আমেরিকার একজন বিখ্যাত সাংবাদিক বলেছেন, “আরামে ও ধীরেসুস্থে সকালের খাবার খাওয়ার মধ্যেই সব সুখ আছে”। পুষ্টিবিদদের মতে, সকালের খাবার খাওয়া আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। তুরস্কের রেস্টুরেন্টগুলো সবাইকে নিয়মিত ব্রেকফাস্ট করার জন্য উৎসাহিত করে এবং তা অবশ্যই পুষ্টিকর খাবার দিয়ে। সমগ্র তুরস্কের জনগণের মধ্যেই সকালের খাবার নিয়ে ভোজনবিলাসী ভাব ও আকর্ষণের কোনো অভাব নেই। আর এই তুরস্কেই এমন এক শহর রয়েছে যেখানে ‘ব্রেকফাস্ট’ এর বিষয়টা একটু বেশিই গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়। বলছি, তুরস্কের শহর ‘ভ্যান’ এর কথা।
ইরান থেকে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত তুরস্কের শহর ভ্যান, যা দেখলে মনে হবে সীমান্তে অবস্থিত কোনো এলাকা। এখানে প্রায় ১০ লাখ মানুষের বসবাস এবং এর অধিকাংশই কুর্দি। তুরস্কে ভ্যান এবং সকালের খাবার অনেকটা প্রতিশব্দের মতো। একটা ছাড়া আরেকটার মনে হয় কোনো গুরুত্বই নেই। ভ্যানের সকালের খাবার বা ‘কাহভাল্টি’ তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও রন্ধনশিল্পের বর্ণনা দেয়। ‘কাহভাল্টি’ একটি তুর্কি শব্দ। যার মানে সকালের কফি বা চা পান করার আগে খাবার খাওয়া। ভ্যানের মতো অনন্য এক ব্রেকফাস্টের স্বাদ আংকারা এবং ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টেও পেতে পারেন। তুরস্কের এই ভিন্নধর্মী সকালের খাবারের আয়োজন মূলত পরিচিতি লাভ করে ২০১৪ সালে, যখন ভ্যানবাসী ও পর্যটক মিলে মোট ৫০,০০০ জন একসাথে সকালের খাবার খাওয়ার বিশ্বরেকর্ড গড়ে তোলে।
‘তুরস্কের ব্রেকফাস্ট’ মানেই এতে থাকবে প্রচুর পরিমাণে পনির, জলপাই, ডিম, সসেজ, জেলি এবং সবশেষে কয়েক কাপ চা, বিশেষ করে ব্ল্যাক টি। এগুলো দেশটির জনগণের কাছে সুস্বাদু খাবার তৈরির কিছু মূল উপকরণ। এবার জেনে নেওয়া যাক কোন কোন উপাদান দিয়ে তৈরি হয় এই ‘কাহভাল্টি’।
কাহভাল্টির শুরুটা হয় কিছু হালকা ও টাটকা ফুড আইটেম দিয়ে। এর জন্য আপনার সামনে পরিবেশন করা হবে ‘ডোমাটস অ্যান্ড সালাতালিক’ (শসা ও টমেটোর সালাদ), ‘জেয়টিন’ (জলপাই), ‘রেসেল’ (ফলের জ্যাম) এবং আরও কিছু ফল ও সবজি।
পনিরের তৈরী একটি বিশেষ ডিশ ‘বেয়াজ পেয়নির’-ও থাকবে আপনার সামনে। বেয়াজ পেয়নিরের আরেক নাম ‘ওটলু পেয়নির’। এই ডিশে ব্যবহৃত ভেড়ার দুধের তৈরী পনিরের স্বাদ অনেকটা ‘গ্রিক ফেটা‘ এর মত। তবে এই পেয়নিরের পনির আরও বেশি ঘন ও নরম হয়। আর এর সাথে সিরমা ছাড়াও পুদিনা পাতা, থাইম, গার্লিক শুটস, বন্য ফেনেল ও এধরনের মোট ২০টি বন্য ঔষধি গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়। পনির ও ঔষধি গাছের সমন্বয়ে তৈরী এই খাদ্য একজন ব্যক্তির পাচন শক্তি বৃদ্ধিতে ও তার রক্তকে জীবাণুমুক্ত করে পরিশুদ্ধ করতে সহায়তা করে। এর সাথে থাকে ‘বাল কায়মাক’ যা আসলে মধু ও ক্রিমের মিশ্রণ। ‘গ্রিলড সুজুক’ বা ‘তার্কিশ চোরিজো’-ও এর সাথে থাকে, তবে এখানে শুয়োরের মাংস ব্যবহার করা হয় না। বেয়াজ পেয়নিরে ব্যবহৃত স্থানীয়ভাবে পরিচিত এই সিরমা আসলে বন্য রসুন। সিরমা নামক এই ঔষধি শহরটির কাছেই অবস্থিত পাহাড়ি এলাকা থেকে আসে। আর এই খাবারে ব্যবহৃত পনির ভ্যান শহরের পাশের জেলা ওজাল্প থেকে আনা হয়। অন্যান্য খাবারও কোনো না কোনোভাবে ভ্যান ও তার আশেপাশের শহরের কোনো না কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করে। এছাড়া ‘কাসেরি’ ও ‘আইওর’ রয়েছে। কাসেরি হলো ভেড়ার দুধের তৈরী শক্ত পনির এবং আইওর ছাগলের দুধ দিয়ে বানানো কটেজ পনির। আপনি যদি এত রকমের পনিরের তৈরী মুখরোচক খাবারের স্বাদ নিতে চান, তাহলে আপনাকে এর মূল ঘাঁটি তথা ভ্যান শহরেই যেতে হবে।
