পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখাওয়া প্রদেশের হাঙ্গু জেলার পাহাড়ি এলাকার একটি গ্রাম ইবরাহিমজাই। এ গ্রামের একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ত আ’তজাজ হাসান নামের এক বালক, বয়স তার মাত্র ১৫ বছর। ছাত্র হিসেবে সে খুব একটা ভালো ছিল না। বয়সের তুলনায় দেখতেও সে অনেক বড় ছিল। ছয় ফুট লম্বা এবং বিশাল স্থূলকায় শরীরের জন্য বন্ধুরা প্রায়ই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত।
আফগানিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় তাদের জায়গাটি ছিল পাকিস্তানের সবচেয়ে অস্থিতিশীল এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। সন্ত্রাসী হামলা ছিল এখানকার মোটামুটি নিয়মিত ঘটনা। তাই আ’তজাজ হাসানের বন্ধুদের আড্ডাগুলোতেও প্রায় সময়ই বোমা হামলার ঘটনাগুলো স্থান পেত। ঠাট্টাচ্ছলে বন্ধুরা প্রায় সময়ই আ’তজাজকে উদ্দেশ্য করে বলত, তার শরীরের আকার এত বড় যে, বোমা তার কিছু করতে পারবে না।
তারা মাঝেমাঝেই আলোচনা করত, তাদের সামনে যদি কখনও কোনো আত্মঘাতী হামলাকারী পড়ে যায়, তাহলে কে কী করবে। আ’তজাজ সব সময়ই বলত, সে কখনোই হামলাকারীর ভয়ে পিছু হটে যাবে না। কোনো একদিন সে আত্মঘাতী সন্ত্রাসীকে ধরে ফেলবে। বন্ধুরা তার কথাকে কখনোই গুরুত্বের সাথে নিত না।
ঘটনার দু’দিন আগেও স্কুলের পেছনের পাহাড়ের উপরে বসে আ’তজাজ তার বন্ধুদের সাথে গল্প করছিল। সেদিনও তারা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল। তারা বলছিল, যদি কখনো তাদের উপর কেউ আক্রমণ করে, তাহলে আ’তজাজ তার বিশাল শরীর নিয়ে দৌড়ে পালিয়েও বাঁচতে পারবে না। অথচ তারা জানত না, মাত্র দু’দিন পরেই তাদের হাসির পাত্র, মোটাসোটা ছেলেটাই নিজের জীবন দিয়ে তাদের সহ স্কুলের শতাধিক ছাত্রের জীবন রক্ষা করবে।
দু’দিন পর, ২০১৪ সালের ৬ই জানুয়ারি, সকাল বেলা। স্কুলে যেতে দেরি হওয়ায় আ’তজাজকে জাতীয় সঙ্গীতে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। শাস্তি হিসেবে তাকে স্কুল কম্পাউন্ডের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। স্কুলের বাইরে যখন সে তার বন্ধুদের সাথে গল্প করছিল, তখন তারা দেখতে পায় ২০-২৫ বছর বয়সী এক লোক স্কুল ড্রেস পরে স্কুলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। লোকটিকে দেখেই আ’তজাজের সন্দেহ হয়, কারণ এর আগে তাকে কখনো স্কুলে দেখা যায়নি। আ’তজাজ এগিয়ে গিয়ে লোকটিকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, সে স্কুলে ভর্তি হতে যাচ্ছে।
এমন সময় আ’তজাজের এক সহপাঠী লক্ষ্য করে, লোকটির স্কুলড্রেসের ভেতর সুইসাইড ভেস্ট জাতীয় কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। তার বন্ধুদের অনেকেই দৌড়ে সেখান থেকে সরে গেল, কেউ স্কুলের ভেতরে ছুটে গেল কর্তৃপক্ষকে খবর দেওয়ার জন্য। কিন্তু বন্ধুদের বাধা সত্ত্বেও আ’তজাজ ছুটে গেল সোজা হামলাকারীর দিকে।
ধস্তাধস্তিতে সন্ত্রাসীটি ঘাবড়ে যায় এবং এক পর্যায়ে উপায় নেই দেখে স্কুলের বাইরে আত্মঘাতী বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয়। ঘটনাস্থলেই হামলাকারী নিহত হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় আ’তজাজকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একদিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আ’তজাজ। স্কুলের শত শত ছাত্রের জীবন বাঁচিয়ে সে নিজে যাত্রা করে অনন্ত পরকালের উদ্দেশ্যে।
আ’তজাজের স্কুলটিতে প্রায় ২,০০০ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। সেদিন আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের সময় ঘটনার অদূরেই অন্তত ৭০০ ছাত্রছাত্রী অ্যাসেম্বলিতে অংশগ্রহণরত ছিল। আ’তজাজ তার নিজের জীবনের বিনিময়ে সেদিন তাদের রক্ষা না করলে এটা হতে পারতো পাকিস্তানের ইতিহাসের আরেকটি করুণ ট্র্যাজেডি। তার সম্মানে বর্তমানে স্কুলটির নামকরণ করা হয়েছে আ’তজাজ হাসান শহিদ হাই স্কুল।
নিম্ন-মধ্য আয়ের পরিবারের সন্তান আ’তজাজ হাসানের বাবা মুজাহিদ আলি বাঙ্গাশ আরব আমিরাতের দুবাইতে ট্যাক্সি চালানোর কাজ করতেন। ছেলের মৃত্যুর সংবাদ শুনে তিনি দেশে ছুটে আসেন। এএফপির সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তিনি গর্বিত যে তার ছেলে একটা সৎ উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ করে শহিদ হয়েছে। তার ভাষায়, তিনি ছেলের মৃত্যুতে শোক করার জন্য দেশে আসেননি, তিনি এসেছেন তার মহৎ জীবনকে উদযাপনের জন্য।
