মিষ্টিরসিকদের কাছে চিনি এক অমৃতের নাম। ডায়াবেটিসের রোগী ছাড়া সকলেই মোটামুটি চিনি খেয়ে থাকেন। বিয়েবাড়িতে বা অনুষ্ঠানে বা কুটুমবাড়ি যাওয়ার আনুষঙ্গিক উপাদান মিষ্টান্ন তৈরিতে ব্যবহৃত হয় চিনি। তাছাড়া আসছে শীতে পিঠাপুলির উৎসবে নতুন গুড়ের পাশাপাশি চিনি ছাড়া তো চলবেই না। আর আপনার এই অসামান্য চিনি-প্রীতির সুযোগ নিচ্ছে চিনিশিল্পের সাথে জড়িত অনেকেই। এখন থেকে নয়, বহুকাল আগে থেকেই। এমনই এক রমরমা তথ্যের প্রচারে সকলেই স্তম্ভিত, চিন্তিত। কী এমন তথ্য সেটি?
প্রায় ৫০ বছর আগে চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপের মুখে বন্ধ হয়েছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। এর পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটিই- চিনি গ্রহণে হৃদরোগের সম্ভাবনা রয়েছে এ তথ্য যেন সকলের সামনে না উঠে আসে। আজ কয়েক যুগ পর পুনরায় করা হয় সেই গবেষণা এবং পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর তথ্য। শুধু হৃদরোগই নয়, অত্যধিক চিনি গ্রহণে হতে পারে মূত্রাশয়ের ক্যান্সারও!
প্রজেক্ট ২৫৯
সেই ১৯৬৮ সালে ইঁদুরের উপর একটি গবেষণা করা হয় চিনির প্রভাব নিয়ে। গবেষণায় অর্থায়ন করেছিল আন্তর্জাতিক চিনি গবেষণা ফাউন্ডেশন (ISRF) এবং গবেষক দলের প্রধান ছিলেন বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডব্লিউ. এফ. আর. পোভার। গবেষণায় সম্পূর্ণ সুস্থ ইঁদুরদের দুইটি দলে ভাগ করে একটি দলকে অতিমাত্রায় শর্করা (স্টার্চ) এবং অপর দলকে অতিমাত্রায় সুক্রোজ (চিনি) খাওয়ানো হয়। গবেষণায় দেখা যায়, অতিমাত্রায় চিনি খাওয়ানো ইঁদুরগুলোর দেহে এমন একধরনের এনজাইমের দেখা মিলেছে, যা পূর্বে ইঁদুরের মূত্রাশয় ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী বলে পাওয়া গিয়েছে।
এছাড়াও ২৫৯ প্রজেক্টে আরও কিছু ব্যাখ্যাও উল্লেখ ছিল। যেমন- কীভাবে অন্ত্রের ব্যাক্টেরিয়াগুলো চিনি বিপাকের মাধ্যমে ট্রাইগ্লিসারাইডে পরিণত করে এবং সাথে একধরনের ফ্যাট উৎপাদন করে, যা সরাসরি রক্তবাহিকায় চলে যায় এবং প্রবাহিত হয়ে হৃৎপিন্ডে পৌঁছায় এবং হৃদরোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এতটা তথ্যবহুল একটি গবেষণার ফলাফল অপ্রকাশিত রয়ে যায়। অপ্রকাশিত বললে ভুল বলা হবে, কেননা গবেষণার একটি ফলাফল প্রকাশ হয়েছিল যাতে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল গোপন করা হয় এবং চিনির কোনো ক্ষতিকর প্রভাব জানা যায়নি বলে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। গবেষণার জন্য অর্থায়নও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এত গোপনীয়তা কেন? প্রশ্নটির উত্তর কিন্তু একদম সহজ- সবকিছুই মার্কেটিংয়ের জন্য, ব্যবসায় লাভবান হবার জন্য, ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য।
প্রশ্ন করা হয়েছিল চিনিশিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের। তাদের ভাষ্যমতে, গবেষণাটি এর ফলাফলের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়নি, বরং সময় এবং অতিরিক্ত খরচের জন্যই বন্ধ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ব্রিটিশ নিউট্রিশন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে পুনরায় অর্থায়নের কথা বলা হলেও কোনো এক অজানা কারণে তা আর হয়নি।
হঠাৎ কেন এ নিয়ে এত আলোচনা?
