গত ১৪ মার্চ আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকে আঘাত হানে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আইডা। এতে দেশটির অন্যতম শহর বেইরার প্রায় ৯০ শতাংশ বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দেশটির অন্যান্য অঞ্চলও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এতে দেশটির চার শতাধিক মানুষ নিহত হয়। এতে অসহায় হয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষ; বিশেষত নারী ও শিশুদের জন্য এটি এক দুর্বিষহ পরিস্থিতি নিয়ে আসে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এর এক প্রতিবেদনে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের নিয়ে ভয়াবহ তথ্য উঠে আসে। এতে দেখা যায়, দুর্যোগ পরবর্তী ত্রান কার্যক্রমের সুযোগ নিয়ে দেশটির সরকারী কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী মহলের একটি অংশ নারীদের প্রতি যৌন হয়রানি করছেন।
আইডার আঘাতে দেশটির অনেক স্থানের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অসংখ্য বাড়িঘর ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মাটির সাথে মিশে যায়। জাতিসংঘের তথ্য মতে, দেশটির এখন দশ লাখেরও অধিক মানুষ খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই কিছু স্থানীয় নেতা ও ক্ষমতাসীন দল ফ্রিলিমো পার্টির কিছু সদস্য “এক ব্যাগ খাদ্যের বিনিময়ে” নারীদের উপর্যপুরী যৌনকার্যে ব্যবহার করছেন; অথবা তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এ বিষয়ে এইচআরডব্লিউ এর দক্ষিণ আফ্রিকা অঞ্চলীয় পরিচালক দেওয়া মাভিঙ্গা বলেন
ঘূর্ণিঝড় আইডায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো নিষ্ঠুর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় পার করছেন। খাদ্য সংগ্রহের বিনিময়ে নারীদের বাধ্যতামূলক যৌন কর্মে লিপ্ত হতে হচ্ছে। অবিলম্বে এই ভয়ানক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা উচিত।
মাভিঙ্গা আরও বলেন-
জরুরি সাহায্য তহবিল ক্ষতিগ্রস্ত সকলের জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত। এবং সরকারের উচিত যারা ত্রাণ বিতরণ কার্যে নিয়োজিত আছেন তাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা। কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, ত্রাণ বিতরণকারীরা যাতে কোনোভাবেই এর বিনিময়ে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করতে না পারে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, দেশটিতে বর্তমানে তীব্র খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এছাড়াও বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসা সেবার তীব্র সঙ্কট রয়েছে। এই মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলা করতে জাতিসংঘ তিন মাসের একটি জরুরী তহবিল গঠন করতে চেয়েছিল। সেই লক্ষ্যে সংস্থাটি ২৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অনুদান চেয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর কাছে একটি আবেদন করেছিল। তবে আইএমএফ তা পুরোপুরি অনুমোদন করেনি। তবে সঙ্কট মোকাবিলায় দেশটিকে বিনা সুদে ১১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করেছে সংস্থাটি। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আওতায় এটি দেশটির প্রায় এক লাখ মানুষের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
এক ব্যাগ মটরশুটির জন্য দেহ বিনিময়
সঙ্কট অধিক জটিল হয়ে যাওয়ার পেছনে কারণ হচ্ছে, দেশটির যোগাযোগ ব্যাবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়া। নামাতন্দ জেলার টিকা সম্প্রদায়ের এক নেত্রী মানবাধিকার সংস্থা এইচআরডাব্লিউকে বলেন-
ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের কিছু কিছু রাস্তায় প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব। সেখানে সরাসরি কোনো খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব না। ফলে সেখানকার স্থানীয় নেতাদের কাছে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হয়েছে। তারা সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট স্থানে জমা করে রাখে এবং সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে বিতরণ করে।