সাংবাদিকদেরকে তিনি বলেন, “অনেক মানুষ আসছে আমাকে দেখার জন্য, সান্তনা দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি তাদেরকে বলি, তোমরা আমাকে সান্তনা দিও না, বরং আমাকে অভিনন্দন জানাও যে, আমি একজন শহিদের পিতা। আমি আরও খুশি হব যদি আমার আরেক সন্তানও দেশের জন্য এভাবে আত্মত্যাগ করে।” তিনি আরও বলেন, “আমার ছেলে তার মাকে কাঁদিয়েছে, কিন্তু সে শত শত মাকে কান্নার হাত থেকে বাঁচিয়ে গেছে।”
আ’তজাজ হাসানের আত্মত্যাগ সেসময় পাকিস্তানে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। শত শত মানুষ টুইটারে #onemillionaitzaz এবং #AitzazBraveheart হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে তার প্রতি সম্মান জানাতে থাকে।
পাকিস্তানের জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম আ’তজাজকে ‘মুজাহিদ’ উপাধি দেয় এবং তাকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করে। অনেকে অবশ্য এই ঘটনায় পাকিস্তান সরকারের সমালোচনাও করেন। ডন পত্রিকার এক সাংবাদিক লিখেন, “আমরা এমন এক দেশে বাস করি, যেখানে ছোট একটি শিশুকে সন্ত্রাসের সাথে লড়াই করে জীবন দিতে হয়েছে, যেই সন্ত্রাসের প্রতি আমাদের নেতারা ঝুঁকে আছে তাদেরকে তৃপ্ত করার জন্য।”
মানুষ আ’তজাজের বীরত্ব এবং সাহসিকতার স্বীকৃতি হিসেবে সরকারের প্রতি তাকে মরণোত্তর জাতীয় পুরস্কার প্রদানেরও আহ্বান জানায়। সাংবাদিক নাসিম জোহরা টুইটে লিখেন, “আমরা নাগরিকরা বিশ্বাস করি, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবশ্যই পাকিস্তানের সাহসী সন্তান শহিদ আ’তজাজকে নিশান-ই-হায়দার পুরস্কার দেওয়া উচিত।” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত লিখেন, “হাঙ্গুর শহিদ আ’তজাজ হাসান হচ্ছে পাকিস্তানের গর্ব। তাকে অন্তত একটা মেডেল দেওয়া হোক।”
পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার আ’তজাজকে পাকিস্তানের সম্মানজনক বেসামরিক সম্মান ‘সিতারা-ই-সুজাত’-এ ভূষিত করে। পাকিস্তানের জাতীয় দিবস ২৩ মার্চ আ’তজাজের পরিবারের হাতে এ পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন (IHRC) আ’তজাজকে গ্লোবাল ব্রেভারি অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করে। ২০১৬ সালে বিখ্যাত পাকিস্তানি পরিচালক শাহজাদ রফিক আ’তজাজের আত্মত্যাগের কাহিনী নিয়ে Salute নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
আ’তজাজদের হাঙ্গু এলাকাটি মূলত শিয়া প্রধান এলাকা। সেখানে আল কায়েদা, তালেবান, লস্করে জঙ্গী সহ আরও কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠির প্রবল উপস্থিতি আছে, যারা এর আগেও শিয়াদের উপর আক্রমণ করেছিল। সেসব হামলার সময়েও অনেকেই অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু আ’তজাজের মতো মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সন্ত্রাসীর মুখোমুখি হওয়ার সাহস এর আগে কেউই দেখাতে পারেনি।
এই হামলার জন্য প্রাথমিকভাবে তালেবানকে সন্দেহ করা হলেও, পরবর্তীতে জঙ্গী সংগঠন লস্করে জঙ্গী এর দায় স্বীকার করে। ঘটনার পর দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও হাঙ্গু এলাকাটি এখনও সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এ বছরের এপ্রিলেও আ’তজাজের পরিবারের কাছে জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একটি চিঠি আসে, যেখানে তাদেরকে হুমকি দেওয়া হয় এই বলে যে, তারা যেন মিডিয়া এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ না করে।
চিঠিতে বলা হয়, আ’তজাজ হাসান কোনো হিরো না। তাকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা হলে পরবর্তী ঘটনার জন্য তার পরিবারই দায়ী থাকবে। পাকিস্তানের জিও টিভির সংবাদ অনুযায়ী, স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা না পেয়ে আ’তজাজের পরিবার এখন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করছে, যেন তাদেরকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া হয়। যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আ’তজাজ জীবন দিয়ে গেছে, সেই সন্ত্রাসের শিকার যেন অন্তত ঐ এলাকায় অন্য কাউকে না হতে হয়।