সেই পুরনো গবেষণার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয় এবং ফলাফল PLOS Biology নামক জার্নালে প্রকাশিত হয় এই নভেম্বরেই। উক্ত প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়, আগের গবেষণায় চিনি গ্রহণের সাথে স্বাস্থ্যঝুঁকিকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এরপর থেকেই আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
আধুনিক গবেষণাটির সহ-রচয়িতা ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যক্ষ স্ট্যান্টন গ্ল্যান্টজ্ বলেন,
“আগের গবেষণাটিতে চিনির সাথে হৃদরোগের ঝুঁকির যে সংযোগ, সে সম্পর্কে আধুনিক ব্যাখ্যা রয়েছে। এবং তারা বেমালুম চেপে গেলেন এবং সবাইকে এই ব্যাখ্যা থেকে দূরে রেখেছেন দীর্ঘদিন।”
প্রতিটি খাদ্য সম্পর্কে আলাদা আলাদা গবেষণা করা যেমন সম্ভব হয়ে ওঠে না, তেমনই গবেষণা করা হলেও সবসময় সঠিক তথ্য প্রকাশিত হয় না। এর পেছনে রয়েছে সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিগুলোর প্রভাব। এই যেমন ধরুন চিনির ক্ষেত্রেই। চিনি ব্যবহৃত হয় যেসব খাবারে তারা কখনোই চাইবে না আপনি চিনির অপকারিতার জন্য তাদের পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকুন। ২০১৫ সালে ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় একটি চাঞ্চল্যকর তথ্যও এসেছিল। সেখানে বলা হলো কোকাকোলা কোম্পানি বিজ্ঞানীদের মোটা অংকের ঘুষ দিয়েছিল তাদের এই অতিরিক্ত চিনি মেশানো পানীয়ের সাথে স্থূলতার সংযোগকে যেন ভুল হিসেবে সাধারণ মানুষের নিকট প্রকাশ করা হয়। ‘দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ থেকেও একটি রিপোর্ট বের হয় যেখানে দেখানো হয় কীভাবে ক্যান্ডি তৈরির কোম্পানিগুলো মেকি গবেষণার অবতারণা করে বলে তাদের ক্যান্ডি খেলে বাচ্চারা মোটা হবে না যা অন্যান্য সুখাদ্যে হতে পারে।
রয়েছে আরও নানা ভীতিকর তথ্য। কোনো ইন্ডাস্ট্রির অর্থায়নে যখন কোনো গবেষণা চালানো হয়, তখনও মেকি ফলাফলের দেখা মেলে। তারা তাদের স্পন্সরের চাহিদা অনুযায়ী গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে থাকেন। এসকল তথ্য ওষুধ কোম্পানিগুলোর সাথেও সম্পর্কিত। তারাও অনেক ক্ষেত্রে আসল তথ্য চেপে গিয়ে নিজেদের জোর প্রশংসা চালিয়ে যান।
আবার ফিরে আসা যাক সেই চিনির গবেষণায়। প্রজেক্ট ২৫৯ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল ছিল সুক্রোজ এবং স্টার্চ গ্রহণের প্রভাবের পার্থক্য উল্লেখপূর্বক প্রথম জীববৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাগুলোর একটি। ২৭ মাস ধরে গবেষণা চালানোর পর অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়া হয় এবং গবেষণাও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আর শেষ করা হয় না। ফলাফল সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে উপস্থাপনও করা হয় না। আন্তর্জাতিক চিনি গবেষণা ফাউন্ডেশন (ISRF) কে প্রশ্ন করা হয়েছিল হঠাৎ করে অর্থায়ন বন্ধের পেছনে কী কারণ ছিল। জবাবে তারা কোনো সঠিক কারণ দেখাতে পারেনি, কিন্তু দায়ও নিজেদের উপর রাখেনি। তারা বলেন, তারা অনেক বড় বড় গবেষণা, অনেক বড় বড় আবিষ্কার করেছেন, এমনকি চিনি এবং স্বাস্থ্য নিয়েও। তাই তাদের বিরুদ্ধে তথ্য লুকানোর অভিযোগ সত্য নয়।
প্রজেক্ট ২৫৯ এর ফলাফল কী সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য?
এটি নিশ্চিতভাবে বলা খুবই কঠিন যে সেই প্রজেক্ট ২৫৯ এর গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল আসলেই নির্ভরযোগ্য কিনা। সকলে কত অতিরিক্ত চিনি মিশ্রিত মিষ্টি খাবারই না খেয়ে চলেছেন নিত্যদিন, আর এতে করে বাড়ছে হৃদরোগের ঝুঁকি। তবে অতিরিক্ত চিনি খেলে মূত্রাশয়ের ক্যান্সার বা অন্যান্য ক্যান্সার হতে পারে এ সম্পর্কে স্বচ্ছ প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি বলে জানান পুষ্টিবিভাগের অধ্যক্ষ ওয়াল্টার উইলেট। ইঁদুরের উপর চালানো গবেষণাগুলো মানুষের উপর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খাটলেও মানুষের ক্যান্সারের সাথে এটি অনেক বেশি পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত।
এখনো সেই গবেষণাকে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। গবেষণার শুরু যেহেতু হয়েছে, নতুন করে তথ্য যেহেতু পাওয়া গিয়েছে সেহেতু গবেষকদের আগ্রহের সৃষ্টি হয়ে নিশ্চয়ই এ বিষয়ে পরবর্তীতে আরও চাঞ্চল্যকর ফলাফল পাওয়া যাবে। তবে ইন্ডাস্ট্রিগুলো সে সুযোগ দিলেই হয়।
তাহলে কি চিনি খাবেন না?
গবেষণা থেকে এতটুকু বলা যায় যে অতিরিক্ত চিনি গ্রহণে হৃদরোগের ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু কতটুকু গ্রহণ করলে সেটিকে অতিরিক্ত বলা যাবে, তা সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে পরিমাণটি যদি হয় প্রতিদিন চায়ের কাপে এক চা চামচ বা টেবিল চামচ চিনি গ্রহণ, তাহলে এতো ভীত না হলেও চলবে। তবে বাইরের ফাস্ট ফুড বা কোমল পানীয় এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
ফিচার ইমেজ- uxdesign.cc