গামলা স্ট্যান, স্টকহোম
সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের গামলা স্ট্যান শহরটি সে দেশের সবচেয়ে পুরাতন শহরগুলোর একটি। ১৩ শতকে স্থাপিত এই শহরের মূল আকর্ষণই হচ্ছে এর ঐতিহ্যবাহী বয়সী বাড়িগুলো। কোপেনহেগেনের মতো এখানকার অধিকাংশ বাড়িগুলোই তৈরি হয়েছিল ১৭-১৮ শতকের মাঝে।
বারানকো, পেরু
পেরুর রাজধানী লিমায় অবস্থিত বারানকো শহরটি ঠিক যে ডিজনির কোনো অ্যানিমেটেড সিনেমার চোখ ধাঁধানো গ্রাফিক্স সম্বলিত একটি শহর! এর প্রধান রং দুটি। একটি হচ্ছে সবুজ, আর অন্যটি বাকি সব রঙের সমাহার। নগরপরিকল্পনার এক চমৎকার উদাহরণ এই শহরের রঙিন বাড়িঘরের মাঝে সবুজের সমারোহও চোখে পড়ার মতোই।
পাতাইয়া, থাইল্যান্ড
বাংলাদেশের বিক্রমপুর অঞ্চলের বাড়িঘরের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেগুলো পিলারের উপরে নির্মিত। টিনের ছাউনি বিশিষ্ট দোতলা বাড়িগুলোও তৈরি হয় কাঠ দিয়ে, যা দেখতেও চমৎকার। থাইল্যান্ড উপসাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত পাতাইয়া শহর দেখলে হঠাৎ করে বিক্রমপুরের কথাই মনে পড়ে যাবে। তবে ঘোর ভাঙবে এখানকার বাড়িগুলোর রঙের ছড়াছড়ি দেখে।
পুয়ের্তো ভ্যালার্তা, মেক্সিকো
শৈশবে রংপেন্সিলে বাড়িঘর আঁকার রঙিন স্মৃতি তাজা হবে এই শহরে ভ্রমণ করলে। ছোট ছোট বাড়ির, ছোট ছোট দরজা জানালা, যেগুলোর প্রত্যেকটির রং ভিন্ন ভিন্ন। ঠিক যে হাতে আঁকা সেই রঙিন বাড়িগুলোর মতোই।
রোক্লো, পোল্যান্ড
দিনের বেলা মনে হবে, ওয়েজ এন্ডারসনের হলিউড সিনেমা ‘গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল’ ছবির কোনো এক বর্ণময় দৃশ্য, রাতে মনে হবে এটি যেন একটি রাজপ্রাসাদের শহর। পোল্যান্ডের পর্যটক আকর্ষী রঙিন শহর রোক্লোর ছবি এভাবেই পরিবর্তিত হয়ে যায় দিনে রাতে।
গুয়ানাজুয়াত, মেক্সিকো
মেক্সিকোর কেন্দ্রে অবস্থিত গুয়ানাজুয়াত শহর এর ঔপনিবেশিক স্থাপত্যকলা এবং রূপার খনির জন্য বিখ্যাত। তবে শহরের অলিগলিতে রঙের খেলা দেখতে এখন পর্যটকদের কাছেও পরিচিত হয়ে উঠেছে এই শহর। স্প্যানিশ শব্দ ‘গুয়ানাজুয়াত’ এর অর্থ অচ্ছে ব্যাঙের শহর। এ শহরের এরূপ নামকরণের কারণ হচ্ছে এর ঘন সন্নিবিষ্ট বাড়িঘর। একটি বাড়ির সাথে আরেকটি বাড়ির বারান্দা এতটাই নিকটে থাকে যে, অনায়াসে বারান্দা ধরে কোনো রাস্তার শেষ মাথায় চলে যাওয়া যাবে।
জয়পুর, ভারত
ভারতের রাজস্থান প্রদেশের রাজধানী শহর জয়পুর পর্যটকদের জন্য একটি দর্শনীয় স্থান। এমনিতেই নানা জাতি আর বর্ণের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ভারত ভ্রমণপিয়াসীদের পছন্দের তালিকার উপরের দিকে থাকে। তার মধ্যে রাজস্থানের ব্যাপারটাই আলাদা। মধ্যযুগীর রাজবংশীয় অনেক প্রাসাদের দেখা মিলবে এ শহরে। আর এখানকার স্থাপনাগুলোর চমৎকার রঙের জন্য এই শহরকে ‘পিংক সিটি’ বলেও ডাকা হয়।
নিউফাউন্ডল্যান্ড, কানাড
আরো একটি পাহাড়ের ঢালের শহর, আরো একটি রঙিন স্বর্গ! কানাডার পূর্বে আটলান্টিক সমুদ্রের উপকূলে অবস্থিত এই শহরটি ‘প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম’ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এটি পৃথিবীর হাতেগোনা কিছু শহরের একটি, যেখানকার অবকাঠামোগত সৌন্দর্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোনোরূপ ক্ষতিসাধন না করে, উভয়ে মিলে শহরকে সুন্দর করেছে। তাছাড়া এখানকার সব কিছুই তুলনামূলকভাবে সস্তা হওয়ায় পর্যটকদের জন্যও এটি সোনায় সোহাগা।
হাভানা, কিউবা
ক্যাথেড্রাল ডি ক্যাস্ট্রোবাল, প্লাজা ভিয়েজা, ক্যাস্টিলো ডি লা ফুয়ের্জা সহ অসংখ্য মধ্যযুগীয় স্থাপনায় সমৃদ্ধ একটি শহর কিউবার রাজধানী হাভানা। এখানকার রঙিন সেকেলে ভবনগুলো স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের স্থাপত্যকলার কথাই মনে করিয়ে দেয় বারবার।
ফিচার ছবি: intrawallpaper.com