এক দেশের সাথে অন্য দেশের মধ্যকার দূরত্ব কমাতে, পণ্য পরিবহনে, দুগর্ম এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যোগাযোগের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত তৈরি করা হয় অভিনব সব ব্রিজ। আধুনিক যুগে রাস্তা থেকে রেলপথ, ব্রিজের ব্যবহার সর্বত্র। এই ব্রিজ তৈরিতে মানুষ শুধু প্রযুক্তির গন্ডিতেই নিজেকে আটকে রাখেনি, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার অপূর্ব শিল্পীসত্ত্বা ও উদ্ভাবনী শক্তির। বিভিন্ন দেশে আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমন বেশ কিছু অভিনব ব্রিজ, যার কথা আমাদের অনেকেরই অজানা। চলুন তাহলে সেসব ব্রিজের খোঁজ নিয়ে আসা যাক এ যাত্রায়।
ওরেসুন্দ ব্রিজঃ সমুদ্রের তলায় থাকা ব্রিজের কিছুটা অংশ
এই ব্রিজ সমুদ্র পথে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন ও সুইডেনের শহর মালমোকে যুক্ত করেছে। অবিশ্বাস্য রকম প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে এই ব্রিজটি তৈরিতে। এটি সুইডেনের উপকূল থেকে শুরু হয়ে আট কিলোমিটার অংশ গিয়ে পড়েছে ‘পেবারহোম’ নামে এক কৃত্রিম দ্বীপে, অপর দিকে ডেনমার্ক থেকে আসা অংশটি পড়ে অ্যামাজার নামক ডেনমার্ক সমুদ্র তটের অদূরে এক দ্বীপে। মাঝের চার কিলোমিটার গিয়েছে সমুদ্রের তলা দিয়ে টানেলের মাধ্যমে।
চার লেনের এ ব্রিজ দু’দেশের সড়ক ও রেলপথকে যুক্ত করেছে। ১৯৯৯ সালের ১৪ আগস্ট এ ব্রিজের কাজ সম্পন্ন হয়। কম খরচে ব্রিজের আকার না বানিয়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে টানেল বানানোর উদ্দেশ্য হলো শীতের সময় প্রণালী দিয়ে জাহাজ চলাচল ও অসম্ভব ঠান্ডায় জলে বরফ জমতে থাকলে (এ ধরনের বরফকে আইসফ্লো বা ড্রিফ্টআইস বলে) পারাপারে যাতে বিঘ্ন না ঘটে।
বানপো ব্রিজঃ হান নদীর উপর ‘মিডনাইট রেইনবো’
দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল শহরে হান নদীর উপর বানপো ব্রিজ অবস্থিত। এ ব্রিজটি তৈরি হয়েছে ‘জমসু ব্রিজ’-এর উপর, তাই ব্রিজটিকে দেখতে লাগে দ্বিতল ব্রিজের মতো। ১৪৯৫ মিটার লম্বা ব্রিজটি নদীর দু’ধারের সোওকা ও ইয়নসান জেলাকে যুক্ত করেছে। বর্ষায় নদীর জল বাড়লে অনেক সময় তলার ব্রিজটি নদীর জলে ডুবে যায়। তখন যান চলাচল উপরের ব্রিজটিতে স্থানান্তর করা হয়।
২০০৭ সালে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হ্যাংগ্যাং পার্ক ও তার পার্শ্ববর্তী নদী হান ও ব্রিজটিকে আকর্ষণীয় করার উদ্দেশ্যে হ্যাংগ্যাং রেনেসাঁ প্রকল্প শুরু করে, লাগানো হয় ব্রিজের দু’ধারে সারি সারি ফোয়ারা। অন্ধকার নামলেই জ্বলে ওঠে ব্রিজের সব আলো। ফোয়ারার জলে আলো পড়ে তৈরি হয় এক মায়াবী পরিবেশ। রাতের সিউল শহরের এক অন্যতম আকর্ষণ এই ‘মিডনাইট রেইনবো’। ২০০৮ সালে গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা ফোয়ারা হিসেবে স্থান পায় এই বানপো ব্রিজ।
আগুনমুখী ড্রাগন ব্রিজঃ ভিয়েতনামের ডা নাং নদীর উপর অগ্নিবর্ষণরত আশ্চর্য এক ব্রিজ
