ছবিটি হাজ্জাহ শহরের এক ইয়েমেনি বালিকার। খাবারের অভাবে বিছানায় ধুঁকে ধুঁকে দিন গুনছে ৭ বছর বয়সী আমাল হুসেইন। অপুষ্ট শীর্ণ দেহে হাড়গুলো হাতে গোনা যায়। ক’দিন আগে এভাবেই তার ভাইকে হারিয়েছে আমাল। অসহায় বাবার চোখের পানিও যেন ফুরিয়ে গেছে, মৃতপ্রায় সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই তার।
আমালের এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? দিনের পর দিন ক্ষুধায় জ্বালায় কাতরাতে থাকা আমালের মতো হাজারো শিশুর দায় কে নেবে? দেশকে গৃহযুদ্ধের মাঝে ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়া ইয়েমেন সরকার? ইয়েমেন সীমান্তে বোমা ভর্তি উড়োজাহাজ পাঠানো সৌদি আরব, নাকি বিদ্রোহী হুথিরা? নাকি বিধধস্ত ইয়েমেনের পেছনে দায়ী সুদুর আটলান্টিকের ওপারের কোনো নোংরা ক্ষমতালোভী রাজনীতি?
কাগজে-কলমে ইয়েমেনের দুর্ভাগ্যের সময়সূচি ২০১৫ থেকে বলা হলেও মূলত এর শুরু ২০১১ সালে। মধ্যপ্রাচ্যে তখন আরব বসন্তের হাওয়া বইছে। দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে শাসন চালানো ইয়েমেনের স্বৈরাচারী শাসক আলি আব্দুল্লাহ ক্ষমতাচ্যুত হলেন। গদিতে বসানো হয় তারই ডেপুটি আব্দরাব্বুহ মানসুর হাদিকে। বিপ্লব পরবর্তী ইয়েমেনে তখন চারদিকে ষড়যন্ত্র আর ক্ষমতা দখলের পায়তারা। একদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিতে ছেয়ে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি, অন্যদিকে আল কায়েদা আর সেপারেটিস্ট মুভমেন্টসহ নানাবিধ উঠতি সমস্যা। ইয়েমেনকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনার চেষ্টা করতে হাদি সরকারকে কম ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। আলি আব্দুল্লাহর স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা দেশ ও জনগণের অবনতির প্রায় কোনো উপায়ই বাদ রাখেনি।
ইয়েমেনের নতুন সংবিধান প্রবর্তনের পর সংখ্যালঘু শিয়া জনগোষ্ঠী নিয়ে আনসার আলিহর নেতৃত্বে হুথি নামে এক সংগঠন গড়ে ওঠে, যারা ছিল এ সংবিধানের ঘোরবিরোধী। যদি ভাবা হয়ে থেকে যে শুধু নিজেদের অধিকার সংরক্ষণ কিংবা দেশের মঙ্গলের স্বার্থে এই দলের জন্ম, তবে তা ভুল। পূর্বে ক্ষমতাচ্যুত শাসক আলি আব্দুল্লাহ হুথিদের এ উত্থানের পেছনে পুরোপুরি মদদ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হুথি নেতা আনসার আলীর অতীত ঘাটলে দেখা যাবে, ২০১১-তে আলি আব্দুল্লাহকে গদি থেকে নামাতে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। অথচ স্বার্থ আর ক্ষমতার লোভে একসময়ের বন্দুকের দুদিকে থাকা দুজন মানুষ কত সহজে এক জায়গায় এসে দাঁড়ালো!
