জোনাথান নোলানের বহুল জনপ্রিয় ‘পার্সন অফ ইন্টারেস্ট’ সিরিজটি অনেকেই দেখে থাকবেন। বলা হয়ে থাকে, এই সিরিজ তার সময়ের চেয়েও অনেকটা এগিয়ে ছিল । সেখানে একজন বিলিয়নিয়ার প্রকৌশলী এমন একটা ডিভাইসের নকশা বানান, যা দিয়ে সরকার দেশের সবকিছু দেখতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যন্ত্রটির নাম দেওয়া হয় ‘দ্য মেশিন’ এবং শোতে প্রায় সময় সংলাপ খুব বলা হতো, “বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং”।
সিরিজটি দেখে অনেক রোমাঞ্চকর মনে হলেও একটি অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটা নির্দিষ্ট সারভেইলেন্স প্রোগ্রাম বা গণ-নজরদারির নিচে আনা অসম্ভব বলেই মনে করা হতো। কারণ এরকম বিশাল প্রযুক্তিগত বাস্তবায়ন সহজ কথা নয়। কিন্তু এ অসম্ভব কাজটাকেই সম্ভব করে তুলেছে চীন; মোটা দাগে বলতে গেলে চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং । বর্তমানে চীনে ২০০ মিলিয়ন সিসিটিভি ক্যামেরা ইনস্টল করা আছে। চীনের লক্ষ্য হলো, ২০২০ সালের মধ্যে পুরো চীনকে সম্পূর্ণভাবে সারভেইলেন্স প্রোগ্রামের আওতায় আনা।
কী আছে এই প্রোগ্রামে?
চীন সরকার ২০০৫ সালে এই নজরদারি প্রোগ্রামের প্রজেক্ট হাতে নেয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘স্কাইনেট’। টার্মিনেটর ফ্র্যাঞ্চাইজির চলচ্চিত্রগুলোতে দেখানো কাল্পনিক মহাশক্তিধর-প্রতিরক্ষামূলক নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থার নাম ছিল ‘স্কাইনেট’। টার্মিনেটরের স্কাইনেট দিয়ে কম্পিউটার, মোবাইল ফোন এর মতো ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে জনগণের উপর নজর রাখা হয়। সেই একই নামে চীন সরকার এই প্রজেক্ট শুরু করে, যা এখন পর্যন্ত বেশ কয়েক মেয়াদে বাড়ানো হয়েছে।
চীন সরকার থেকে বলা হয়েছে- এ প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিশ্চিত করা, যেন যেকোনো অপরাধ ঘটার সাথে সাথেই অপরাধীকে খুব সহজেই চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। আবার কোনো অপরাধ সংঘটনের আভাস পাওয়া গেলে যেন তা প্রতিরোধ করা যায়।
চীন সরকার কয়েকটি মাধ্যমে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে।
(১) ইন্টারনেট
চীনের ইন্টারনেট সেন্সরশিপের কথা বিশ্ববিদিত। তারা এ বিষয়ে এতটাই সচেতন আর কঠোর যে, তারা বহির্বিশ্বের সব বড় বড় ইন্টারনেট পোর্টাল নিষিদ্ধ করে রেখেছে। এর পরিবর্তে তারা নিজেদের গুগল (বাইদু), হোয়াটসঅ্যাপ (উই চ্যাট), অ্যামাজন (আলি এক্সপ্রেস) চালু করেছে। চীন ২০০৯ সাল থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু করে এবং এখন পর্যন্ত যা সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়ে আসছে।
(২) সিসিটিভি ক্যামেরা
২০১৯ সাল পর্যন্ত চীন ২০০ মিলিয়ন সিসিটিভি ক্যামেরা ইনস্টল করেছে, যা গড়ে প্রতি ৭ জন নাগরিকের জন্য ১টি করে ক্যামেরার কাজ করছে। এই ক্যামেরাগুলোতে মূলত Facial Recognition Technique (FRC), বা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে চেহারা চিহ্নিতকরণ প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে। এ প্রযুক্তি এতটাই দক্ষতার সাথে পরিচালিত হয় যে, দূর থেকে একজন মানুষের নড়াচড়া দেখেই সরকারি ডেটাবেজের সাথে মিলিয়ে তার পরিচয় বের করে ফেলা যায়। এছাড়াও দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজকর্ম, যেমন- টিকিট কাটা, ব্যাংকে ডিপোজিট করা, কোনো জায়গায় প্রবেশ করা – ইত্যাদি ক্ষেত্রে নাগরিকদের পরিচয় প্রদানের কোনো প্রয়োজন হয় না। এফআরসি প্রযুক্তির মাধ্যমেই তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যায়৷
(৩) সোশ্যাল ক্রেডিট নজরদারি প্রোগ্রাম
এটি এমন একটা পদ্ধতি, যেখানে সরকার বিদ্যমান প্রযুক্তির মাধ্যমে নাগরিকদের আচার-আচরণ ও কাজকর্মকে পর্যবেক্ষণ করে। এরপর তথ্যগুলোকে গাণিতিক অ্যালগরিদমের সাহায্যে গণনা করা হয় এবং সেই অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিককে একটি ক্রেডিট স্কোর দেওয়া হয়। যার স্কোর যত বেশি, সে তত বেশি রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত নাগরিক। সে অনুযায়ী নাগরিকরা রাষ্ট্রের সরকারি এবং বেসরকারি সেক্টরে বেশকিছু ‘সুবিধা’ লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
অবশ্য এখানে ‘সুবিধা’ বলতে এখন হোটেল বা রেস্তোরাঁগুলোতে কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই খেতে বা থাকতে পারা, কোনো ঝামেলা ছাড়া দেশের যেকোনো জায়গায় চলাফেরা করা- এ জিনিসগুলোকেই বোঝানো হচ্ছে। এখান থেকেই বোঝা যায়, চীনের সাধারণ নাগরিকের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কী পরিমাণ বিস্তৃত। এখন পর্যন্ত নাগরিকদের জন্য এই প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া ঐচ্ছিক হলেও ২০২০ সাল থেকে তা সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
আসলে কতটুকু নাগরিক বান্ধব এই প্রোগ্রাম?
