ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতা তিনি। অথচ তার নিজের একটি গাড়িও নেই! বিলাসী জীবন তো পছন্দ করেনই না, মদ্যপানও করেন না খোঁচা খোাঁচা দাড়ির শুভ্রকেশী এই ভদ্রলোক। ব্রিটেনের অভিজাত রাজনীতিক শ্রেণীর কাছে তিনি অচ্ছুৎ, বেমানান। এমনকি নিজের দলের অভিজাত গোষ্ঠীও তাকে খুব একটা সইতে পারে না। কিন্তু নীতি আদর্শে অবিচল কট্টর বামপন্থী রাজনীতিবিদ নিজ দলের তৃণমুলে দারুণ জনপ্রিয়। দ্বিতীয়বারের মতো লেবার পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়ে সেটি তিনি প্রমাণ করেছেন। আর ব্রিটেনের নির্বাচনকে সামনে রেখে তার জনপ্রিয়তা বাড়ার যে হার, তাতে দার্শনিকের মতো চেহারার এই জেরেমি করবিন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ২০১৭ এর এপ্রিলে যখন হঠাৎ আগাম নির্বাচন ঘোষণা করেন, তখন সবাই ধরে নিয়েছিল অপ্রতিরোধ্যভাবে থেরেসা মে’ই জিতবেন। কেউই গোণায় ধরছিল না করবিনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টিকে। কিন্তু জেরেমি করবিন যেন জাদু জানেন! মে মাসের মাঝামাঝি তিনি ঘোষণা করলেন লেবার পার্টির নির্বাচনী ইশতেহার। এই ইশতেহারে তিনি ব্রিটেনবাসীকে কথা দিলেন, সাধারণ মানুষের কল্যাণে রাষ্ট্রের ভূমিকায় আমূল পরিবর্তন আনা হবে লেবার পার্টি ক্ষমতা এলে। তার প্রতিশ্রুতিগুলোও ব্রিটেনের প্রেক্ষপটে অভিনব- রাষ্ট্রীয় সেবাগুলোকে বেসরকারিকরণের বিপরীতে সরকারিকরণ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা, উদ্বাস্তুদের জন্য চার হাজার ঘর নির্মাণ ও শ্রম মজুরি বৃদ্ধি। ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যমও তার ইশতেহারের প্রশংসা করে একে “আশা জাগানিয়া” এক দলিল বলে অভিহিত করেছে।
ইশতেহার ঘোষণার পর থেকে প্রচারেও গতি বাড়িয়েছেন জিমি করবিন। আর ফলও পাচ্ছেন হাতেনাতে। এই একমাস আগেও যে লেবার পার্টিকে কেউ গোণায় ধরেনি সেই তারাই দিচ্ছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি। নির্বাচনের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে প্রতিদিনই জরিপে কমে আসছে লেবার এবং কনজারভেটিভ পার্টির ব্যবধান। নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে জুনের প্রথম দিন পর্যন্ত জরিপে প্রথমবারের মতো পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, আট জুনের নির্বাচনে হারতেও পারেন থেরেসা মে। অর্থাৎ তিনি যে আশা করে আগাম নির্বাচন দিয়েছিলেন সেই আশায় গুড়েবালি ঢেলে দিতে যাচ্ছেন জেরেমি করবিন। এবং লেবার পার্টির এই হঠাৎ উত্থানের পেছনে সবাই জেরেমি করবিনের নের্তৃত্বের কারিশমাকেই কৃতিত্ব দিচ্ছেন।
বামপন্থী জেরেমি করবিন সব সময়ই বিদেশের মাটিতে যুদ্ধে ব্রিটেনের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে ম্যানচেস্টার হামলার পরও তিনি একই কথা বলেছেন। হামলার ঘটনায় নির্বাচনী প্রচারে সাময়িক বিরতি শেষে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে ব্রিটেনের যুদ্ধবাজ পররাষ্টনীতিতে পরিবর্তন আনা হবে। তার মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের সেনাবাহিনীর অভিযানের কারণেই ব্রিটেন সন্ত্রাসী হামলার শিকার হচ্ছে। তার এই ঘোষণা ভোটের আগে বেশ সাড়া ফেলেছে। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত অনেক ব্রিটিশ জনতাই তার এই ঘোষণায় প্রভাবিত হয়ে সমর্থন করছে লেবার পার্টিকে। আর এতেই জরিপের ফলে প্রতিনিয়তই সমর্থনের পাল্লা ভারী হচ্ছে লেবার পার্টির।
বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মধ্যে করবিনের জনপ্রিয়তা উল্লেখ করার মতোই। ব্রিটেনের বেসরকারি জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থা ইউগোভ কর্তৃক ৩১ মে তারিখে প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, ২৪ বছরের কম বয়ষ্ক ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা এখন ৫৭ শতাংশ। আর ৫০ বছরের কম বয়স্ক ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ৬৯ শতাংশ। সেখানে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির নেত্রী থেরেসা মে’র গ্রহণযোগ্যতা মাত্র ১২ শতাংশ। থেরেসা মে’র জনপ্রিয়তা অবশ্য বয়স্ক ভোটারদের মধ্যে বেশি, যাদের বয়স ৫০-এর উপরে। করবিনের জন্য সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে, তার ভোটাররা বলছে তারা অবশ্যই এবার ভোট দিতে যাবে। ইতোপূর্বের ব্রিটিশ নির্বাচনে দেখা গেছে তরুণ ভোটারদের উপস্থিতি কম। বয়স্কদের তুলনায় নির্বাচনে তরুণদের আগ্রহ কম। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে তার বিপরীত চিত্র। উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় তরুণ ভোটাররা নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। শুধুমাত্র করবিনের জন্যই শেষ মুহূর্তে ভোট প্রদানের জন্য নিবন্ধিত হয়েছে অনেকে।
