জর্দানের রাজপরিবারে কেন এত বিরোধ?

জর্দানের রাজপরিবার সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও সেগুলো প্রকাশ্যে আসত না বললেই চলে। কিন্তু গত সপ্তাহে জর্দানের প্রিন্স হামজা বিন আল হুসেইনকে গৃহবন্দী করে বাদশাহ দ্বিতীয় আব্দুল্লাহের সরকার। সম্পর্কে ৪১ বছর বয়সী প্রিন্স হামজা, ৫৯ বছর বয়সী বাদশাহ আব্দুল্লাহর সৎ ভাই। তার সাথে অন্তত আরো ২০ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। জর্দানের জনগণের কাছে নজিরবিহীন অভিজ্ঞতা হয়ে আসে। কেন করা হয়েছিল সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। কারণ এখানে দুই পক্ষই অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগ করে আসছে।

তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রিন্স হামজা বাদশাহ আব্দুল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছেন। রয়েল কোর্ট থেকে প্রকাশিত তার স্বাক্ষর করা একটি ছাপা অক্ষরে চিঠি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে তিনি বলেছেন,

দেশমাতৃকার গুরুত্ব সবার আগে। আমাদের অবশ্যই মহামান্য বাদশাহর নেতৃত্বে জর্দানকে রক্ষা করার জন্য দেশের স্বার্থে কাজ করে যেতে হবে।

ডান থেকে জর্দানের রানি নূর হুসেইন, বাদশাহ আব্দুল্লাহ, তার সৎ ভাই প্রিন্স হামজা, হামজার স্ত্রী প্রিন্সেস, রানী রানিয়া; Image Source: Yousef Allan/Petra/AFP 

বাদশাহ আব্দুল্লাহ ও রাজপরিবারের অন্যান্যদের সাথে প্রিন্স হামজাকে জর্দানের শত বছর পূর্তি উপলক্ষে তাদের বাবা সাবেক বাদশাহ হোসেইনের কবরের সামনে দেখা গেছে। তবে এতেই সঙ্কট শেষ হয়ে যাচ্ছে না। এটি কেবল জর্দানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাই না। জর্দানের রাজপরিবার তথা দেশে স্থিতিশীলতা বজায় থাকার সাথে আন্তর্জাতিক মহলের আরো অনেকের স্বার্থই জড়িত।

কেন গৃহবন্দী হয়েছিলেন হামজা?

বাদশাহ আব্দুল্লাহ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রিন্স হামজা বিভিন্ন গোত্র নেতা ও বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিলেন। এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার অংশ হিসাবেই তাকে ও অন্যান্যদের গ্রেফতার করা হয়েছে। 

জর্দানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি সরাসরি হামজার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, প্রিন্স হামজা সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসেম আওয়াদুল্লাহ ও রাজ পরিবারের আরেক সদস্য শরিফ হাসান বিন জায়েদের সাথে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ভঙ্গুর করার ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন। সাফাদি ইঙ্গিত দেন- তাদের পেছনে বিদেশি শক্তির মদদও রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি।

প্রিন্স হামজা গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় তার ওপর আনা অভিযোগ অস্বীকার করে একটি ভিডিও বার্তা দেন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে। ভিডিওতে বলেন, তিনি কোনো ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত নন। গত ১৫-২০ বছর ধরে চলা দুর্নীতি আর অদক্ষ প্রশাসনের জন্য তিনি দায়ী নন। তিনি সরকারের সমালোচনা করে বলেন, এখন কোনো কথাই বলা যায় না এদের বিরুদ্ধে। দেশে ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। যেকোনো সময় গোপন পুলিশের হাতে গ্রেফতারের আতঙ্কে থাকতে হয়। তিনি আরো বলেন,

জনগণ এখন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এ জন্য আমি দায়ী নই। আমার স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে আমি এখন বাড়িতে একা। আমার ইন্টারনেট এবং ফোনের সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কোনো টুইট করতে দেওয়া হচ্ছে না। এটাই সম্ভবত বাইরের দুনিয়ার সাথে আমার শেষ যোগাযোগ।

প্রিন্স হামজার আপন মা ও বাদশাহ আব্দুল্লাহর সৎ মা নূর আল হুসেইন এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে টুইট করেন। এরপর বাদশাহ আব্দুল্লাহর এক চাচার মধ্যস্থতায় এই সঙ্কটের আপাত অবসান হয়। তবে কি এখানেই ঘটনা শেষ?