২০১৩ সালের ২৯ মার্চের কথা। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ভিয়েতনামী সেনাদের ভিয়েতনামের ডা নাং অধিগ্রহণের ৩৮ বছর পূর্তির স্মারক হিসেবে অভিনব কিছু তৈরির কথা ভেবেছিল ভিয়েতনাম সরকার। এ উদ্দেশ্যেই ডা নাং-এ উদ্বোধন করা হয় এক আশ্চর্য ব্রিজের। ভিয়েতনামীরা বিশ্বাস করে ড্রাগন হচ্ছে সৌভাগ্যের প্রতীক। তাই ৬৬৬ মিটার লম্বা ও ৩৭.৫ মিটার প্রশস্ত ব্রিজটি নির্মিত হয় এক বিশালাকার ড্রাগনের রুপে।
ছ’টি সড়কের এই ব্রিজটিতে লাগানো হয়েছে ২৫০০টি এলইডি আলো, যা রাতের অন্ধকারে হান নদীর উপরে এই সেতুকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলে। রুপকথার ড্রাগনের মতো এই ড্রাগনের মুখ থেকেও হয় অগ্নিবর্ষণ।
ওটিম্বার ব্রিজঃ লন্ডনের প্যাডিংটন বেসিনের উপর গুটিয়ে যাওয়া ব্রিজ
২০০৪ সালে ব্রিটিশ ডিজাইনার থমাস হিদারউইক লন্ডনের প্যাডিংটন বেসিনের উপর বারো মিটার লম্বা এই অভিনব ব্রিজটি তৈরি করেন। শহরের মধ্যে দিয়ে যাওয়া গ্র্যান্ড ইউনিয়ন খাল পারাপারের জন্য স্টিলের তৈরি ব্রিজটি বানানো হয়। এই ছোট্ট খাল দিয়ে নৌকো, স্পিডবোট চলাচল করে, যা গিয়ে পড়ে প্যাডিংটন বেসিনে।
প্রতি শুক্রবার দুপুরে নৌকা পারাপারের জন্য ব্রিজটি খুলে দেওয়া হয়। আর সেখানেই এর বিশেষত্ব। মেঝের মোটা কার্পেট গুটিয়ে ফেলার মতোই গোটা ব্রিজটি গুটিয়ে গিয়ে নৌকো চলাচলের জায়গা করে দেয়া হয়। আটটি অংশ দিয়ে তৈরি এই ব্রিজ গুটিয়ে গেলে অষ্টভুজাকার এক রোলার-এর মতো দেখায়। সে কারণেই ব্রিজটি হয়ে উঠেছে অনন্য।
মোজেস ব্রিজঃ নেদারল্যান্ডের হ্যালস্টোরনে ডুবে থাকা ব্রিজ
নদী বা সমুদ্রের উপর ব্রিজ তৈরিতে ডাচদের তুলনা মেলা ভার। এ ধরনের অনেক প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে তাদের দেশে। মোজেস ব্রিজ তার অন্যতম। দক্ষিণ-পশ্চিম নেদারল্যান্ডের হ্যালস্টোরনে রয়েছে পরিখা ঘেরা সতের শতকের বেশ কিছু দুর্গ। সেই সময় এই জল ভর্তি পরিখাগুলো ব্যবহৃত হতো বাইরের শত্রুদের আক্রমণ ঠেকাতে। সময়ের সাথে সাথে জল ভর্তি পরিখাগুলো মজে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে এগুলোকে মেরামত করে জলের মাপ ঠিক করা হয়। তখন পারাপারের জন্য সাঁকোর প্রয়োজন পড়ে। এতে সমস্যা হলো পরিখাগুলোর উপর সাঁকো তৈরি করলে দূর থেকে তা শত্রুপক্ষের নজরে পড়বে। আবার অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ব্যাঘাত ঘটবে।
তাই বেছে নেয়া হলো এক অভূতপূর্ব উপায়। প্রাচীন দুর্গগুলোর একটি ফোর্ট দি রুভের সাথে অপর পারের সংযোগ স্থাপনের জন্য তারা জলের উপর তৈরি করে আশ্চর্য এক ডুবে থাকা ব্রিজ। এমনই অসাধারণ এর নকশা যে ব্রিজের দু’ধারের পাঁচিল বানানো হয়েছে জলের সঙ্গে একই উচ্চতায়। দূর থেকে ব্রিজটি প্রায় অদৃশ্য। এক বিশেষ ধরনের কাঠ ‘অ্যাকোরা’ এবং ওয়াটার প্রুফ ফয়েল দিয়ে তৈরি এই ব্রিজটি গঠনগতভাবে যথেষ্ট মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী।
