অরণ্য যেখানে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ, যেখানে প্রাণীরা শেখায় জীবনের অন্য মানে, যেখানে ভয়ঙ্কর আর সুন্দর হাত ধরাধরি করে হেঁটে যায় অনন্তের দিকে, তারই নাম পিলানেসবার্গ। বন্যপ্রাণীদের একটা নিজস্ব ছন্দময় জগৎ রয়েছে, যা এই পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের চেয়ে ভিন্ন। পিলানেসবার্গ ন্যাশনাল পার্ক ঠিক তেমনি এক জগৎ।
বিধাতার আপন তুলিতে আঁকা এক অনন্য নৈসর্গিক ছবি যা শুধু দু’চোখ মেলে দেখাই নয়, মন দিয়ে অনুভবও করা যায়। প্রকৃতির এমন নান্দনিক রূপ-সৌন্দর্য দেখতে হলে যেতে হবে পিলানেসবার্গ জঙ্গলে। সৌন্দর্য আর আতঙ্কের এমন সংমিশ্রণে তৈরি এই জঙ্গল সত্যিকার অর্থেই ভয়ঙ্কর সুন্দর!
ভূমি থেকে সাতশো মিটার উঁচুতে অবস্থিত দক্ষিণ আফ্রিকার পিলানেসবার্গের এই জঙ্গল। হাজারো পশু-পাখি ও নাম জানা-অজানা প্রাণীদের বিচরণক্ষেত্র জঙ্গলটি। চারদিকে ধূসর ও সবুজের সমারোহ। পাথরের বুক চিরে নানান প্রজাতির গাছ। যত দূর চোখ যায় পাহাড়গুলোকে দেখতে ঠিক যেন সাগরের ঢেউয়ের মতোই মনে হয়। এই ন্যাশনাল পার্ক দাক্ষিণ আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে অবস্থিত। জোহানেসবার্গ শহর থেকে প্রায় ২২০ কি.মি. দূরে এ অবস্থিত এ পার্কটি বিস্তৃত ৫০০ বর্গ কি.মি. জায়গা জুড়ে।
অরণ্যটিতে রয়েছে সাত হাজারেরও বেশি বন্যপ্রাণীর বসবাস। এর মধ্যে আছে ৩৫০ প্রজাতির পাখি, ৬৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১৩২ প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের গাছ। জঙ্গলের ভেতরে রয়েছে সুন্দর পিচ বাঁধানো পথ যা এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে একেবারে বনের গহীন পর্যন্ত। পার্কের চারপাশে ১০টি বাঁধ রয়েছে যা দিয়ে তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি সুদৃশ্য, নয়নাভিরাম জলাশয়।
হুড খোলা গাড়ি করে সেই পথ দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়বে, পথের দু’ধারের বিস্তীর্ণ ঘাসে ঢাকা প্রান্তর। সেই প্রান্তরে আপন মনে চরে বেড়াচ্ছে জেব্রা, হরিণ, বাইসন, গন্ডার, হাতি ও জিরাফের দল। বাঘ বা সিংহের দেখা পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। তবে তাদের সংখ্যা সময়ের সাথে সাথে কমে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত মানুষের ক্রুরতার শিকার হচ্ছে অভয়ারণ্যের বিরল প্রজাতির বিচিত্র সব পশু-পাখি। কোথাও কোথাও চোখে পড়বে মোষের পাল।
আফ্রিকার বুনো মোষ একটি সাংঘাতিক প্রাণী। জলহস্তী, সিংহ, চিতাবাঘ আর হাতির সাথে বুনো মোষও আছে আফ্রিকান অরণ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী পশুদের তালিকা ‘বিগ ফাইভ’ এ। পশুরাজ সিংহ কিংবা হায়েনার দল খুব একটা সাহস করে না বুনো মোষের কাছে ভিড়তে। তাগড়া সিংহকেও তাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই বুনো মোষ। দল বেঁধে চলে বলে শিকারী পশুরা খুব একটা এদের কাছে ভিড়ে না।
ভূ-তাত্ত্বিক সমীক্ষায় জানা যায় যে, কোটি কোটি বছর আগে একসময় এখানে ছিল জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। সেই সময় এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। আগ্নেয়গিরি থেকে বের হওয়া লাভা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। পরে সেই লাভা শীতল হয়ে সৃষ্টি হয় পাহাড়ঘেরা এই এলাকাটির। আঠারশো সালে এ এলাকায় বসবাস করতো ‘সোয়ানা’ নামক আদিবাসী জাতির লোকেরা। তাদের মূল পেশা ছিল চাষাবাদ আর পশু পালন। তখনকার সময়েই আদিবাসী জাতিগুলোর একজন শাসনকর্তা থাকত, যাকে বলা হত ‘পিলানে’। পরবর্তীতে তার নামানুসারে অঞ্চলটির নামকরণ করা হয় ‘পিলানেসবার্গ’।
আগেই বলেছি, বন্যপ্রাণী ছাড়াও এখানে রয়েছে সাড়ে তিনশো প্রজাতির পাখি এবং পঁয়ষট্টি প্রজাতির সরীসৃপ। সাথে রয়েছে অজস্র বনজ গাছগাছালি। এছাড়াও বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে রয়েছে নানা রং ও আকারের ঘাস।
