কিংবদন্তী ফিলিস্তিনী কার্টুনিস্ট নাজি আল-আলি: জীবন, কর্ম ও হত্যা সমাচার

২২ জুলাই, ১৯৮৭। কুয়েতি সংবাদপত্র আল ক্বাবাসের লন্ডন দপ্তরের সামনে আততায়ীর গুলিতে গুরুতর আহত হন ফিলিস্তিনের বিখ্যাত কার্টুনিস্ট নাজি আল-আলি। প্রায় মাসখানেক চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তখন আততায়ীর কোনো হদিস করতে পারেনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। কিন্তু ফিলিস্তিনি কিংবদন্তি এই কার্টুনিস্টের অমীমাংসিত মৃত্যুরহস্য আবারও এসেছে আলোচনায়। কারণ, গত মঙ্গলবার অর্থাৎ, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ লন্ডন পুলিশ নাজি আল-আলির কেসটি রি-ওপেন করেছে।

টাইমস ম্যাগাজিন বলেছে, “নাজি আল-আলি নাকি মানুষের হাঁড়কে তার তুলি বানিয়ে নিয়েছে!”

সেই কিংবদন্তি কার্টুনিস্টের জীবন, কাজ এবং মৃত্যুর বিভিন্ন মোটিভ নিয়ে আলোকপাত করা হলো আজকের আলোচনায়।

নাজি আল-আলি (১৯৩৬-১৯৮৭); © Alaraby TV

ফিলিস্তিনের অন্তর্গত গ্যালিলির আল-শাজারা গ্রামে ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন নাজি। পুরো নাম নাজি সালিম হুসাইন আল-আলি। ১৯৪৮ সালের আগে নাজির গ্রামে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদীদের সৌহার্দপূর্ণ সহাবস্থান ছিলো। একে অন্যের সাথে মিলেমিশে তারা শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতেন।

কিন্তু ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার ফলশ্রুতিতে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ ফিলিস্তিনি ঘর বাড়ি ছেড়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে যায় কিংবা তাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। নাজির পরিবারের ঠিকানা হয় দক্ষিণ লেবাননের আইন আল হিলওয়া শরণার্থী শিবিরে। শরণার্থী জীবনের এই অভিজ্ঞতা তার কাজে, চিন্তায় ছাপ ফেলে গেছে ভীষণভাবে।

নিজের পরিবেশে, নিজ গ্রামে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের মাঝে বেড়ে ওঠার যে পরিচিত পরিবেশ, তা রাতারাতি হারিয়ে যায় নাজির জীবন থেকে। দশ-বারো বছরের শিশুমনে তা খুব বড় ধরনের আঘাত ছিল, হঠাৎ করে ঘরবাড়ি সব ছেড়ে তাঁবুর জীবন শুরু হলো।

নাজি আল-আলি নাকি মানুষের হাঁড়কে তার তুলি বানিয়ে নিয়েছে! © Naji al-Ali

তখন থেকে নাজির লক্ষ্য ছিলো একটাই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ফিলিস্তিনে নিজ গ্রামে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তার কাছে মনে হতো, এটা তো জটিল কোনো বিষয় নয়! নিজের দেশে কেন তিনি ফিরতে পারবেন না?

সর্বহারা পরিবারের দায়িত্ব নিতে নাজি প্রথম চাকরি নেন মেকানিক হিসেবে, উপসাগরীয় এলাকায়। তারপর চলে যান কুয়েতে, সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হন। সেটা মোটামুটি সত্তরের দশকের শুরুতে। কুয়েতে তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি ভর্তি হন এক আর্ট স্কুলে, ছবি আঁকার হাতেখড়ি মূলত সেখানেই। তারপর কয়েক বছরের মধ্যে তিনি সংবাদপত্রের জন্য কার্টুন আঁকতে শুরু করেন।

যে তেলের জন্য আরব বিশ্বে আমেরিকা-ইজরায়েলি আগ্রাসন; © Naji al-Ali

মধ্যপ্রাচ্যের মতো জায়গায় মত প্রকাশ এবং জনসাধারণকে কোনো বিষয়ে প্রভাবিত করার জন্য কার্টুন একটি শক্তিশালী মাধ্যম। কেননা, সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই নিরক্ষর। নাজি আল-আলি সেই পথটিই বেছে নেন।

