কী কারণে বদলে যাচ্ছে জলবায়ু ?

আমাদের চেনাজানা জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন আজ আমাদের অন্যতম চিন্তার বিষয়। পৃথিবীকে আমরা প্রতিদিন যে হারে দূষিত করে তুলছি তাতে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এখানে আমাদের অস্তিত্বই সংকটের মুখে পড়বে। এই দূষণ ঘটছে নানাভাবে।

পরিবেশের এই দূষণের প্রভাব বহুমুখী। একদিকে যেমন আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের পরিমাণ দিনকে দিন কমছে, অন্যদিকে তেমনি আমরা জলবায়ুগত নানা পরিবর্তনের সম্মুখীন হচ্ছি। পৃথিবীব্যাপী তপমাত্রা বেড়ে যাবার ফলে বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বনাঞ্চল ধ্বংস এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবার কারণে বার বার আসছে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট সমীক্ষা চালিয়ে পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুগত পরিবর্তনের পেছনে ১০ রকম দূষণকে দায়ী করেছে।

১০) বাঙ্কার জ্বালানি

দেশীও এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় পণ্য পরিবহনের বাঙ্কার, পণ্যবাহী বিমানগুলো থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে জ্বালানির নিঃসরণ ঘটে থাকে। ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের মতে, পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনে এর প্রভাব প্রায় ২.২%। যদিও কোনো দেশ এককভাবে এই দূষণের  জন্য দায়ী নয়, তবুও সামগ্রিকভাবে বিষয়টি আদৌ ফেলে দেবার মতো নয়।

Image source: CNN

৯) বর্জ্য

প্রতিদিনই আমরা বিভিন্নভাবে বর্জ্য তৈরি করছি। গৃহস্থালির কাজ থেকে শুরু করে শিল্প বর্জ্যের পরিমাণ হিসেব করলে এটি বেশ চিন্তার বিষয়। এই পাচ্য/অপাচ্য বর্জ্য পরিবেশ দূষণে মারাত্মক ভূমিকা পালন করছে, তৈরি হচ্ছে ‘গ্রিনহাউজ গ্যাস’ নামে পরিচিত অত্যন্ত ক্ষতিকারক মিথেন গ্যাস। ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিসংখান অনুসারে, এই বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রায় ৩.১% ভূমিকা পালন করছে।

Image source: CNN

৮) গ্যাস দহন

আমরা প্রতিদিনই বিভিন্ন কাজে গ্যাস পোড়াচ্ছি। এছাড়া পৃথিবীব্যাপীই প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন করার জন্য প্রতিনিয়ত ড্রিল করা হচ্ছে। এই ধরনের ড্রিলিং মারাত্মক ধরনের বায়ু দূষণের কারণ হিসেবে কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকার ইয়োমিং স্টেটের কথা বলা যেতে পারে। এছাড়া ভূগর্ভ থেকে যে প্রযুক্তিতে তেল এবং গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে তা ভূগর্ভস্থ পানির দূষণও ঘটাচ্ছে প্রচন্ডভাবে। এই ধরনের দূষণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ভূমিকা পালন করছে প্রায় ৫.৩%।

Image source: CNN

৭) বনায়ন ধ্বংস

সারা দুনিয়া জুড়ে যেভাবে বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে তা সত্যিই চিন্তার বিষয়। শিল্পায়নের কারণে আজ এই অরণ্যভূমি মারাত্মকভাবে কমে গিয়েছে। বনভূমির এই নাশ বা ধ্বংস দু’ভাবে পরিবেশের দূষণ ঘটায়। বনভূমি পোড়ানোর ফলে যেমন এক বিশাল পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ ঘটে, ঠিক তেমনি এই বনভূমি দ্বারা কার্বন ডাই অক্সাইডের শোষণের হারও দিন দিন কমে যায়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে এই অরণ্য নাশ অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ। বন কর্তন এবং অরণ্য নাশ জলবায়ু পরিবর্তনে কমপক্ষে ৫.৭% ভাগ ভূমিকা পালন করছে।

Image source: CNN

৬) শিল্পায়ন

পৃথিবী জুড়ে যেভাবে শিল্পায়ন ঘটছে তা সত্যিই চিন্তার বিষয়। একদিকে বনভূমির পরিমাণ দিনকে দিন কমছে অন্যদিকে এই শিল্প-কলকারখানা থেকে নিঃসরণ ঘটছে বিষাক্ত কালো ধোঁয়া এবং প্রচুর পরিমানে শিল্প আবর্জনা। এই কালো ধোঁয়ায় আছে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং কার্বন মনোক্সাইডের মতো জীবনঘাতী গ্যাস। বিশেষ করে, সিমেন্ট এবং অ্যালুমিনিয়াম শিল্প থেকে যে পরিমাণ পরিবেশ দূষণ ঘটছে তা সত্যিই চিন্তার কারণ। ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের হিসাবমতে, এই ধরনের দূষণ সামগ্রিক দূষণে ভূমিকা পালন করছে অন্তত ৫.৮ ভাগ।