ভিজকায়া ট্রান্সপোর্টার ব্রিজঃ ব্রিজের ঝুলন্ত গন্ডোলায় চেপে নদী পারাপার
ব্রিজ আছে, অথচ তার উপর দিয়ে চলাচলের স্থায়ী পাটাতন নেই, এটাই ‘ট্রান্সপোর্টার ব্রিজ’-এর মূল বৈশিষ্ট্য। বিশ্বে মোট বাইশটি ট্রান্সপোর্টার ব্রিজের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার মাঝে মাত্র নয়টি এখনও বর্তমান। এ ধরনের ব্রিজের আয়ু সাধারণত ৩৫-৪০ বছর হয়ে থাকে। সমসাময়িক অধিকাংশ ব্রিজের সেই আয়ু শেষ হয়ে যাওয়ায় ব্রিজগুলোকে ভেঙে ফেলা হয়েছে অথবা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্বের প্রথম ট্রান্সপোর্টার ব্রিজ ভিজকায়া, যা স্পেনের বিস্কে অঞ্চলের বিলবাও-এ আজও সচল রয়েছে। ১৬৪ মিটার লম্বা এই ব্রিজ নির্মিত হয়েছে নার্ভোন নদীর উপর, যা এক তীরে পর্তুগালেট ও অপর তীরে লাস আরেনাসকে যুক্ত করেছে। ব্রিজটির বিশেষত্ব হলো পারাপারের জন্য এখানে স্থায়ী কোনো প্যাসেজ নেই। উপরের লোহার বিম থেকে নেমে আসা স্টিলের তারের সাহয্যে ঝোলানো রয়েছে রোপওয়ের মতো বিশালাকার গন্ডোলা, যা চলাচল করে প্রতি আট মিনিট অন্তর অন্তর। ২৪ ঘন্টাই এই ব্রিজ সচল থাকে। ২০০৬ সালে এই ঝুলন্ত ব্রিজটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ব্রিজের স্বীকৃতি পেয়েছে।
পন্টে ভেচিওঃ ব্রিজের উপরেই দোকান-বাজার
ইতালির প্রাচীনতম ব্রিজগুলোর মধ্যে ফ্লোরেন্স শহরের আর্নো নদীর উপর দাঁড়িয়ে থাকা ‘পন্টে ভেচিও’ অন্যতম। অনেকের মতে, এটি তৈরি হয়েছিল রোমান যুগে, যা ১৩৩৩ সালের বন্যায় প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। মেরামতের মাধ্যমে পরবর্তীতে নতুন রূপে খোলা হয়, যা আজ ফ্লোরেন্স শহরের একটি দর্শনীয় স্থান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী ইতালিতে ঢুকে পড়ে প্রায় সব ব্রিজ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পন্টে ভেচিওর উপর তার আঁচ লাগেনি। কথিত আছে, জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলার জরুরি বার্তা পাঠিয়েছিলেন তার সৈন্যদলকে, যেন এই ব্রিজটির কোনো ক্ষতি না করা হয়।
পন্টে ভেচিওর বিশেষত্ব হলো ব্রিজের উপরেই রয়েছে সারি সারি ঘর, দোকান, বাজার, এমনকি ভিউ পয়েন্টও। এখন পন্টে ভেচিওর উপর দিয়ে হেঁটে গেলে মনে হবে কোনো বাজারে ভুল করে যেন ঢুকে পড়েছেন পথযাত্রীরা। সন্ধ্যের আলো ঝলমলে শহরের নতুন-পুরনো স্থাপত্যের ভিড়ে আর্নো নদীর উপর দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যযুগীয় পন্টে ভেচিও বর্তমানে হেরিটেজ ব্রিজ হিসেবে পরিচিত যা ফ্লোরেন্স শহরকে এনে দিয়েছে এক অনন্য মাত্রা।
অভিনব এসব ব্রিজ নানা দেশের পর্যটকদের কাছে অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এসব ব্রিজ দেখার জন্য প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থী দেশগুলোতে ভ্রমণে যান। অন্যান্য দর্শনীয় স্থান দেখার ফাঁকে ফাঁকে ব্রিজগুলো দেখতেও ভোলেন না তারা।