১৯৮২ সালে তিনি ছিলেন বৈরুতে। লেবাননে ইজরায়েলি আগ্রাসন দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে। সাব্রা আর সাতিলা শরনার্থী শিবিরের গণহত্যা তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিলো। তাই দেখা যায়, বিরাশির পর থেকে তার আঁকা ছবিগুলোয় কী যেন পরিবর্তন হয়ে যায়। এ ছবিগুলো হয়ে ওঠে আরো বেশি প্রতীকি, আরও বেশি শক্তিশালী।

তখনকার সময়ে আরব পত্রিকাগুলোর প্রবণতা ছিলো ইজরায়েল এবং ইজরায়েল বিষয়ে আমেরিকার নীতিকে কটাক্ষ করে বিভিন্ন কার্টুন প্রকাশ করা। কিন্তু নাজি শুধুমাত্রই আমেরিকা আর ইজরায়েলের নীতির সমালোচনা করেননি, তিনি আরব বিশ্বের দিকেও বিদ্রুপের আঙুল তুলেছিলেন। আরব লিগের নেতৃত্ব, তেলখাতে দুর্নীতি, ফিলিস্তিনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত ও ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা বা পি. এল. ও. এবং আরবের গোষ্ঠীতন্ত্রের বিরুদ্ধে বারে বারে নানা অভিযোগের আঙুল তুলেছেন তিনি। আদতে আরব কিংবা অনারব, যারাই ফিলিস্তিনের স্বার্থ পশ্চিমাদের কাছে বিকিয়ে দিয়েছে, তাদের সবার বিরুদ্ধেই তিনি কার্টুনের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন।

নাজি শুধুমাত্রই আমেরিকা আর ইজরায়েলের নীতির সমালোচনা করেননি, তিনি আরব বিশ্বের দিকেও বিদ্রুপের আঙুল তুলেছিলেন © Naji al-Ali

তাই বৈরুতেও তার বেশিদিন থাকা হয়নি। ১৯৮৩ সালে তাকে বৈরুত ছাড়তে বাধ্য করা হয়, তিনি চলে যান কুয়েতে। এই বারে বারে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হওয়া তাকে তার কাজ থেকে একটুও সরাতে পারেনি। বরং দিনে দিনে তার প্রতিবাদের ভাষা আরো জোরালো হয়েছে, তার জনপ্রিয়তা বেড়েঠে বিশ্বব্যাপী। দুই বছর বাদেই তাকে কুয়েত ছাড়তেও বাধ্য করা হয়। ১৯৮৫ সালে তিনি চলে যান লন্ডনে। আর তার দুই বছর পর আল ক্বাবাস পত্রিকায় কর্মরত অবস্থায় তার অফিসের সামনেই আততায়ীর গুলিতে মারাত্মক আহত হন নাজি আল আলি।

নাজির বড় ছেলে খালিদ আল-আলি, বাবার কাজ সম্পর্কে খুব ভালো জ্ঞান রাখেন তিনি। নাজির কাজ নিয়ে ২০০৯ সালে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন খালিদ, নাম ‘A Child of Palestine’। তিনি বলেন,

আমার বাবা জানতেন, তার কাজ তার মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। কিন্তু ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকার মানুষ তিনি নন। তিনি মনে করতেন না, কার্টুনিস্ট হিসেবে তার কাজ শুধু মানুষকে হাসানো। তিনি চাইতেন, আপনি ভাবুন!

মৃত্যুর পর আল ক্বাবাস পত্রিকার সম্পাদক বলেন,

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাকে বারে বারে হুমকি দেওয়া হচ্ছিলো। কিন্তু তিনি বাড়িতে থাকতে নারাজ ছিলেন। তিনি মৃত্যুকে ভয় পেতেন না। জীবনকে অবশ্যই ভালোবাসতেন, কিন্তু তার ছবির মাধ্যমে তিনি যে বার্তা দিতে চাইতেন, তার সাথে ন্যূনতম আপোষ তিনি কখনও করতেন না। যা বলার দরকার তিনি বলতেন, যা আঁকার দরকার তিনি আঁকতেন।

নাজি আল-আলির কার্টুন

নাজি আল-আলির আঁকা কার্টুনগুলোতে আমরা চারটি চরিত্রকে বারংবার দেখতে পাই। এরা হলো হানযালা, ফাতিমা, ভালো মানুষ (The Good Man) এবং খারাপ মানুষ (The Evil Man)।

