আফ্রিকার প্রাচীনতম দেশ ইথিওপিয়া। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংঘাতের লীলাভূমি। সম্প্রতি দেশটিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চমক, এই পদে একজন নারীকে নির্বাচিত করা। আধুনিক ইথিওপিয়ার ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নারী দেশটির সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার সুযোগ পেলো। শুধু ইথিওপিয়াই নয়, বরং পুরো আফ্রিকা মহাদেশে তিনিই একমাত্র বহাল নারী রাষ্ট্রপতি। ফলে তার এই অর্জন বিশ্বব্যাপী বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো তাকে নিয়ে ফলাও করে সংবাদ পরিবেশন করছে। ইথিওপিয়ার নব-নির্বাচিত এই নারী রাষ্ট্রপতির নাম সাহলে ওয়ার্ক জিউদে।
জিউদের এই অর্জনকে আফ্রিকান অঞ্চলে নারী ক্ষমতায়নের নতুন অধ্যায় বলে অবিহিত করা হচ্ছে। গণতন্ত্রের পথে তার এই যাত্রা রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সর্বোপরি তিনি নারীর ক্ষমতা ও রাজনীতি চর্চার ইতিহাসে একজন অগ্রদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
পেশাগত দিক থেকে জিউদে একজন অভিজ্ঞ কূটনীতিবিদ। তিনি এখনও আফ্রিকান ইউনিয়নে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োজিত আছেন। এছাড়া ইতিপূর্বে তিনি সেনেগাল ও জিবুতিতে ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে শান্তি মিশনের প্রধানসহ জাতিসংঘের একাধিক পদে দায়িত্বে পালন করেছেন।
এই কূটনৈতিক ‘হাই প্রোফাইল’ ও আন্তর্জাতিক সংযোগ তাকে আরও অধিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে যখন তাকে নিয়ে এত মাতামাতি হচ্ছে, তখন আফ্রিকার স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে আরো একজন নারীর কথা আলোচিত হচ্ছে। তিনিও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইথিওপিয়া সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। জিউদের পাশাপাশি তার নাম কেন স্মরণ করা হচ্ছে না, এ নিয়ে প্রশ্নও তুলছেন অনেকে। এই নারী রাষ্ট্রপ্রধানের নাম সম্রাজ্ঞী জিউদিতুর। আফ্রিকার প্রভাবশালী দ্বি-মাসিক ইংরেজি ম্যাগাজিন ‘দিস ইজ আফ্রিকা‘ এ ব্যাপারে লিখেছে-
আমরা ইথিওপিয়ার প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি সাহলে জিউদিকে তার গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের জন্য অভিনন্দন জানাই। কিন্তু আমরা আমাদের পূর্ববর্তীদের ঐতিহাসিক অর্জনকে ভুলে যেতে চাই না। আমরা আমাদের সম্রাজ্ঞী জিউদিতুর কথা স্মরণ করতে চাই, যিনি ইথিওপিয়া সাম্রজ্যের প্রথম নারী রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। এই সাম্রাজ্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ছিল এবং তিনিই এই সাম্রাজ্যের প্রথম ও শেষ নারী শাসক ছিলেন। ফলে জিউদের এই অর্জন আমাদেরকে তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ম্যাগাজিনটি আরো লিখেছে,
সম্রাজ্ঞী জিউদিতুর নামের অর্থই হলো ‘রাজমুকুট’, যিনি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংরক্ষণবাদিতার বিরুদ্ধে লড়াই করে একজন অসাধারণ নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। তার অধীনে ইথিওপিয়া ১৯১৬ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছিলো। তিনি ইথিওপিয়া সাম্রাজ্যের সম্রাট মেনেলিকের জ্যেষ্ঠ কন্যা ছিলেন।
তবে এই বিতর্ক তেমন পরস্পর বিরোধী নয়, কেননা সম্রাজ্ঞী জিউদিতু ইথিওপিয়ার প্রথম নারী শাসক হলেও তিনি ‘মডার্ন স্টেট’ বা আধুনিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন না; বরং তিনি একটি সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী ছিলেন। অপরদিকে সাহলে জিউদে ‘আধুনিক’ ইথিওপিয়ার প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান। অর্থাৎ রাষ্ট্র কাঠামোর বিবেচনায় এই দুই নারী অগ্রদূতের অর্জন আলাদা আলাদা।
৬৮ বছর বয়সী নব-নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান সাহলে জিউদের সাথে সম্রাজ্ঞী জিউদিতুর আরেকটি অদ্ভুত মিল রয়েছে। তা হলো উভয়েই কাগজে-কলমে রাষ্ট্রপ্রধান। অর্থাৎ রাষ্ট্র বা রাজ্যের সবচেয়ে বড় পদ অলঙ্কৃত করলেও বাস্তবে তাদের ক্ষমতাচর্চার সুযোগ-সুবিধা ছিল বেশ সীমিত। অর্থাৎ এই পদ প্রতীকী। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ ও সমতার দৃষ্টিকোণ থেকে উভয়ের অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই সাহলে জিউদের বিজয় নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরা লিখেছে,
যদিও রাষ্ট্রপতির পদ বৃহদার্থে আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, কিন্তু এর প্রতীকী মূল্য ও গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। এই বিজয় সামাজিক পরিসরে ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
একইভাবে সম্রাজ্ঞী জিউদিতু সাম্রাজ্যের প্রধান শাসক নিযুক্ত হলেও নানা কারণে খুব বেশি ক্ষমতা চর্চা করতে পারেননি। এর সবচেয়ে বড় কারণ ছিল তৎকালীন ধর্মীয় ও রাজনীতির প্রথাগত বাধা। এ বিষয়ে ‘দিস ইজ আফ্রিকা‘ ম্যাগাজিন লিখেছে,
