সময়টা ২০১৮ সালের জুলাই মাস। গল্পের শুরুটা নাফাখুম অথবা অমিয়াখুম অভিযান হলেও হতে পারতো। কিন্তু ঈদের প্রায় একমাস আগে থেকে অমিয়াখুমের প্ল্যান হয়ে যাওয়ার পর শেষ মুহূর্তে পরিস্থিতির কারণে পরিবর্তন হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। সাংগু নদীর পানি বাড়ায় বন্যার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় শেষ মুহূর্তে তিনাপ সাইতার বা পাইন্দু সাইতার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ট্যুরের দু’দিন আগে এমন সিদ্ধান্ত মানসিকভাবে সবাইকে একটু ভীত করে তোলে।
১৭ জনের টিম। গন্তব্য বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ও প্রশস্ততম ঝর্ণা তিনাপ সাইতার। পাইন্দু খালের পানি থেকে এর উৎপত্তি বিধায় এর নাম স্থানীয়দের কাছে পাইন্দু সাইতার নামেও পরিচিত। ১৭ তারিখ বা ঈদের পরদিন রাতে ঢাকা থেকে বাসে করে রওনা দিলাম। সকাল ৭.৩০ এ বাস যখন বান্দরবান পৌঁছায়, তখন সূর্য মামা আকাশে তার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। সকালে নাস্তা করে চাঁদের গাড়ি করে রওনা দিলাম বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার উদ্দেশ্যে। সকাল ১১টার মধ্যে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে রোয়াংছড়িতে পৌঁছে গেলাম।
সেখানে গাইড আমাদের অপেক্ষা করছিল। গাইড আগে থেকেই চাঁদের গাড়ি ঠিক করে রেখেছিল, যদিও আমরা ভেবেছিলাম পুরোটাই ট্রেকিং করবো। কিন্তু একটু যাওয়ার পর দেখলাম যে, কোনো রাস্তাই নেই, সবটাই পাহাড়ি খাদ আর ভাঙাচোরা পথ। সেখানে হাঁটাই কষ্ট, গাড়ি যাবার প্রশ্নই ওঠে না। যা-ই হোক, কিছু পথ নেমে হেঁটে, আর কিছু পথ গাড়িতে পেরোলাম। রোয়াংছড়ি বাজার থেকে খেমতাং পাড়া পর্যন্ত পৌঁছালাম।
কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর সবাই আবার হাঁটা ধরলাম। অনেক হাঁটার পর কেপলাং পাড়ায় পৌঁছালাম। মাঝে এক ঝিরির পানিতে এক চোট গোসল সেরে নিলাম। কেপলাং পাড়ায় কিছু খাওয়াদাওয়া করে হাঁটা শুরু হলো, গন্তব্য এখন পাইক্ষ্যং পাড়া। অনেকক্ষণ পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উঠার পর পাইক্ষ্যং পাড়ায় গিয়ে পৌঁছালাম। কিয়াম দিদির দোকানে সেদ্ধ ডিম খেয়ে হালকা বিশ্রামপর্ব। তখন বিকেল প্রায়। সবাই ক্লান্ত।
কিন্তু তা-ই বলে তো আর থেমে থাকা যায় না। সন্ধ্যার আগে যেভাবেই হোক রনিন পাড়া পৌঁছাতে হবে। হাঁটা শুরু করলাম আবার। একটু হাঁটার পরই পাশে তাকালাম। দূরে টেবিল পাহাড় দেখা যায়। অসম্ভব সুন্দর সেই পাহাড় দেখতে দেখতে এগোতে থাকলাম। কিন্তু এ যে ছোট টেবিল পাহাড়। একটু দূরে বিশাল এক টেবিল পাহাড়ের দেখা।
কিছুক্ষণ পর যাত্রী ছাউনিতে গেলাম। সেখান থেকে ডানে দেখা যাচ্ছে টেবিল পাহাড় আর বাঁয়ে সিপ্পি পাহাড়। একটু নিচে খেয়াল করলাম রনিন পাড়া দেখা যায়। সবাই হাঁটা শুরু করলাম খাড়া পাহাড় বেয়ে নেমে। রনিন পাড়া আর্মি ক্যাম্পের সামনে বিশ্রাম নিয়ে নাম এন্ট্রি করালাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ৩০ মিনিটের মতো হেঁটে পৌছে গেলাম রনিন পাড়ায়। সেখানে জেমসন দাদার কটেজে রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সবাই ক্লান্ত ব্যাগ ছেড়ে যে যার মতো শুয়ে পড়লাম। কিন্তু গোসল যে করতে হয়!