নাজি আল আলির চার চরিত্র; © Omaima Al-Ansari/Naji al-Ali

এদের মধ্যে হানযালা এতোটাই বেশি আইকনিক এবং জনপ্রিয় ছিলো যে, সে নাজির সিগনেচারে পরিণত হয়েছিলো। হানযালা শব্দের অর্থ তিক্ততা। তাকে প্রথমবারের মতো আমরা দেখতে পাই ১৯৬৯ সালে। সে দরিদ্রপীড়িত ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিশু। বয়স দশ বছর, মাথায় খোঁচা খোঁচা চুল, হাত দুটো পেছনে বেঁধে দর্শকের দিকে পিঠ ফিরিয়ে কার্টুনের তুলে ধরা ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পরিস্থিতি তার অনুকূলে না। সে বিব্রত হয়, কিসের যেন হিসাব মেলে না তার। সে নীরব পর্যবেক্ষক হলেও চূড়ান্ত মূহুর্তে সে প্রতিবাদ করতে পিছপা হয় না।

হানযালা, পিছে হাত বেঁধে শিশুমনে কিছু পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত; © Naji al-Ali

হানযালা সম্পর্কে নাজি বলেন,

আমি তাকে দরিদ্র মানুষের প্রতিনিধি করে গড়ে তুলেছি। তার নাম দিয়েছি হানযালা, সে তিক্ততার প্রতীক। প্রথমে সে ছিলো একটি ফিলিস্তিনি শিশু। কিন্তু ক্রমশ তার চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে দেশ, জাতি, বিশ্বজগৎ ও সর্বোপরি মানবসমাজ। সে খুবই সাদাসিধে ছেলে, কিন্তু খুবই শক্তমনের। তাই মানুষ তাকে আপন করে নিয়েছে। তাদের মনে হয়েছে, সে তাদের বিবেকের প্রতিনিধি।

দশ বছর বয়সের ছোট্ট শিশু হানযালা, তার বয়স বাড়েনি। সময় তার শরীরে থমকে আছে। আমি ওই বয়সে ফিলিস্তিন ছেড়েছিলাম। আমরা যখন ফের বাড়ি ফিরতে পারবো, তখন থেকে হানযালা বড়ো হতে থাকবে। আরব বিশ্বের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে এবং ফিলিস্তিন তার আগের অবস্থায় ফিরে গেলে হানযালা হয়তো একদিন তার চেহারাও দেখাবে।

 

ইরানের গ্রিন মুভমেন্টের মাস্কট, হানযালা; © muftah.org

নাজির নারী চরিত্রের নাম ফাতিমা। সে একজন মা এবং একই সাথে ফিলিস্তিনের প্রতীক। সে সবসময় তার সাথে একটি চাবি বয়ে নিয়ে বেড়ায়। হয়তো সেটা বাড়ির চাবি, কিংবা জেরুজালেম শহরের। ছোট ছোট সরল এবং সোজাসাপ্টা কথায় আঁকিয়ে তাকে আঁকেন। সে সকল রিফিউজি মা, স্ত্রীদের দুঃখ দুর্দশার প্রতিনিধিত্ব করে।

ফাতিমা; © Naji al-Ali

নাজি তার The Good Man কিংবা ভালো মানুষ চরিত্রটি আঁকেন একজন সাদাসিধে সাধারণ মানুষ হিসেবে, নাম দেন জালামা। সে সৎ, তার দীর্ঘ শরীর জড়ানো পোশাকে অসংখ্য তালি দেওয়া। সে কখনও শরণার্থী হয়ে, কখনও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে দেখা দেয়। সে বেশিরভাগ সময়ই মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করলেও, কখনও কখনও খ্রিস্টান হিসেবেও আমরা তাকে দেখি।

শরনার্থী শিবিরে The Good Man; © Naji al-Ali

খারাপ মানুষ বা The Evil Man কে নাজি এঁকেছেন শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। সে দেখতে কুৎসিৎ, এতোটাই মোটা যে, মানুষ না বলে একটা ‘মাংসের দলা’ বলা যেতে পারে। ভয়ঙ্কর নোংরা সব কাজ করা তার স্বভাব, ভীষণ অলসও। তার কোনো পা নেই, অনেকে বলেন, খারাপ মানুষটির পক্ষে জনগণের কোনো সমর্থন নেই বলে নাজি তাকে এভাবে এঁকেছেন। সে মূলত আরব হলেও ইজরায়েল এবং পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে।

The Evil Man লিখছে, ‘দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রত্যেক ফিলিস্তিনিই সন্দেহভাজন’; © Naji al-Ali