২০১৪ সালে হুথিরা সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে। তাদের সকল অস্ত্রশস্ত্রের আমদানি আসছিল ইরানের কাছ থেকে। ধারণা করা হয়, পর্দার আড়াল থেকে ইরান শুরু থেকেই সহযোগিতা করে যাচ্ছিল ইয়েমেনের সরকারবিরোধী এ দলটিকে। বিরোধীরা যুদ্ধে রাজধানী সানার দখল নিয়ে নেয়। সরকারের সাথে মিলিত শাসন ব্যবস্থা নিয়ে এক চুক্তিপত্রও স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এ চুক্তির সম্মান কোনো দলই রাখেনি। দুই পক্ষের আবারও সংঘর্ষ বাধে এবং প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদি তার পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে রাজধানী ছেড়ে এডেনে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
কিন্তু এডেনে গিয়েই তিনি তার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন এবং পদত্যাগপত্র উঠিয়ে নিয়ে এডেনকেই অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করেন। ২০১৫ সালের মার্চে হুথি সেনারা এডেনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে হাদি সরকার সৌদি আরবের সাহায্য কামনা করে। সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো ৭টি দেশ একত্রিত হয়ে এক কোয়ালিশন মিলিটারি গঠন করে। ইয়েমেন সীমান্তে হুথিদের বিরুদ্ধে কোয়ালিশন মিলিটারি কর্তৃক পরিচালিত এ মিশনের নাম দেয়া হয় অপারেশন ডিসিসিভ স্টর্ম। আর এই অপারেশন থেকেই ইয়েমেনের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের দিন শুরু। সৌদি মিলিটারির সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে উপর্যুপুরি বিমান হামলার ফলে মিলিয়নের বেশি বেসামরিক মানুষ প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্য আছে সায়াদা, তাইয, হুদায়দা, হাজ্জাহ, দায়হাম এবং সালেফসহ ইয়েমেনের আরো কতগুলো শহর।
হুথি বিদ্রোহীদের বাধা দিতে দখলকৃত শহরগুলোতে সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বিছিন্ন করে ফেলা হয়। এর ফলে আক্রমণপ্রবন ঐসব এলাকায় আটকা পড়েছে মিলিয়নের বেশি মানুষ। নেই কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা, খাবার সরবরাহ কিংবা আহত জনগণের জন্য মেডিকেল সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা। যেন পুরো বিশ্ব তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ইয়েমেনে বর্তমান সমস্যা শুধু বিদ্রোহী দমন নয়, এ এক অর্থনৈতিক যুদ্ধ, যার বিরুদ্ধে লড়ছে অসহায় বেসামরিক জনগণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। প্রায় ১৭.৮ মিলিয়ন মানুষ জানে না তাদের পরের বেলার খাবার কোথা থেকে আসবে।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের মতে, সৌদি-ইয়েমেন যুদ্ধ ইয়েমেনকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট এবং তার ইয়েমেনী জোটের নেতারা উত্তর ইয়েমেন নিয়ন্ত্রণকারী হুথি বিদ্রোহীদেরকে দমন করার লক্ষ্যে শাস্তিমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যা সাধারণ ইয়েমেনীদের জন্য দুর্যোগ বয়ে আনছে। অবকাঠামোগত ধ্বস, কঠোর আমদানি সীমাবদ্ধতা এবং মুদ্রার দাম অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়া ভবিষ্যতের অন্ধকার সময়ের ছায়ামাত্র।
দুর্ভিক্ষের প্রভাব এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, চিকিৎসক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন সম্মানিত পেশার মানুষজন তাদের সকল জানমাল দিয়ে দিতে প্রস্তুত শুধু তাদের পরিবারের জন্য খাবার জোগার করতে। হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো অসুস্থ, ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকারে ভারী হচ্ছে। মৃতদের দেহে শুধু হাড়, মাংসের কোনো চিহ্ন নেই। স্পার্টান এক ক্লিনিকে ১১ বছরের এক বাচ্চার মৃত্যুর সময়কালীন ওজন ছিল মাত্র সাড়ে ৫ পাউন্ড।
ওয়াশিংটনে সৌদি আরবের দূতাবাসকে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধনীতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। উপরন্তু সৌদিরা ইঙ্গিত করে, তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ইয়েমেনের মানবিক ত্রাণ বিতরণে সবচেয়ে উদার দাতাদের মধ্যে রয়েছে। গত বসন্তে, এই দুই জোট, ইয়েমেনকে সাহায্যের জন্য ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করা হয়েছে বলে তারা জানায়।
সৌদি আরব তার কথায় সত্যিই কতটুকু আন্তরিক তা বুঝতে গেলে আমাদের দেখতে হবে ইয়েমেন সমস্যায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাটা কী? আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হবে, মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঝামেলার সুযোগ নিয়ে আশেপাশের রাষ্ট্রগুলো একটি কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছে। সুদূর আটলান্টিকের ওপারে থাকা আমেরিকার এখানে কতটুকুই বা ভূমিকা থাকতে পারে!