কিন্তু ত্রাণের পরিমাণ অপর্যাপ্ত হওয়াতে একটি সুবিধবাদী চক্র গড়ে উঠেছে। ঐ নেত্রী আরও জানান-
কিন্তু এই খাদ্য ক্ষতিগ্রস্ত সকলের জন্য যথেষ্ট নয়। কিছু স্থানীয় নেতারা এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন। তারা খাদ্য বিতরণ তালিকা প্রণয়নের সময় জনগণকে নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করছেন।
দেশটিতে মানবিক সহায়তা প্রদান কাজে জড়িত একজন কর্মী জানান, বিশেষত সেসকল পরিবারের প্রধান পরিচালক নারী, সেসকল পরিবারের নাম সাহায্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে বেশি ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। তিনি এইচআরডাব্লিউকে বলেন-
তারা এখন এমন পরিস্থিতির মধ্যে আছেন যে, খাদ্যের বিনিময়ে তারা যেকোনো কিছু করতে বাধ্য হচ্ছেন। ইতোমধ্যেই অনেক নারী বাধ্য হয়ে স্থানীয় খাদ্য বিতরণ কার্যক্রমের নেতাদের সাথে রাত্রিযাপনে বাধ্য হয়েছেন।
আরেকজন সাহায্য কর্মী জানান, স্থানীয়দের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কিছু কর্মকর্তাও এই নেতিবাচক ও নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। এইচআরডাব্লিউ-এর প্রতিবেদনে কয়েকজন ভুক্তভোগী নারীর ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নামাটান্দ জেলা শহরের এমবিমবার এলাকায় বসবাসরত তিনজন নারী স্থানীয় ত্রাণ কর্মকর্তাদের দ্বারা খাদ্যের বিনিময়ে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছেন। সংস্থাটি জানায়, ঐ এলাকায় এখন পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক সহায়তা পৌঁছাতে পারেনি। কারণ বন্যার কারণে ঐ এলাকার রাস্তাঘাট পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ঐ তিন নারীর একজন বলেন,
তিনি যখন আসলেন, তখন প্রথমে তার হাতের ব্যাগটি (ত্রাণ) আমার ঘরের মেঝেতে রাখলেন। তারপর তার বিশেষ অঙ্গটি ইঙ্গিতপূর্ণভাবে স্পর্শ করতে থাকলেন এবং এক পর্যায়ে আমাকে বললেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অংশ হিসেবে ঐ অঙ্গটি স্পর্শ করতে। তখন ঘরে আমার সন্তানরাও ছিল, আমি বাধ্য হয়ে তাদেরকে প্রতিবেশীর ঘরে চলে যেতে বলি। যখন তারা চলে যায়, তখন আমি কর্মকর্তার সাথে একান্ত সময় বিনিময় করি।
অপর এক নারী জানান, একজন স্থানীয় নেতা তাকে সাহায্য করার কথা বলেন। বিনিময়ে তিনি তার সাথে দৈহিক মিলন করতে চান। ঐ নারী তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
তিনি আমাকে বলেন, আমি দেখতে খুব সুন্দর। আমাকে তিনি সাহায্য করতে পারেন, যদি আমি তাকে খুশি করতে পারি। এক পর্যায়ে আমি তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই এবং আমাদের মধ্যে একান্ত বিষয় সংঘটিত হয়।
কিন্তু দেহের বিনিময়ে নেতাকে খুশি করেও এই নারী পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য পাননি। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১৭ জন। কিন্তু তাকে উক্ত নেতা মাত্র এক কেজি মটরশুঁটি প্রদান করেন; যা ১৭ জন সদস্যের জন্য এক বেলা খাবারের জন্যও যথেষ্ট নয়। যখন তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করলেন, তখন গোত্র প্রধান তাকে বললেন,
আগামীকাল আবার এসো, তখন বেশি করে দেওয়া হবে।
এমন নিষ্ঠুর পরিস্থিতি চলতে থাকলেও মোজাম্বিক সরকার এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। পুলিশও উল্লেখযোগ্য কোনো অভিযান বা কাউকে গ্রেফতার করেনি। তবে এপ্রিলের শুরুর দিকে ত্রাণ আত্মসাতের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। উক্ত অভিযানে ১৯ ব্যাগ চাল, ১৯ ব্যাগ ময়দা, ১১ ব্যাগ সয়াবিন এবং ১০০ কেজি মটরশুঁটি জব্দ করা হয়েছিল। এর বাইরে নারীদের প্রতি যৌন সহিংসতা রোধ করতে কর্তৃপক্ষ দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেনি।
উল্লেখ্য, ঘূর্ণিঝড় আইডা মোজাম্বিক ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ মালাউই ও জিম্বাবুয়েতে আঘাত হানে। এতে জিম্বাবুয়ের প্রায় তিন শতাধিক ও মালাউইতে অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হয়। এছাড়াও বহু মানুষ আহত ও বসতভিটাহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সঙ্কট যৌন সহিংসতাকে কেন্দ্র করে বিশেষভাবে আলোচনায় আসে। সাড়া বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।