প্রায় ত্রিশ বছরের নাজি প্রায় ৪০,০০০ কার্টুন এঁকেছেন। তিনি সেগুলো একত্র করে ১৯৭৬, ’৮৩ এবং ’৮৫ সালে বই আকারে প্রকাশ করেন এবং মৃত্যু আগে তার চতুর্থ বই নিয়ে কাজ করছিলেন। নাজি রাজনৈতিক কার্টুন এঁকে দেশে বিদেশে শুধু সমালোচিত কিংবা প্রশংসিত হননি, বেশ কিছু পুরস্কারও জিতেছিলেন। তিনি ১৯৭৯ সালে নাজি “লিগ অফ দ্য আরব কার্টুনিস্ট” এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশান অফ নিউজপেপার পাবলিশার্স তাকে মরণোত্তর ‘গোল্ডেন পেন অফ ফ্রিডম’ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে ১৯৮৮ সালে। নাজি তার কাজ সম্পর্কে বলেন-

ত্রিশ বছর যাবৎ আমি কার্টুন আঁকি। আমার প্রতিটি কার্টুন এতোটাই আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে যে, আমি একটি কার্টুনকে রক্ষা করতে হলেও জীবন দিতে পারি। আমার মনে হয়, আমার কার্টুনগুলো পানির মতো। শত বাধা বিপত্তিতেও তারা ঠিকই পথ করে নেয় মানুষের বিবেক পর্যন্ত।

নাজির কার্টুনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বোঝা

১.

হানযালা এবং The Good Man এর কথোপকথন; © Naji al-Ali

নিউ ইয়র্ক টাইমস বলেছিলো,

“আপনি যদি জানতে চান, সাধারণ আরব কী ভাবে আমেরিকা সম্পর্কে, আপনাকে অবশ্যই নাজি আল-আলির কার্টুনগুলো দেখতে হবে।”

তাই আরব বিশ্বের রাজনীতি বুঝতে নাজির কার্টুন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমাধ্যম হতে পারে।

আরবের গণতন্ত্রের সম্যক অবস্থা অসাধারণ ভাবে ফুটে উঠেছে এই কার্টুনটিতে। হানযালা জিজ্ঞেস করে Good Man-কে, ‘আজ গণতন্ত্র নিয়ে আপনার লেখাটা পড়লাম, বেশ ভালো লিখেছেন। তো কাল কি নিয়ে লিখছেন?’ সে বলে, ‘আমি আমার উইল লিখে রাখছি। কখন কী হয়, ঠিক নেই!’ অর্থাৎ, আপনি যদি আরবে বসে গণতন্ত্র নিয়ে সামান্য উচ্চবাচ্য করেন, আপনার জীবন নিয়ে টানাটানি বেধে যাবে।

আরব সরকারগুলো মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হাজার রকমের সেন্সরসিপের মাধ্যমে দমন করতে চায়। জার্নালিস্ট এবং ইন্টারনেট অ্যাক্টিভিস্ট, যারা নানা রকম মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য ইস্যুতে সোচ্চার থাকে, তাদের নানা রকম উপর ভোগান্তি আর নিপীড়ন করা যেন সরকারগুলো নিত্তদিনের রুটিন।

© Naji al-Ali

মুক্তমত প্রকাশের ক্ষেত্রে আরব বিশ্বে নাগরিকদের যে ভোগান্তির স্বীকার হতে হয়, তা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে নাজির কার্টুনটিতে।

২.

মিশরের কারাগারে হানযালা; © Naji al-Ali

আরব বিশ্বের আরেকটি মারাত্মক বিষয়কে আলি এই কার্টুনটিতে তুলে ধরেছেন। তা হলো, কারাগারে নির্যাতন। কার্টুনটির টুপি মাথায় দেওয়া বৃদ্ধটি বলছেন তার সেলমেট সম্পর্কে, ‘পিটার ভাই হলেন একজন কপটিক খ্রিস্টান। তারা তাকে গুপ্ত কোনো সংগঠনের সাথে জড়িত বলে সন্দেহ করছে। তো তাকে একটু আগে নিয়ে গেলো রিমান্ড কক্ষে, এখন সে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য হয়ে গেছে!’