প্রথমেই ধরা যাক সৌদি কোয়ালিশন বোমা হামলার কথা। অপারেশন ডিসিসিভ স্টর্ম নামে যে বিদ্রোহী দমন অপারেশনটি ইয়েমেনে পরিচালিত হয়েছিল তা কিন্তু সামরিক-বেসামরিক, বিদ্রোহী-অবিদ্রোহী কাউকেই বাছবিচার করেনি। জাতিসংঘের মতে, এই কোয়ালিশন অপারেশনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে ৬,৮০০ জন ইয়েমেনি ,আহতের সংখ্যা ১০,৭০০ এরও বেশি। হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৭৫% মানুষের মানবিক সাহায্যের প্রয়োজন, ১১.৩ মিলিয়ন ইয়েমেনি জরুরি অবস্থায় সম্মুখীন, ২০১৭-তে যে সংখ্যা বেড়েছে আরও এক মিলিয়নে। এই ভয়াবহ হত্যাজজ্ঞের পরও সৌদিকে কোনো প্রকার জবাবদিহি করতে হয়নি। না জাতিসংঘ, না পরাশক্তি দেশগুলো, কেউই ইয়েমেনের জনগণের পক্ষে সৌদি কোয়ালিশনের বিরুদ্ধে জোর বিরোধিতা করেনি। এর একমাত্র কারণ, তাদের পেছনে আছে ক্ষমতাশালী কোনো দেশ।
৯ আগস্ট শিশুদের স্কুলবাসে বোমা হামলায় ৪৪ জন শিশু অকালে প্রাণ হারায়। বিশ্লেষকদের তথ্য অনুযায়ী, সৌদি যুদ্ধজাহাজ থেকে যে বোমাটি স্কুল বাসে ফেলা হয়েছিল, তার মূল বিক্রেতা ছিল আমেরিকা। সিএনএন জানায়, ব্যবহৃত অস্ত্রটি লকহেড মার্টিনের তৈরি একটি ২২৭ কেজি লেজার নির্দেশিত বোমা, সৌদি আরবকে রপ্তানির অংশ হিসেবে বিক্রি করা হাজার হাজার অস্ত্রগুলোর একটি।
সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয় দেশের অস্ত্র শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় একক গ্রাহক। সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের শুরু ১৯৩৩ থেকে। যতদিন পর্যন্ত আমেরিকায় তেল সরবরাহ সঠিকভাবে হচ্ছে ,আমেরিকা সৌদি সম্পর্কিত বিষয়গুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এটাই ছিল অঘোষিত সম্পর্ক। এই পারস্পরিক সম্পর্কে বেশ ছেদ পড়েছিল বারাক ওবামার সরকার চলাকালীন সময়ে, যা পুনরায় ট্রাম্পের অধীনে প্রাণ ফিরে পায়। ৪ বছর মেয়াদি এক চুক্তির আওতায় গত ৮ বছর ধরে আমেরিকা সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র সম্ভার বিক্রয় করে আসছিল। ২০১৫ সালে কোয়ালিশন বোমা হামলার কারণে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলে তা বিবেচনা করে ওবামা সরকার সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর সেই চুক্তি আবার চালু হয় এবং সৌদি সরকার আমেরিকার কাছ থেকে পুনরায় মারণাস্ত্র আমদানি করতে থাকে, যার ফলাফল ৪৪ জন ইয়েমেনি শিশুর অকাল মৃত্যু।
শুধু অস্ত্র বেচাকেনাই নয়, এয়ার টু এয়ার ফুয়েলিং, কূটনৈতিক সমর্থন ও উপদেষ্টার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি সম্পর্ক স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে ইয়েমেন দ্বন্দ্বে। কংগ্রেসের বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও মার্কিন সরকার বিরতিহীনভাবে ইয়েমেন আক্রমণে সাহায্য করে গিয়েছে। স্বস্তির সংবাদ এই যে, আমেরিকা অবশেষে সৌদি কোয়ালিশন আর ইয়েমেনের মাঝে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট আর বিশ্ববাসীর প্রবল চাপের মুখে আমেরিকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদির পক্ষ থেকে সামরিক সাহায্য সরিয়ে নিতে, যা নিঃসন্দেহে ইয়েমেনের ভাগ্যে ভালো কিছু বয়ে আনবে।
কিন্তু আমেরিকা নিজেদেরকে সরিয়ে নিয়ে গেলেই যে ইয়েমেনের বর্তমান দুরবস্থার অবসান ঘটবে এটা ভাবা ঠিক হবে না। আরও যে সমস্যাটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তা হলো বিদ্রোহীদের দ্বারা আল হুদায়দাহ বন্দর দখল। আমদানি-রপ্তানির দিক থেকে ইয়েমেন ও সৌদি আরব দুই দেশের জন্যই এই বন্দর সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তাই আমেরিকা সাহায্য দিক আর না দিক, সৌদি আরব যে এই বন্দর কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেবে না তা প্রশাসনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আন্দাজ করা যায়। সুতরাং সব থেমে ইয়েমেনে সত্যিকারের শান্তি আসতে হয়তো বিশ্ববাসীকে আরো বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।