আপনি যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাথে কথা বলবেন এবং তাদের কাছে ‘শিশু অপরাধ’ বা ‘যৌন পেশা’ সম্পর্কে জানতে চাইবেন, তখন তারা বলবেন-
এসবের সাথে জড়িত অধিকাংশ শিশু অন্য দেশের নাগরিক। তারা অবৈধ পন্থায় যৌনকর্মী হিসেবে আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে।
কিন্তু বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশটির প্রায় ৮৩ শতাংশ যৌনকর্মী স্বদেশীয় অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাচারকারীদের মাধ্যমে যৌন পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রগতিশীল দেশে, যেখানে বৈধ পন্থায় যৌনতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণের সুযোগ রয়েছে, সেখানে আমাদের আতঙ্কের জায়গা অন্যত্র। আর তা হলো, এই ৮৩ শতাংশের মধ্যে বড় একটি অংশ বয়সে শিশু বা অপ্রাপ্ত বয়স্কা যৌন কর্মী।
২০১৬ সালে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, শুধুমাত্র টেক্সাস শহরেই প্রায় ৭৯,০০০ শিশু পাচারের শিকার হয়ে এই পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। এই শিশুদের অধিকাংশ পাচারের সময় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যা তাদেরকে সহজে এই পথে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, পাচারকারীরা সাধারণত গৃহহীন শিশু, পথশিশু ও সন্তান লালন-পালন কেন্দ্রে থাকা শিশুদের টার্গেট করেন এবং সুকৌশলে তাদের এই অন্ধকার পথে নিয়ে আসেন।
যুক্তরাষ্ট্রে যৌন পাচার ও সহিংসতা বন্ধে অনেকদিন যাবত কাজ করছেন ব্রুক অক্সটেল। এজন্য তিনি ‘শি ইজ রাইজিং’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ‘বিউটিফুল জাস্টিস: রিক্লেইমিং মাই ওর্থ আফটার হিউম্যান ট্রাফিকিং অ্যান্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ’ নামক একটি বইও লিখেছেন। তিনি বলেন,
একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমি আমার বহু বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি; এবং এই অন্ধকার জগত থেকে যেসব মেয়েদের ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি তাদের কাছ থেকে জেনেছি; পাচারের সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের ঘনিষ্ঠজনরা যুক্ত থাকেন। কথিত প্রেমিক কিংবা তত্ত্বাবধায়করাই তাদের এমন সর্বনাশের পথে নিয়ে আসেন। ভুল বুঝিয়ে, মানসিক চাপ দিয়ে, মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে অথবা সরাসরি অপহরণের মাধ্যমে তাদেরকে তারা পাচারকারীদের হাতে তুলে দেন।
দেশটির ‘ন্যাশনাল হিউম্যান ট্রাফিকিং হটলাইন’ নামক একটি সংস্থার প্রতিবেদনেও ব্রুক অক্সটেলের দাবির সত্যতা পাওয়া যায়। সংস্থাটি জানায়, পাচারকারীরা এই কাজের জন্য কথিত প্রেমিক ও ডেটিং পার্টনারদের নিযুক্ত করে। গবেষণায় দেখা যায়, পাচারকারীদের এই কৌশলেই সর্বাধিক সাফল্য অর্জন করে।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই
ব্রুক অক্সটেল তার ‘বিউটিফুল জাস্টিস: রিক্লেইমিং মাই ওর্থ আফটার হিউম্যান ট্রাফিকিং অ্যান্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ’ গ্রন্থে দুই আমেরিকান তরুণীর জীবনে ঘটে যাওয়া বাস্তব একটি গল্প তুলে ধরেছেন। তারা একজন পুরুষের ধোকায় পড়ে যৌন পাচারের শিকার হয়েছিলেন। ওই দুই তরুণী একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন, এমন সময় তারা একটি বিশেষ সমস্যায় পড়েন। এবং তখন ওই পুরুষ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং একজন প্রকৃত বন্ধুর ন্যায় আচরণ করেন। এতে তারা উক্ত পুরুষকে বিশ্বাস করে ফেলেন এবং এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উক্ত পুরুষ তাদেরকে যৌন ব্যবসায়ীদের কাছে পাচার করে দেন। যদিও ওই দুই তরুনী অত্যন্ত প্রাণচঞ্চল ও সাহসী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তবে পরবর্তীতে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় তারা অন্ধকার জগত থেকে ফিরে আসতে সক্ষম হন। এই ঘটনাটি তুলে ধরার কারণ হলো, এটি পাচারকারীদের অতি ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি। ব্রুক অক্সটেল বলেন,
এটি ছিল ২০১৬ সালের ঘটনা। টেক্সাসের অধীনস্থ অস্টিন ফেডারেল আদালতে তাদের বিচার কাজ শুরু হয়। টেক্সাসের অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর থেকে আমাকে ওই দুই মেয়েকে আইনি সহায়তা দিতে বলা হয়। আদালতে প্রথম যেদিন আমি তাদের সাথে সাক্ষাত করি তখন তাদের বয়স ছিল যথাক্রমে ১৫ ও ১৭ বছর। এর মধ্যে ছোট মেয়েটির নাম লিলি। লিলি খুব সাহসী ও স্পষ্টভাষী মেয়ে। অন্যদিকে বড় মেয়েটির নাম কায়েস (ছদ্মনাম), সে ছিল বেশ হতাশাগ্রস্থ ও চাপা স্বভাবের।
বিচার কাজে সহায়তা প্রদান করতে গিয়ে ব্রুক অক্সটেল তাদের সাথে অনেক কথা বলার সুযোগ পান। তাদের জীবনের গল্পগুলো ব্রুক মন দিয়ে শোনেন। একদিন ব্রুক নিজেও তার জীবনের গল্পগুলো লিলি ও কায়েসের সামনে তুলে ধরতে থাকেন। লিলি ও কায়েস জানতে পারে ব্রুকের জীবনেও তাদের মতো অন্ধকার সময় নেমে এসেছিল। ব্রুক অক্সটেল তাদেরকে বলেন,
তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর। একদিন আমার মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেই সুযোগে আমার ন্যানি (শিশুপালনকারী) আমাকে পাচারকারীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
এই ঘটনা শুনে লিলি ব্রুক অক্সটেলকে জিজ্ঞাসা করেন,
তারপর সেই ন্যানির কী হয়েছিল?