মিশরের কারাগারগুলোতে নির্যাতনের মাত্রা যে কতোটা ভয়াবহ, তার উল্লেখ পাওয়া যায় ২০০৪ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে। তারা বলছে,

মিশরের কারাগারে নির্যাতন সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নিরাপত্তা বাহিনী এবং পুলিশ নিয়মিতভাবে বন্দীদের নির্যাতন করে এবং অসভ্য ব্যবহার করে, বিশেষ করে জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, অফিসাররা বন্দীদের নির্যাতন করে তথ্য ও জালিয়াতি স্বীকার করতে বাধ্য করে, কখনও কখনও জিজ্ঞাসাবাদের সময়ই তাদের মৃত্যু হয়।

৩.

আরবে গোষ্ঠীতন্ত্রের ছোবল; © Naji al-Ali

The Evil Man অর্থাৎ, কোট-টাই পরা মোটা কুৎসিৎ ওই লোকটি The Good Man কে জিজ্ঞেস করছে, ‘তুমি কি মুসলিম না খ্রিস্টান? শিয়া না সুন্নী? কপটিক না ম্যারোনাইট? অর্থোডক্স নাকি…’

ভালো মানুষটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘থাম শালার বুরবক! আমি আরব!’

গোষ্ঠীতন্ত্র আরবের একটি বড় সমস্যা। নাজি আল-আলি এ কার্টুনটির মাধ্যমে সেইসব গোষ্ঠীতান্ত্রিকদের চপেটাঘাত করেছেন।বিশেষ করে আরব বসন্তের পর থেকে মিশর, সিরিয়া, লেবানন এবং ইরাকে শিয়া-সুন্নী-খ্রিস্টান এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেয়।

২০১১ সালের ৯ ও ১০ অক্টোবর মিশরে কপটিক খ্রিস্টানেরা একটি চার্চকে উচ্ছেদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করতে থাকে। তারা কায়রোর ম্যাসপেরো টেলিভিশান বিল্ডিংয়ের সামনে অবস্থান নিলে মিশর পুলিশ এবং সেনাবাহিনী তাদের উপর আক্রমণ চালায়। হামলায় ২৮ জন নিহত এবং ২১২ জন আহত হন।

সিরিয়ায় এই গোষ্ঠীতন্ত্রের ছোবল আরো প্রকট। ২০১৩ সালের ১১ জুন পূর্ব দেইর ইজর প্রদেশের হাতলাহ গ্রামে ৬০ জন শিয়া মুসলিম গণহত্যার শিকার হয় সুন্নী সেনাবাহিনীর দ্বারা। এগুলো সামান্য উদাহরণ মাত্র, আগে পরে এমন হতাহতের ঘটনা চলছেই।

৪.

ফিলিস্তিনীদের অপেক্ষা; © Naji al-Ali

নাজি আল-আলি আরব শাসকগোষ্ঠীর একজন কঠোর সমালোচক ছিলেন। তিনি ধারণা করতেন, কোনো আরব সরকারেরই ন্যূনতম ইচ্ছে নেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠায়। এ কার্টুনটিতে তিনি তাই ব্যক্ত করেছেন।

দেখা যায়, ১ নং ছবিটিতে অর্থাৎ ডান পাশের ছবিতে ভালো মানুষটি বলছেন, ‘আমার ইজ্জতের কসম! আমি আমার গোঁফ কেটে ফেলবো যদি কোনো আরব সরকার জেরুজালেমের এক ইঞ্চি মাটিও স্বাধীন করতে পারে।’ পরবর্তী ছবিতে আমরা তার বিশাল লম্বা লম্বা গোঁফ-দাড়িওয়ালা ছবি দেখতে পাই।

আমেরিকার খেয়াল-খুশিমতো কথা বলা আরব নেতাগণ; © Naji al-Ali

১৯৭৯ সালে মিশর এবং ইজরায়েলের মধ্যে শান্তিচু্ক্তি স্বাক্ষরিত হয়, একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে জর্ডান। ইজরায়েল-জর্ডান শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হয় ১৯৯৪ সালে। সে বছরই মরক্কো ও তিউনিশিয়া ইজরায়েলের সাথে শান্তি ও কুটনীতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ১৯৯৬ সালের মে মাসে ওমান এবং কাতার পানি, পর্যটন, কৃষি, রসায়ন, প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে ইজরায়েলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়।

ফিলিস্তিনীরা আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইজরায়েলের এসকল চুক্তি এবং কুটনীতিক সম্পর্ক স্থাপনকে তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে মনে করে। নাজি তার কলমে তাই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন বলেই আক্রোশের স্বীকার হয়েছিলেন আরব বিশ্বের নেতাদের।

৫.

