যৌন কেলেঙ্কারিতে বাতিল সাহিত্যের নোবেল: প্রতিবাদে এলো বিকল্প পুরস্কার

যৌন কেলেঙ্কারির বিতর্কে জেরবার কর্তৃপক্ষ ২০১৮ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বাতিল ঘোষণা করেছে। বিগত ৭০ বছরে নোবেল বিলম্বন বা বাতিলের ঘটনা এই প্রথম! কর্তৃপক্ষের প্রতি প্রতিবাদস্বরূপ ‘দ্য নিউ অ্যাকাডেমি’ নামে এক সংগঠন নোবেলের বিকল্প হিসেবে চালু করেছে এক নতুন সাহিত্য পুরস্কার। এই আয়োজনে শতাধিক সুইডিশ বুদ্ধিজীবী থাকলেও সেরা সাহিত্যিক বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় আপনিও দিতে পারবেন ভোট! কেন বাতিল হলো এবারের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার, কেনই বা এলো এই নতুন পুরস্কারের ডাক, কীভাবেই বা নির্বাচিত হবেন সেরা সাহিত্যিক- সেসবের খবরাখবর নিয়েই এই প্রতিবেদন।

শুধু নোবেল সাহিত্য পুরস্কারই কেন বাতিল হলো?

প্রথমত, নোবেলের ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদানের কর্তৃপক্ষও পৃথক, যেমন- পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে রয়েল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস; চিকিৎসাশাস্ত্রে ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের নোবেল অ্যাসেম্বলি, শান্তিতে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি এবং সাহিত্যে সুইডিশ অ্যাকাডেমি।

১৭৮৬ সালে রাজা তৃতীয় গুস্তাভ সুইডিশ অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি মূলত চালিত হয়ে আসছে সুইডেনের অভিজাত সাহিত্যবোদ্ধা শ্রেণীর দ্বারা। ২০১৭ সালের নভেম্বরে অন্তর্জালের আলোচিত ‘#metoo’ আন্দোলনে বেরিয়ে আসে এক থলের বেড়াল- অ্যাকাডেমির সদস্য ও জুরি কাতারিনা ফ্রস্তেনসনের স্বামী জিন-ক্লড আর্নল্টের দ্বারা ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহের স্বীকার হয়েছেন ১৮ জন নারী (অবশ্য জুনে সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত)! এসবের সাথে এপ্রিল-মে নাগাদ ফাঁস হতে থাকে কিছু নোবেল বিজয়ীর নামও। অ্যাকাডেমির জন্য এই সংবাদ অত্যন্ত বিব্রতকর হয়ে দাঁড়ায়।

জিন-ক্লড আর্নল্ট;  Image Source: The Guardian

অবশেষে এ বছরের মে মাসের ৪ তারিখ সুইডিশ অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে আসে বিবৃতি। রাজা ষোড়শ কার্ল জানান, বিতর্কে টালমাটাল অ্যাকাডেমির প্রতি জনগণের আস্থা পুনরায় ফেরাতে আপাতত তারা সময় নেওয়াকেই সেরা সমাধান ভাবছেন। জানানো হয়, নোবেল পুরস্কার ঘোষণা না করে এবার তারা মনযোগ দিতে চান অ্যাকাডেমির হারানো সম্মান পুনরোদ্ধারের। গত বছরই অবশ্য অ্যাকাডেমি একদফা বিতর্কিত হয়েছিলো বব ডিলানের সাহিত্যে নোবেল প্রসঙ্গে। তবে সে বিতর্ক এইবারের মতো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব দিক নিয়ে ছিল না, ছিল সাহিত্যের পর্যালোচনাভিত্তিক।

সুইডিশ অ্যাকাডেমির বাইরে জনতার বিক্ষোভ; Image Source: The Guardian

তবে কি ব্রাত্যই থেকে যাবে ‘১৮ এর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার? না, সেটিও ঘোষিত হবে। তবে এক বছর বাদে। ২০১৯ সালের বিজয়ীর সঙ্গেই একত্রে উচ্চারিত হবে ২০১৮ সালের বিজয়ীর নাম!

ওদিকে এই ঘটনার পর লেখক, অভিনেতা, সাংবাদিকসহ সুইডেনের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ১০৭ বুদ্ধিজীবী মিলে সুইডিশ অ্যাকাডেমির বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ গঠন করেন ‘দ্য নিউ অ্যাকাডেমি’ নামে এক সংগঠন। সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রথম ধারণাটি এসেছিল বিখ্যাত সুইডিশ লেখিকা আলেক্সান্দ্রা প্যাসকেলিদোর থেকে এবং তা ছিল মূলত ২০১৮ এর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বাতিলের ঘোষণার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ। সংগঠনটির বিবৃতি অনুযায়ী-

আমাদের এ সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই হলো সকলকে একটি ব্যাপার মনে করিয়ে দেওয়া। তা হলো, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উচিত সর্বতভাবে পক্ষপাতদুষ্ট অহম বা লৈঙ্গিক অসমতার ঊর্ধ্বে উঠে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, সহমর্মিতা, শ্রদ্ধাকে তুলে ধরা।