গাইড বললো, সামনে এক ঝিরি আছে, গেলে নিয়ে যাবে। কয়েকজন গেলাম। তখনও বুঝতে পারিনি এত রাতে কোথায় যাচ্ছি। হাঁটছি তো হাঁটছি। বেশখানিক হাঁটার পর ঝিরি পাওয়া গেল। ঝিরির পানিতে ইচ্ছামতো গোসল করে কটেজে চলে গেলাম। এখানে কটেজ বলতে পাহাড়ি আদিবাসীদের ঘরকে বোঝানো হচ্ছে। তারপর খাওয়াদাওয়া করে সেই রাতের মতো সবাই দিলাম ঘুম। সারাদিনের ক্লান্তি, তার উপর পর দিন তিনাপ সাইতারের বিশাল পথ। সবাই সময় নষ্ট না করে ঘুমিয়ে গেলাম।
পরদিন খুব ভোরে উঠে গেলাম। আকাশে সূর্য তখন হালকা উঁকি দিচ্ছে। অনেকেই ঘুমে মগ্ন। আমি আর এক বন্ধু এই ফাঁকে রনিন পাড়া পুরোটা ঘুরে এলাম। পাহাড়িরা খুব ভোরে জুমচাষ করতে চলে যায়। পাড়া নীরব। আমরা ঘুরে কটেজে ফিরে দেখি সবাই উঠে গেছে। সকালের নাস্তা করে সবাই রওনা দিলাম। গন্তব্য আজ তিনাপ সাইতার। সবাই হাঁটছি আর হাঁটছি। একটু পর এসে পড়লাম দেবছড়া পাড়ায়। সেখানে সুস্বাদু আনারস খেলাম। খানিক জিরিয়ে সবাই আবার হাঁটা শুরু করলাম। সে পথের আর শেষ নেই। কত যে পাহাড় উঠলাম আর নামলাম, বলতে পারি না। অনেকক্ষণ হেঁটে ঝিরি পেয়ে গেলাম। সবার মুখে হাসি, যাক পাহাড় তো বাইতে হবে না। ঝিরিতে হাঁটছি, ছবি তুলছি। কখন যে ঝিরি শেষ হয়ে আবার পাহাড়ে উঠে গেলাম বুঝতেই পারলাম না।
একটু পরে পাইন্দু খালের দেখা পেলাম। যত দূর জানতাম- পাইন্দু খালের পাশ বেয়ে হেটে তিনাপে যেতে হয়। কিন্তু গাইড আমাদের পাহাড় দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টিতে কষ্ট আরো দ্বিগুণ করে দিল। এর মধ্যে একজন ‘জোঁক’ বলে চিৎকার করে উঠলো। সবার মনে জোঁকের ভয় ঢুকে গেল। সবাই হাতে-পায়ে পেটে মবিল মাখতে থাকলাম। এরপর কিছু দূর গিয়ে দেখি দুই পাহাড়ের মাঝে ধ্বস নেমেছে। অনেক কষ্টে সে পাহাড় পার করলাম। কিন্তু একটু এগিয়ে দেখি রাস্তা ভুল।
গাইডকে বকা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলছিলাম। আবার ফিরলাম। বৃষ্টিতে সেই পিচ্ছিল পাহাড় নামা খুবই কষ্টকর ছিল। তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আবার সেই ভাঙা পাহাড় পার হলাম। এরপর পাইন্দু খালের পার বেয়ে হাঁটা ধরলাম। অন্য সব টিম তখন ব্যাক করছে আর আমরা মাত্র যাচ্ছি। কখনও পাহাড়ের কিনার, কখনো খাল ধরে এগোতে এগোতে দূর থেকে তার দেখা পেলাম।
নিজের বিশালতার পরিচয় দিয়ে বিশাল গর্জন দিয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে তিনাপ। দূর থেকে একপলকে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম! আর অপেক্ষা নয়, সাথে সাথে তার পানির নিচে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ থেকে আবার ফিরে এলাম। যাওয়ায় সময় বারবার তার বিশালতায় মুগ্ধ হচ্ছিলাম। তারপর আবার সেই পাহাড় বেয়ে চলা। শরীরে শক্তি নেই বললেই চলে। অনেকেই পাথরে পিছলে