এই ঘাসের পথ দিয়ে গাড়ি চলতে চলতে হয়তো চোখে পড়বে, দূরে কোথাও পড়ে রয়েছে রক্তাক্ত কোনো বাইসন বা হরিণ। এখনই হয়তো শিকারটিকে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে কোনো সিংহ বা হায়েনার দল। তাদের শিকারটি খাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করা, এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা, ঠিক যেন চলন্ত ন্যাশনাল জিওগ্রাফী চ্যানেল। এভাবে এগিয়ে গেলে পথের ধারে দেখা দেবে কোনো জলাশয়, তাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে জলহস্তির পাল।
একটু পরেই হয়তো জলাশয়ের পাশের গাছগুলিতে একে একে হাজির হবে হাজার হাজার নানা রঙ-বেরঙের পাখি। এসব মনোরম দৃশ্য একজন পর্যটককে আন্দোলিত না করে পারেই না। কত শত বিরল দৃশ্যের ছবি ধরে রাখেন অরণ্যে আসা পর্যটকগণ।
সন্ধ্যা নেমে আসার সময় হলে পাহাড়ের দিকে চোখ পড়লেই দেখতে পাবেন এক অপরূপ দৃশ্য। দুই পাহাড়ের মাঝে রক্তবর্ণ ধারণ করে অস্ত নিচ্ছেন সূর্যদেবতা। পাহাড় দু’টির মাথায় আবির রাঙা মেঘের গায়েও তখন ফুটে উঠে এক নান্দনিক সুশোভিত কারুকার্য। হয়তো তখন দূর থেকে মনে হবে, কোনো এক নিপুণ শিল্পীর তুলিতে আঁকা এক অপরূপ চিত্রকলা। একটু আঁধার নেমে আসতেই কালো মেঘের আস্তরণ ছড়িয়ে পড়তে থাকে অরণ্যের চতুর্দিকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ঠাণ্ডার প্রকোপ।
অনেক পর্যটক রাত্রিবেলাতেও বন দেখতে বের হন। পশুদের ‘নাইট-লাইফ’ বেশ রোমাঞ্চকর। বন্যপ্রাণী-প্রেমিকের কাছে পশু রাজ্যের রাত্রিকালীন দৃশ্য দেখার চাইতে উত্তেজক আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না। আফ্রিকায় নাইট-সাফারির বিরল অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ অনেক পর্যটকই নিয়ে থাকেন। অন্যান্য ন্যাশনাল পার্কের মতো পিলানেসবার্গেও এই বন্দোবস্ত রয়েছে।
সাধারণত নাইট সাফারি শুরু হয় বিকেল চারটে নাগাদ। বাহন হিসেবে থাকে একটা খোলা জিপ। সূর্যাস্তে কোনো একটা নদীর ধারে থেমে ড্রিংঙ্কস আর স্ন্যাক্স খেয়ে নেওয়া হয়। তার পরে রাত ৮টা পর্যন্ত সাফারি। রাতের বিভায় লেপার্ড (চিতাবাঘ) দর্শন সহজে ঘটে যেতে পারে। রাতের অন্ধকারে চিতা দেখার ভয় এবং আনন্দ মিশ্রিত এই অভিজ্ঞতা অনেকের কাছেই ভীষণ অন্যরকম।
পর্যটকদের জন্য গাইড এর সহযোগিতা এবং তাদের ব্যবহৃত গাড়ি থেকে প্রতিনিয়ত স্পটলাইট ফেলে রাতের নিশাচর প্রাণী দেখার অপার সুযোগ করে দেন গাইডরা। অরণ্যে রাত্রিবেলায় ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাতের ভয়ঙ্কর দৃশ্যাবলীর ছবি তুলতে না পারার জন্য হয়তো পর্যটক হিসেবে আপনার আফসোস হতেই পারে। তার পরিবর্তে ভিডিও তুলে রাখার অনুমতি রয়েছে এই রিজার্ভ ফরেস্টে।
রাতের আধো অন্ধকারে চিতাবাঘের জ্বলজ্বল চোখ দেখে ভয়ে শিহরিত হয়ে পড়তে পারেন আপনি। হয়তো চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই সে একটা বিরাট লাফ মেরে রাস্তা টপকে আফ্রিকার অরণ্যের বিখ্যাত ঝোপের আড়ালে হারিয়ে যাবে। চিতা আসলে এক লাজুক নিশাচর প্রাণী, একা থাকতে ভালবাসে। তাই সাধারণত এদের দেখা পাওয়া সত্যিই দুরূহ ব্যাপার।
এরকম এক অসামান্য প্রাকৃতিক পরিবেশে বন্যপ্রাণী দেখার দুর্লভ ইচ্ছে নিয়ে প্রতিবছরই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে লক্ষাধিক পর্যটক ঘুরতে আসেন এই পিলানেসবার্গে। এই পার্কে পর্যটকদের বাজেট ও চাহিদা অনুযায়ী ৯টি বিভিন্ন রকমের আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে।
অরণ্য ভালোবাসেন না এমন মানুষ পাওয়া খুবই বিরল। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা এসব অরণ্যে ভ্রমণ করা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তবে অরণ্যের এই অকৃত্রিম মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য উপভোগের জন্য পকেটে অর্থ থাকাও জরুরী। সামর্থ্য রয়েছে এমন কারো যদি প্রকৃতির নান্দনিক রূপ-লাবণ্য উপভোগের সময় ও ইচ্ছে থাকে, তাহলে ঘুরে আসতে পারেন সাউথ আফ্রিকার এই জঙ্গলে।