আসন্ন নির্বাচনে হয়তো অনেক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকেরও সমর্থন পাবেন করবিন। কারণ ব্রিটেনে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে তিনি “বাংলাদেশের বন্ধু” হিসেবে পরিচিত। তিনি ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে যখন করবিন দ্বিতীয়বারের মতো লেবার পার্টির নেতা নির্বাচিত হন, তখন লেবার ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেছিলেন, জেরেমি করবিন লিডার নির্বাচিত হওয়ায় আমি অত্যন্ত খুশি।’ তিনি আরো জানিয়েছিলেন, জেরেমিকে তিনি ১৫ বছর ধরে চেনেন। জেরেমির চেয়ে বাংলাদেশের ভালো বন্ধু দ্বিতীয় কেউ নেই। কেননা ইজলিংটনের এমপি হিসেবে তিনি বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।
লেবার পার্টিকে বাংলাদেশি কমিউনিটির আবাসভূমি বলে আখ্যায়িত করে তরুণ প্রজন্মের ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের লেবার পার্টিতে মাধ্যমে মূল ধারার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান টিউলিপ। বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে লেবার ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ অন্যতম মাধ্যম হতে পারে বলেও মনে করেন তিনি। আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষ্যেও বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে লেবার পার্টির পক্ষে ভোটের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এমপিরা।
ভোটের আগে দারুণ সাড়া ফেলে দেওয়া জেরেমি করবিনকে পছন্দ করে স্কটিশরাও। কারণ স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিতীয়বার গণভোটের প্রস্তাবকে সমর্থন করেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি নিজের মতামত বেশ খোলাখুলিই জানিয়ে দিয়েছেন। চলতি বছরের মার্চে ব্রিটিশ এমপিদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, যদি স্কটল্যান্ডে গণভোটের দাবি করে তাহলে তা হতে দেওয়া উচিত। তিনি ইঙ্গিত দেন, স্কটিশ ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিওন যদি দ্বিতীয় গণভোটকে সামনে নিয়ে আসেন তাহলে সে উদ্যোগে ওয়েস্ট মিনস্টারের বাধা দেওয়া উচিত নয় বলে তিনি বিশ্বাস করেন। স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিওন তার এই বক্তব্যের পর তাকে স্কটিশদের পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ দেন।
স্কটিশ সমর্থন আসন্ন নির্বাচনে করবিনের জন্য একটি বড় আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিতে পারে। যদি ৮ জুনের নির্বাচনের পর ব্রিটেনে একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হয় তাহলে করবিনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বেড়ে যাবে। কারণ করজারভেটিভ ও লেবার কোনো পার্টিই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে সেক্ষেত্রে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) সমর্থনই বড় হয়ে দাঁড়াবে। আর এক্ষেত্রে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন থাকায় করবিনের সঙ্গেই জোটে আগ্রহী হবে এসএনপি।
আর তাই ব্রিটেনের নির্বাচনের আগে এখন বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যম এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে এই প্রশ্নটিই বড় হয়ে উঠেছে- জেরেমি করবিনই কী ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন? জরিপের ফল এখনো পর্যন্ত কনজারভেটিভদের পক্ষেই। কিন্তু পরিসংখ্যানের চার্টে লেবার পার্টির বার যেভাবে উঠছে আর উল্টোদিকে কনজারভেটিভদের বার যেভাবে নামছে তাতে কিছুই নিশ্চত করে বলা যাচ্ছে না। ফলে আগামী ৮ জুনের নির্বাচনী দৌড়ে অনেকেই বাজির ঘোড়া হিসেবে বেছে নিচ্ছেন ‘ডার্ক হর্স’ করবিনকে। এমনিতেই এখনো বাজিকরদের টেবিলে তার দরটা কমই। তবুও অনেকেই এই কট্টর বামপন্থীর ওপরই ভরসা রাখছেন। চলতি সপ্তাহে এক ব্রিটিশ তরুণ করবিনের ওপর ১০ হাজার পাউন্ড বাজি ধরে আলোচনায় উঠে এসেছেন। তরুণ সমর্থকদের জন্য হলেও জেতাটা প্রয়োজন করবিনের। কারণ,তিনিই তো তাদের একটা নতুন সমাজ বিনির্মাণের আশা দেখিয়েছেন।
স্বপ্নবাজ করবিন নিজেও স্বপ্ন দেখেন পরমাণবিক অস্ত্রমুক্ত একটি পৃথিবী গড়ার। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত দুনিয়া গড়তে সম্ভব সবকিছুই আমি করবো। কারণ পারমাণবিক হামলা চালানো আমার কাছে খুবই ভয়ঙ্কর একটি বিষয়। এবারের এই বাজিটা যদি করবিনের পক্ষের লোকজন জিতেই যান, তাহলে এই প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য আবারো এক কঠিন লড়াইয়ে নামতে হবে করবিনকে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে আটই জুনের ভোটের যুদ্ধের ওপর। সারা দুনিয়ার নজর এখন সেদিকেই।
তথ্যসূত্র
১) newstatesman.com/politics/june2017/2017/04/can-jeremy-corbyn-win-2017-general-election-labour-polls-odds
২) thesun.co.uk/news/3675495/jeremy-corbyn-says-he-would-open-discussions-with-nicola-sturgeon-over-a-second-scottish-independence-referendum-if-he-became-pm/
৩) newsweek.com/uk-general-election-latest-polls-617871