যাচ্ছিল। কোনোমতে দেবছড়া পাড়ায় গিয়ে পৌঁছালাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা হবে হবে। সেখানে সাথে করে নিয়ে যাওয়া নুডলস রান্না করা হলো। তার স্বাদ তখন অমৃতের থেকে বেশি ভালো লাগছিল। খাওয়ার মাঝে বড় ভাইয়েরা ঠিক করলো যে খাসী কিনবে এবং রাতে তার বারবিকিউ করবে। কিন্তু যা দাম শুনলাম, তাতে আর ইচ্ছে রইলো না। কিন্তু ঠিকই দুটি মুরগী কিনে নিলাম। পাহাড়ি মোরগ দুটো দেখেই সবার মধ্যে অন্য এক ভালোলাগা কাজ শুরু হলো।
যা-ই হোক, রাত হয়ে গেছে রনিন পাড়ায় পৌঁছাতে হবে। সবাই মোবাইল অথবা টর্চের আলোয় এগোতে থাকলাম। রাতের বেলায় ট্রেকিং অন্যরকম এক উপভোগ্যতা বিলোয়। সবাই লাইন বেয়ে এগোতে থাকলাম। সবার শেষে গাইড। হাতে তার মোরগ দুটি। অনেকক্ষণ হাঁটার পর পাড়ায় এসে পৌঁছালাম। এসে সবাই শরীরে জোঁক আছে কি না দেখলাম। কয়েকজনের শরীরে জোঁক পাওয়া গেল।
আজ আকাশে মেঘ নেই। পুরো আকাশ লক্ষ লক্ষ তারায় ভরা। সে রাত ভুলবার নয়। হাজার বছর পুরনো সে রাত।
সে রাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, আর আশেপাশে ঝর্ণা দেখবো না, পরদিন পাইক্ষ্যং পাড়ায় চলে গিয়ে সেখানেই রাত কাটাবো। তার পাওনা পরিশোধ করে পাইক্ষ্যং পাড়ার উদ্দেশে হাঁটা দিলাম। সেদিনের কেনা মুরগী বারবিকিউ হলো না। ওই দুটোকে সাথে নিয়েই পাইক্ষ্যং পাড়ায় রওনা দিলাম। এর মধ্যে সবাই এসে পড়লো। একজন কাঁঠাল কিনে আনলো। ক্ষুধার্ত পেটে সবাই কাঁঠাল খাওয়া শুরু করলাম। পাড়ার এলরাও দাদার কটেজে থাকতে হবে। আর কোথাও থাকার জায়গা নেই। দাদার স্ত্রী কিয়াম দিদির সাথে যাওয়ার দিনই খাতির হয়েছিল। আজ আরো জম্পেশ আড্ডা জমলো। আকাশ তখন মেঘলা, বিকেল প্রায়, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ভালোই আড্ডা জমছিল।
পরদিন সকালে খাবার খেয়ে কেপলাং পাড়ার উদ্দেশে রওনা দিলাম। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম কেপলাং পাড়া হয়ে বোটে করে রোয়াংছড়ি যাবো। বোটে করে এগোতে থাকলাম। চারপাশে পাহাড় জুম ক্ষেত আর পাহাড়ি বাড়ি পেরিয়ে আমাদের বোট এগোচ্ছে। অবাক হয়ে আমরা প্রকৃতির সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করছি। কখন যে রোয়াংছড়ি বাজার পৌঁছে গেলাম, টেরই পেলাম না। গাইডকে বিদায় দিয়ে চাঁদের গাড়ি করে সবাই মিলে বৃষ্টির মধ্যে গান গাইতে গাইতে বান্দরবন শহরে পৌঁছে গেলাম বেলা চারটায়। আসার দিন গাড়ি থেকে নেমেই টিকেট কেটে রেখেছিলাম যাওয়ার। রাত ন’টায় বাস। সবাই খেয়ে সাংগু নদীর পাড়ে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় বান্দরবন বাজার ঘুরলাম। কেউ কেউ কেনাকাটা করলাম। এরপর রাতে খেয়ে বাসে উঠে কখন যে ঢাকা পৌঁছে গেলাম টেরই পেলাম না।
শেষ হয়ে গেল অনেক কিছু পাওয়ার এক ট্যুরের। শেষ হলো তিনাপ সাইতার অভিযানের।