Image source: CNN

৫) জ্বালানির ব্যবহার

পারিবারিক পর্যায়ে জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার, কৃষিকাজে ব্যবহৃত জ্বালানি এবং বাণিজ্যিক কাজে যে পরিমাণ জ্বালানি প্রতিদিন পোড়ানো হচ্ছে তা আদৌ কম নয়। এছাড়া গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা থেকে শুরু করে নানা কাজে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে বাণিজ্যিকভাবে প্রতিদিন যে পরিমাণ জ্বালানির ব্যবহার হচ্ছে তার হিসাব রাখা আসলে সম্ভব নয়। ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ধারণানুযায়ী, এই ধরনের নানা কাজে জ্বালানির ব্যবহার সামগ্রিক পরিবেশ দূষণে কমপক্ষে ৮.২ ভাগ দায়ী।

Image source: CNN

৪) কৃষিকাজ

সামগ্রিক পরিবেশ দূষণে কৃষির ভূমিকাও কম নয়। আমাদের খাদ্যাভ্যাসের কারণে মারাত্মকভাবে এই দূষণ ঘটছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষির সম্প্রসারণ থেকে যে পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেন উৎপন্ন হচ্ছে তা আসলেই চিন্তার বিষয়। প্রতিবছর এই পৃথিবীতে উৎপন্ন হওয়া মিথেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের যথাক্রমে ৪০ এবং ৩ ভাগ আসে এই কৃষি সম্পর্কিত দূষণ থেকে। এছাড়া মাংস থেকে উৎপন্ন হওয়া বর্জ্যও পরিবেশ দূষণের জন্য মারাত্মকভাবে দায়ী। এই ধরনের দূষণ সামগ্রিক দূষণে প্রায় ১১.১ ভাগ ভূমিকা পালন করছে।

Image source: CNN

৩) উৎপাদন ও নির্মাণ

উৎপাদন ও নির্মাণশিল্পে দূষণের বিষয়টি আসলে খুব একটা আলোচনায় আসে না। কিন্তু সামগ্রিক দূষণে এই দুই শিল্পের ভূমিকা কিন্তু কম নয়। প্রতিদিন বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন এবং নানা রকমের নির্মাণ খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে অনেক ধরনের কাঁচামাল। এর থেকে উৎপন্ন হচ্ছে নানা ধরনের বর্জ্য এবং গ্যাস। এই বর্জ্য এবং গ্যাস থেকে যে পরিমাণ দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে তা রীতিমতো আতংকের বিষয়। এই ধরনের দূষণ সামগ্রিক পরিবেশ দূষণে কমপক্ষে ১৩.৩ ভাগ দায়ী, ওয়াল্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের হিসেব থেকে বিষয়টি উঠে আসে।

Image source: CNN

২) যোগাযোগ ব্যবস্থা

যোগাযোগ আজ এক বিশ্বজনীন বিষয়। সব দেশই একটি ‘উন্নততর যোগাযোগ ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই দেখা যায়, এসব অপরিকল্পিত যোগাযোগ উন্নয়ন মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। দ্রব্য এবং মানুষ পরিবহনে ব্যবহৃত যানবাহনের কালো ধোঁয়া, যেমন- বিমান ও অন্যান্য যাতায়াতের বাহন থেকে যে পরিমাণ কার্বন উৎপন্ন হয় তা সামগ্রিক পরিবেশ দূষণের দ্বিতীয় প্রধান কারণ। এক পরিসংখানে দেখা যায়, শুধু আমেরিকাতেই পণ্য ও মানুষ পরিবহন থেকে যে দূষণ ঘটে তা তাদের সামগ্রিক দূষণের অন্ততপক্ষে ৩০ ভাগ। ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিসংখান দেখায়, পৃথিবীর সামগ্রিক দূষণের অন্ততপক্ষে ১৪.৮ ভাগ আসে এই ধরনের দূষণ থেকে।

Image source: CNN

১) বিদ্যুৎ, তাপ এবং পাওয়ার প্ল্যান্ট

পরিবেশ দূষণের সবথেকে বড় কারণ হিসেবে সমীক্ষায় যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলো বিদ্যুৎ, তাপ এবং পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া। শুধু তা-ই নয়, কয়লা নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হয় তাতে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে জীব বৈচিত্রের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। শুধু আমেরিকাতেই এই ক্ষেত্র থেকে মোট কার্বন ডাই অক্সাইডের ৪০ শতাংশ নিঃসরণ ঘটছে। এছাড়া শুধু কয়লার ব্যবহারই ৯৩% বৈদ্যুতিক দূষণের জন্য দায়ী। ইপিএ’র ভাষ্যমতে, কয়লা এবং ওষুধ থেকে উৎপন্ন বর্জ্য দ্বারা আমেরিকায় দুই-তৃতীয়াংশ মার্কারি দূষণ ঘটে। ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের হিসাবানুসারে, বিদ্যুৎ, তাপ এবং পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে মোট দূষণের প্রায় ৩১ ভাগ ঘটে থাকে।

Image source: CNN

ফিচার ইমেজ- Birdlife.org

Related Articles

Exit mobile version