শি চিনপিংয়ের সরকার বারবার ‘নিরাপত্তা’ ও ‘চীনের তথ্য চীনের ভেতর সুরক্ষিত রাখা’র অজুহাত দিয়ে তাদের নজিরবিহীন নজরদারিকে বৈধতা দিয়ে আসছে। চীনের নাগরিকরাও এ সিস্টেমকে এককথায় স্বাগতই জানিয়েছে, কারণ তারা তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা অধিকারের চেয়ে নিরাপত্তা নিয়ে বেশি চিন্তিত৷ চীন সরকারও ‘তালমিছরির ছুরি’সুলভ প্রচারণা-শ্লোগান দিয়ে জনগণের নৈতিক সমর্থন আদায় এবং তাদের আশ্বস্ত করবার কাজ করছে। একটি শ্লোগান হলো-
“আপনার যদি লুকোনোর কিছু না থাকে, তবে আপনার ভয় করারও কিছু নেই।”
অথচ, মুদ্রার আরেক পিঠে রয়েছে অন্য ধরনের ভয়াবহ চিত্র। চীন এমনিতেই অনেকটা একনায়কতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিআই দ্বারা শাসিত। যেকোনো ধরনের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা সেখানে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। তাই দেখা গেছে, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ভিন্ন মতাদর্শী অ্যাক্টিভিস্টদেরই সরকার কর্তৃক ‘টার্গেট’ হতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি!
গত বছর চীনে বিতর্কিত একটি সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস হয়, যেখানে সরকারের এসব ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছরে কয়েক হাজারেরও বেশি অ্যাক্টিভিস্ট ও মানবাধিকার আইনজীবীদের জেলে পাঠানো ও গুম করা হয়েছে। চীন সরকারের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করার একচ্ছত্র আধিপত্য এতটাই বেশি যে, অনলাইনে কোনো ধরনের বিরুদ্ধমত বা কার্যক্রম চোখে পড়লেই সাথে সাথে তারা সেটি নামিয়ে ফেলে। যেন জনগণ সেটিকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হতে না পারে। এই সিস্টেমকে তারা নাম দিয়েছে ‘দ্য গ্রেট ফায়ারওয়াল’।
এ প্রযুক্তির সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে চীনের সংখ্যালঘুদের উপর। চীনের পশ্চিমাঞ্চলের শিনজিয়াং প্রদেশের প্রায় ১ লাখ উইঘুর মুসলিমদের চীন সরকার ‘ভোকেশনাল ট্রেনিং’য়ের কথা বলে ৩ বছর ধরে বন্দীশিবিরের মতো আবদ্ধ জায়গায় আটকে রেখেছে। চীন সরকার এই ক্যাম্প গোটা দুনিয়ার অগোচরে তৈরি করলেও স্যাটেলাইট ইমেজে এর কথা বেরিয়ে আসে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, উইঘুররা যেন যেকোনো ধরনের জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে, তাই তাদেরকে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। ক্যাম্পগুলোর ভেতরে তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারির আওতায় রাখা হয় এবং ছোট থেকে বড় যেকোনো কাজের জন্য, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ফেস ডিটেকশনের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়। কোনো কারণ ছাড়াই তাদের উপর শারীরিক ও মানসিকভাবে নিপীড়ন করা হয়। আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এসবের বিরুদ্ধে কথা বলাও চীনে নিষিদ্ধ এবং এসব সরকারি উদ্যোগ-প্রচারণার ফলে মুসলিমভীতিও তৈরি হচ্ছে দেশ জুড়ে।
এ বছরের মধ্যে চীন আরও ১০০ মিলিয়ন সিসিটিভি ক্যামেরা ইনস্টল করবে। চীন তাদের সাইবার সিকিউরিটি আইনে নিত্য-নতুন পরিবর্তন আনছে। জিডিপি অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ চীন৷ যে দুর্দান্ত গতিতে চীন শিক্ষা, প্রযুক্তি, ব্যবসা সবক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে, সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন তারাই বৈশ্বিক নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে জনগণের সঠিক তথ্য নিশ্চিতের অধিকার, বাক স্বাধীনতা, সরকারি নীতি-নির্ধারণে স্বচ্ছতা ইত্যাদি বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি দেশের উন্নয়ন প্রকৃতরূপে সাধিত হয় রাষ্ট্রের সকল জনগণের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে। চীন সরকার যেভাবে যেরকম অর্থনৈতিক উন্নতির বেড়াজালে তাদের অপকর্মগুলোকে বৈধতা দিচ্ছে, তাতে করে ভবিষ্যতে হয়তোবা তিয়ানআনমেন স্কয়ারের মতো আরেকটি ঘটনার জন্ম দিতে পারে।