আলেক্সান্দ্রা প্যাসকেলিদো; Image Source: Sputnik News

বিবৃতি থেকে হয়তো বুঝতেই পারছেন, অ্যাকাডেমির প্রতি তাদের ক্ষোভটা ঠিক কোন জায়গা থেকে আসছে। তারা মনে করেন, অ্যাকাডেমির পুরুষতান্ত্রিক আচরণ নতুন নয় এবং এ বলয় থেকে বেরিয়ে আসবার প্রয়োজন রয়েছে। সেই সঙ্গে সুইডিশ অ্যাকাডেমির নিজস্ব ভুলের মাশুল কেন লেখকের গুনতে হবে, এ আপত্তিও ছিল ‘দ্য নিউ অ্যাকাডেমি’র বুদ্ধিজীবীদের। তাই নিজেদের সংগঠনের ব্যানারে নতুন সাহিত্য পুরস্কার চালুর ঘোষণা দেন তারা।

ইতোমধ্যে সুইডেনের সকল গ্রন্থাগারিকের কাছে দুইজন লেখকের নামের মনোনয়ন জমা দিতে বলা হয়েছে। শর্তে বলা হয়েছিল, অন্তত দুটো বই লিখেছেন এমন যেকোনো দেশীয় লেখককে মনোনীত করা যেতে পারে, যার শেষ বইটি বিগত ১০ বছরের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। মনোনয়ন প্রদান শেষ হয়েছে ৮ জুলাইতে। ৪৬ জনের এই তালিকায় জে কে রোলিং, করম্যাক ম্যাককার্থি, হারুকি মুরাকামি, আমোস ওজ, প্যাটি স্মিথ প্রমুখ প্রথিতযশা লেখকের সঙ্গে আছেন সোফি ওকসানেনের মতো অপেক্ষাকৃত আনকোরা মুখও! এ তালিকা থেকে পাঠকরা তাদের পছন্দের লেখকে ভোট দিতে পারবেন ১৪ আগস্ট পর্যন্ত। ভোট দিতে ভিজিট করুন এখানে।

এ প্রক্রিয়ায় আমজনতার ভোটে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হবেন ৪ জন। উল্লেখ্য, এই চারজনের মধ্যে ২টি আসন আবার লিঙ্গ কোটায় সংরক্ষিত থাকবে, অর্থাৎ ৪ জনের তালিকায় থাকবেন দুজন পুরুষ ও দুজন নারী। নোবেল সাহিত্য পুরস্কার জয়ী ১১৪ জনের মধ্যে মাত্র ১৪ জন ছিলেন নারী। যেহেতু সুইডিশ অ্যাকাডেমি তথা নোবেলের লৈঙ্গিক অসমতা বিতর্কের প্রতিবাদেই এই পুরস্কারের আবির্ভাব, তাই লিঙ্গ কোটা রেখে তারা চাইছেন পুরস্কারটিকে ‘বৈষম্যমুক্ত’ রাখতে।

প্রতীকী ছবি; গ্রহণ লেগেছে নোবেল পুরস্কারে, কলঙ্কের রাহু করছে গ্রাস! Image Source: Mark Pernice

এরপর সম্পাদক অ্যান পালসন, গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিসবেথ লারসন ও গ্রন্থাগারিক গানিলা স্যান্ডিনের নেতৃত্বে গঠিত বোর্ড কর্তৃক নির্বাচিত চূড়ান্ত বিজয়ীর নাম ঘোষিত হবে ১৪ অক্টোবরে, নোবেলের মৌসুমেই। পুরস্কারটি দেওয়াও হবে ১০ ডিসেম্বর, যেটি কিনা নোবেলের জাঁকালো পুরস্কারপ্রদান আয়োজনের ঐতিহ্যবাহী তারিখ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ঠিক তার পরদিনই বিলুপ্ত ঘোষিত হবে ‘দ্য নিউ অ্যাকাডেমি’ সংগঠনটি!

পুরস্কারটির মূল্যমান ১ মিলিয়ন ক্রোনার বা প্রায় ১,১২,০০০ মার্কিন ডলার, ‘আসল’ নোবেলের তুলনায় আর্থিক মানে বেশ নগন্য তো বটেই। তবে নৈতিক বিবেচনায় একে বেশ সাহসী পদক্ষেপ হিসেবেই অভিহিত করছেন সংশ্লিষ্টরা। পুরস্কারটিকে তারা শুধু পুরস্কার হিসেবে নয়, বরং দেখছেন অভিজাত শ্রেণীতে যুগ যুগ ধর বেঁচে থাকা যৌন অসংবেদনশীলতা ও লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাহিত্যপ্রেমীদের উদারবাদী প্রতিবাদ হিসেবে।

Featured Image Source: Jonathan Nackstrand/Agence France-Presse — Getty Images

Related Articles

Exit mobile version