জবাবে ব্রুক অক্সটেল বলেন,
আমি তার সম্পর্কে পরে আর কিছু জানতে পারিনি। সে পালিয়ে গিয়েছিল। আমি তখন বয়সে এতটা ছোট ছিলাম যে, আমার সাথে সেদিন কী ঘটছিল তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
লিলি তাকে ফের জিজ্ঞাসা করলো,
তার মানে তুমি আর কোন দিন সেই ঘটনার ন্যায়বিচার পাওনি?
ব্রুক অক্সটেল বললো,
না, আমি কখনো সেই অন্যায়ের বিচার পাইনি। তবে আমি আমার কর্মের মধ্য দিয়ে নিজের ওপর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করেছি।
ব্রুক অক্সটেলের গল্প শুনতে শুনতে লিলিও একপর্যায়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। লিলি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনিও ব্রুক অক্সটেলের মতো নিজের ওপর নিজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। অর্থাৎ এখন থেকে তিনি ব্রুক অক্সটেলের সাথে শিশু যৌন পাচার ও সহিংসতা প্রতিরোধে কাজ করবেন। তাই একদিন আদালতে হাঁটতে হাঁটতে লিলি ব্রুক অক্সটেলকে বললেন,
ব্রুক, আমি নিজের জন্য এই পথে আসতে চাই। পাশাপাশি তোমার জন্যও আমি এই পথে আসতে চাই। কেননা তুমি কখনো তোমার জীবনে ঘটে যাওয়া অপরাধের ন্যায় বিচার পাওনি।
ব্রুক অক্সটেল তখন তৃপ্তির হাসি হেসে, চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে লিলিকে বললেন,
তুমি দুঃসাহসী।
তবে লিলি ও কায়েস তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের ন্যায়বিচার পেয়েছেন। যদিও পাচারকারীর আইনজীবীরা নানা মিথ্যা তথ্য দিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু লিলি ও কায়েস আদালতের সামনে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন। তাদের যুক্তি-তর্কে আদালত প্রসন্ন হয়েছেন। ফলে ফেডারেল আদালত তাদের পাচারের সাথে যুক্ত সেই ব্যক্তিকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেছে। এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে শক্তিশালী করবে নিঃসন্দেহে।
শিশুদের সুরক্ষায় আমাদের করণীয়
ব্রুক অক্সটেলের সাথে লিলিও বর্তমানে শিশু ও নারীদের সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন। তারা পাচারকারীদের হাত থেকে শিশুদের সুরক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশেষত, শিশুদের কাছে পারাকারীদের বৈশিষ্ট্য ও পাচারের পদ্ধতিসমূহ তাদের সামনে তুলে ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে শিশুরা যেন কোন মানসিক সঙ্কট বা আতংকগ্রস্থ না হন, সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
পাচারকারীরা সাধারণত তিনটি ধাপে এই কাজ সম্পন্ন করে। প্রথমত, টার্গেটকৃত শিশু বা নারীকে তারা বড় বড় স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন। তারপর তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যান এবং ক্রমান্বয়ে আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকেন। তারপর একপর্যায়ে তাদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন এবং যৌনতাসহ নানা অবৈধ কাজে যুক্ত হতে বাধ্য করেন।
রাতারাতি এই অপরাধ চক্রকে দমন করা সম্ভব নয়। তবে ব্রুক অক্সটেলদের দেখানো পথ ধরে বিশ্বের সর্বাধিক প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বুকে ঘটতে থাকা এমন অপরাধ ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যাবে- এটাই সকলের প্রত্যাশা।