এত ধরনের সবজি, ফলের জ্যাম ও পনিরের খাবার খাওয়ার জন্য রুটি বা পাউরুটির মতো কিছু তো লাগেই। আর এর জন্য কাহভাল্টির মধ্যে রয়েছে ‘সিমিট’। তিল ও বিভিন্ন বীজ ব্যবহারে বানানো হয় এসকল পাউরুটি ও ব্যাগেল। তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী ‘পিডে’ রুটিও এই কাহভাল্টির অন্তর্ভুক্ত। আর এসকল রুটি অনেক কম মূল্যেই পাওয়া যায় ভ্যান ও তুরস্কের অন্যান্য শহরে।
আপনি কাহভাল্টির ‘মুর্চুগা’ নামক খাবারটির স্বাদের সাথে প্যানকেকের কিছুটা মিল পাবেন। এর মূল উপাদান মাখন, আটা ও ডিম। আর মুর্চুগা পরিবেশন করা হয় মধু ও ফলের জ্যাম দিয়ে। দেখতে কোনো অংশেই প্যানকেকের মতো মনে না হলেও স্বাদে এর মিল আছে। ডিমের তৈরী দুটি প্রধান ডিশও পাবেন এই ব্রেকফাস্টে। একটি ডিশে ডিম ভাজার সাথে সুজুক বা ক্যাভুরমা (অল্প আঁচে ভাজা ভেড়ার বা গরুর মাংস) এবং পনির দেওয়া হয়। একে ‘সাকাকলু ইয়ামার্টা’ বলে। আরেকটি ডিশ হল- ‘মেনেমেন’। এটি ডিমের সাথে টমেটো, পেঁয়াজ, ক্যাপসিকাম ও পনির মিশিয়ে তৈরী হয়। ভ্যান ব্রেকফাস্ট রেস্টুরেন্টগুলোতে একটি খাবারের জন্য প্রায়ই বিভিন্ন অফার দেওয়া হয়, যার নাম ‘ক্যাভুট’। গমের আটা দিয়ে বানানো হয় এই ক্যাভুট। তুরস্কে এর চাহিদা অনেক।
এছাড়া ভ্যানের রেস্টুরেন্টগুলোর খাবারে অনন্য স্বাদের জন্য ব্যবহার করা হয় কারাকোভান মধু ও দুধের ক্রিম। মালবেরি গাছের ৩০ সেন্টিমিটার ভিতরে ১২০০ প্রজাতির ফুলের মধু সংগ্রহ করে ককেশিয়াস মৌমাছিরা এই কারাকোভান মধু তৈরি করে। এই মধু গাছের ভেতর অন্ধকারে প্রায় ছয় মাস থাকে। এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- এটি মানুষের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই উৎপাদিত হয়।
কাহভাল্টের শেষে আপনার সামনে পরিবেশন করা হবে চা। কোনোপ্রকার অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় তো দূরের কথা, এক কাপ কফিও পাওয়া যাবে না এই কাহভাল্টের সাথে। চায়ের ক্ষেত্রে ব্ল্যাক টি অথবা কোনো প্রকার হার্বাল চা-ই আপনি পাবেন।
তুরস্কের এরকম ব্যতিক্রমধর্মী খাদ্য সংস্কৃতির জন্য কিছু কবি ও লেখক সাহিত্যও রচনা করে ফেলেছেন। বিখ্যাত তুর্কি কবি জেমাল সুরেয়া তার কবিতার দুই লাইনে বলেন, “আমি জানিনা, আপনি খাবার সম্পর্কে কী ভাবেন। তবে সুখ ও তৃপ্তির সাথে অবশ্যই সকালের খাবারের কোনো সম্পর্ক আছে।” তার বক্তব্য অনুসারে, এই সকালের খাবার তার নিকট সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আহার। বিশেষ করে যখন টেবিল ভর্তি মানুষজন থাকে এবং কথা বলার হাজারটা সুযোগ থাকে। তুরস্কের রেস্টুরেন্টগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের ও প্রকৃতির ভোজের ব্যবস্থা থাকে। তুরস্কে অনেকেই দলে দলে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে যান, বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে। আর বিষয়টা তাদের জন্য এখন শুধু সামাজিক আচারই নয়, বরং জীবন উপভোগ করার এক অসাধারণ ও অনন্য কায়দাও হয়ে দাড়িয়েছে।
সকালের খাবারটা তৃপ্তি সহকারে খেতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে ভ্যানের কোনো রেস্টুরেন্টে বা ভ্যানের কোনো ব্রাঞ্চে। কেননা, ভ্যানবাসী এই কাজে সবচাইতে বেশি পারদর্শী। বহু বছরের প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে মুখরোচক খাদ্য তৈরির জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাই তাদেরকে পরিচিত করে তুলেছে। ভ্যান ছাড়া ইস্তাম্বুল শহরেও আপনি এধরনের খাবার পরিবেশনকারী বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট পাবেন। যেমন- অলিভ আনাটোলিয়ান রেস্টুরেন্ট, কুন পেত্রো, রেইনবো ক্যাফেতে যেতে পারেন। আসলে ইস্তাম্বুল শহরটি বেশি পরিচিত হওয়ায় পর্যটকরা সেখানেই বেশি যান। ভ্যানের এই সকালের খাবারের জন্য আপনাকে খরচ করতে হবে মাত্র ২৫ লিরা অর্থাৎ প্রায় ৩৭০ টাকা। কিছু কিছু খাবারের দাম এর থেকে একটু বেশি বা কমও হতে পারে। এবার এই পরিমাণ টাকায় আপনি কী কী খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন তা সম্পর্কে একটু জেনে নিন, তাহলেই হবে!