আরবনেতাদের নিজেদের বোঝাপড়া; © Naji al-Ali

আরব বিশ্ব বিভিন্ন চুক্তি আর সমঝোতার মাধ্যমে ইজরায়েলের সাথে আপোষ করেছে। শুধু তাই নয়, তারা ইজরায়েলের সাথে যুক্ত হয়ে একে অপরকে ধ্বংস করতেও ব্যস্ত।

এখানকার প্রতিটি চরিত্রকে আরব বিশ্বের নেতাদের প্রতিরূপ ধরা যেতে পারে। বরাবরের মতোই পেছনে দাড়িয়ে তাদের কথা শুনছে হানযালা।

একজন বললো, ‘যদি ইজরায়েল সিরিয়া আক্রমণ করেই বসে, আমরাও আক্রমণ করবো!’

অন্যজন বলে, ‘আচ্ছা, আমরা আক্রমণ করবো কাকে? সিরিয়া না ইজরায়েল?’

© Naji al-Ali

পি. এল. ও. – মোসাদের হুমকি এবং নাজির মৃত্যু

নাজি হত্যাকাণ্ডে জড়িত আছে বলে সন্দেহ করা হয় ইয়াসির আরাফাতের প্যালেস্টাইন লিবারেশান অর্গানাইজেশান (পি. এল. ও.) এবং মোসাদকে। এ দুই সংগঠন যুগ্মভাবে কিংবা স্বতন্ত্রভাবে নাজির হত্যার সাথে জড়িত, এমনটাই ধারণা ব্রিটিশ পুলিশের। তবে আসলে যে-ই খুন করে থাকুক না কেন, নাজি যে দু’পক্ষেরই বিরাগভাজন হয়েছিলেন, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

নাজির কর্মস্থল আল ক্বাবাসের একজন সহকর্মী নাজির মৃত্যুর পর বলেন,

নাজী তার ক্যারিয়ারে একশ’ বারেরও বেশি হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। জুনের মাঝামাঝি সময়ে পি. এল. ও. এর একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য নাজিকে ফোন করেন। তিনি নাজিকে বলেন, তোমাকে অবশ্যই তোমার অ্যাটিটিউড পরিবর্তন করতে হবে। ওই সৎ মানুষদের বিরুদ্ধে তুমি কোনো কথা বলতে পারবে না, নইলে তোমাকে আমরা সরিয়ে দিতে বাধ্য হবো।

নাজি হত্যাকাণ্ডে এই ফোনকলটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, এমন হুমকি তিনি এর আগে বহুবার পেয়েছিলেন, এবং প্রত্যাশিতভাবেই পি. এল. ও. এই হত্যাকাণ্ডের দায় অস্বীকার করে।

বর্তমানে নাজি হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মেট’স কাউন্টার টেররিজম কমান্ডকে। তার প্রধান কমান্ডার ডিন হেডন বলেন,

ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। এখন হয়তো প্রত্যক্ষদর্শী এমন কাউকে পাওয়া যাবে, যার বয়ানের ওপর ভর করে আমরা একটা সমাধানে পৌছতে পারি, নানা কারণে যা ত্রিশ বছর আগে সম্ভব ছিলো না। সেসময়কার প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী আমরা যে দুজনকে খুঁজছি- হত্যাকারী এবং ঘটনাস্থল থেকে ড্রাইভ করা মানুষটি, তাদের খোঁজ পেতে আমরা সর্বদা সব সম্ভাবনার দিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করে যাচ্ছি।

ব্রিটিশ পুলিশ কর্তৃক প্রকাশিত, খুনির চেহারা বর্তমানে এরূপ হতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন; ©: CNN/Met’s Counter Terrorism Command

এতো দিন বাদে নাজি হত্যার তদন্ত ফের শুরু হওয়ায় খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কারণ নেই। কেননা, পৃথিবীর বুকে প্রতিদিন যে পরিমাণে রক্ত ঝরে, একজন শিল্পী মৃত্যু তার কাছে খুব মামুলি বলে মনে হয়। তবু তার শিখিয়ে দেওয়া প্রতিবাদের ভাষা সর্বজনীন পৃথিবীর প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে, তার মৃত্যুতে আরবের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বজনীন। সময়ে বাধা পেরিয়ে হানযালা কিংবা ফাতিমারা আমাদের বর্তমান পৃথিবীর দিকে আঙুল তোলে আগের থেকেও বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদে। নাজিও হয়তো এমনটাই চেয়েছিলেন।

ফিচার ইমেজ- ‍Said Khatib/AFP/Getty Images

Related Articles

Exit mobile version