সিংহাসনে আরোহণ করার পর তিনি ‘কুইন অফ কিংস’ বা রাজাদের রানী উপাধি লাভ করেন। কিন্তু ইথিওপিয়া সাম্রাজ্য তাকে যথার্থ ক্ষমতা চর্চা করার সুযোগ দেয়নি। তার এই পদ ছিল অনেকটা প্রতীকী। তার চাচাতো ভাই রাজ তাফারি মাকোননেনকে তার সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনিই মূলত রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরিচালনা করতেন।
বাস্তবতা যা-ই হোক না কেন, সম্রাজ্ঞী জিউদিতু এবং নব-নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সাহলে জিউদে উভয়েই ইথিওপিয়ার নারী ক্ষমতায়নের ইতিহাসে দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। সম্প্রতি ইথিওপিয়ার রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। দেশটির সংসদে বড় ধরনের সংস্কার আনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ ইতিমধ্যেই মন্ত্রিপরিষদে অর্ধেক নারী সদস্য রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। ইথিওপিয়ার রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তার ভূমিকাও কম নয়। সাহলে জিউদেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার পেছনেও কাজ করেছে তার প্রবল সদিচ্ছা। ফলে জিউদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এক টুইট বার্তায় তিনি জানান,
কূটনীতিবিদ সাহলে জিউদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় তা ইথিওপিয়ার ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমাদের মতো একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দেশে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে একজন নারীকে নির্বাচিত করা ইথিওপিয়ার উন্নত ভবিষ্যতেরই বার্তা প্রদান করে। এটি আমাদের দেশের নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারকে আরও স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসবে।
ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় জন্মগ্রহণ করা জিউদে ফ্রান্সের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সংসদে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেন,
আমি মনে করি, ইথিওপিয়ার এই সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো নারী ও পুরুষের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনবে। এর মধ্য দিয়ে সকলে সমতার ভিত্তিতে কাজ করার সুযোগ পাবে, যা আমাদের উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখবে। ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী ও লিঙ্গ বৈষম্যমুক্ত উন্নত ইথিওপিয়া গঠনই আমাদের আসল স্বপ্ন।
কিছুদিন পূর্বে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে মুলাতু টেশোম পদত্যাগ করলে ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হয়ে পড়ে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতেই দেশটির জাতীয় সংসদে ভোটাভুটির আয়োজন করা হয়। উক্ত ভোটে সংসদ সদস্যরা তাদের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাকে নির্বাচিত করেন।
সম্প্রতি ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহম্মেদ সমতার ভিত্তিতে সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। জিউদের এই বিজয় তারই প্রতিফলন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। শুধু জিউদে একাই নন, দেশটির ২০ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রীসভায় সমতার ভিত্তিতে ১০ জন নারী সদস্যকে জায়গা করে দেয়া হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও একজন নারী মন্ত্রীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এসব গুণগত পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে ইথিওপিয়ার নাগরিকদের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন ব্লগে তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। ‘আদ্দিস স্ট্যান্ডার্ড’ নামক একটি স্থানীয় ম্যাগাজিনের সম্পাদক টিসেডালি লিমা তার টুইটার বার্তায় লিখেছেন,
আমি এমন একজন নারীর বিজয়ের সংবাদ পেলাম, যিনি তার দেশকে ভালোবেসে দেশের সেবায় এগিয়ে এসেছেন। তাকে সম্মান জানানোর মতো ভাষা আমাদের জানা নেই! আমরা তার সম্মানে এখন যা করতে পারি তা হলো, তার এই রাষ্ট্রপতি পদকে প্রতীকী না রেখে অধিকার চর্চার পদে পরিণত করতে পারি।
জিউদের আগে সমগ্র আফ্রিকান অঞ্চলে মাত্র দুজন নারী রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর মধ্যে লাইবেরিয়ায় ২০০৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত টানা এক যুগ এলেন জনসন সারলিফ এবং মালাউইতে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জয়েস বান্দা রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অর্থাৎ আফ্রিকার সামগ্রিক ইতিহাসে তিনি তৃতীয় ও বর্তমান সময়ে দায়িত্বরত একমাত্র নারী রাষ্ট্রপতি।
আবার ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করলে সম্রাজ্ঞী জিউদিতুকেও ইথিওপিয়ার প্রথম নারী রাষ্ট্রপ্রধান বলা যায়। ফলে গণমাধ্যমের একচেটিয়া প্রচার-প্রচারণার আড়ালে তার কথা ভুলে যাওয়া চলবে না- এমনটিই হয়তো বলতে চাচ্ছেন দেশটির সচেতন নাগরিকরা।