সঙ্কটের শুরু যেভাবে

জর্দানের রাজপরিবারের সঙ্কট নতুন নয়। এ জন্য ফিরে যেতে হবে ২২ বছর পেছনে, ১৯৯৯ সালে। তখন থেকে বিভিন্ন ঘটনার পরিক্রমাতেই আজকের এই তিক্ততা। তখনকার বাদশাহ ছিলেন আব্দুল্লাহর পিতা হুসেইন বিন তালাল। তিনি ১৯৫২ সাল থেকে দেশ শাসন করে আসছিলেন। সে বছর তিনি রাজবংশের পরবর্তী উত্তরাধিকার বা ক্রাউন প্রিন্সের নাম থেকে তার ভাই হাসানকে সরিয়ে দেন। এটা তখন সবার কাছেই বিস্ময় হয়ে এসেছিল। কারণ এর আগের ৩৪ বছর ধরে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে পরিচিত ছিলেন হাসান।

এর কারণ হিসাবে হুসেইন বলেছিলেন, তার ভাই জর্দানের সশস্ত্র বাহিনীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছিলেন। এছাড়া হুসেইনের এক ছেলেকে উত্তরাধিকার মনোনীত করার অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে ভাই হাসানকে দায়িত্ব দেওয়ার বদলে নিজের বড় ছেলে আব্দুল্লাহকে ক্রাউন প্রিন্স মনোনীত করেন হুসেইন।

আব্দুল্লাহর মা ছিলেন বাদশাহ হুসেইনের দ্বিতীয় স্ত্রী প্রিন্সেস মুনা। আব্দুল্লাহ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। আশি ও নব্বইয়ের দশকে জর্দানের সেনবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। মনে হচ্ছিল তিনি সামরিক বাহিনীতেই কাজ করে যাবেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে এসে সব ওলট-পালট হয়ে যায়।তবে তার বাদশাহ হওয়ার সিদ্ধান্তটাও চমক হয়েই এসেছিল। কারণ সবার ধারণা ছিল হাসান যদি বাদশাহ না হন, তাহলে হুসেইনের ছোট ছেলে হামজাই হতে যাচ্ছেন পরবর্তী বাদশাহ।

২০০১ সালের এক ছবিতে বাদশাহ আব্দুল্লাহ (বামে) ও প্রিন্স হামজা (ডানে); Image Source: AP

১৯৮০ সালে জন্মগ্রহণ করা প্রিন্স হামজা ছিলেন বাদশাহ হুসেইন ও তার চতুর্থ স্ত্রী আমেরিকান বংশোদ্ভূত নূর আল হুসেইনের বড় ছেলে। তিনি যুক্তরাজ্যের হ্যারো স্কুল ও রয়েল মিলিটারি একাডেমিতে পড়াশোনা করেন। তিনি আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশোনা করেন। জর্দানের সশস্ত্র বাহিনীতেও কাজ করেছেন।  

বাবার ক্যান্সারের চিকিৎসার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার পাশে থেকেছেন হামজা। তাছাড়া মৃত্যুশয্যায় থাকা বাদশাহর প্রিয় পুত্রও ছিলেন তিনি। কিন্তু হামজার বয়স ছিল তখন মাত্র ১৮ বছর। হুসেইনের মনে হচ্ছিল মাত্র কৈশোর পেরিয়ে আসা হামজার জন্য বাদশাহর দায়িত্ব অনেক বেশিই হয়ে যাবে। অন্যদিকে আব্দুল্লাহ জর্দানের জনগণ আর সামরিক বাহিনীর কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। তাছাড়া বয়সেও হামজার চেয়ে ১৮ বছরের বড় ছিলেন।

বাদশাহ মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর ক্ষমতা গ্রহণ করেন আব্দুল্লাহ। শীঘ্রই হামজাকে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করেন। সৎ ভাইদের মধ্যে খুব একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না। তারপরও কেন আব্দুল্লাহ এই সিদ্ধান্ত নেন তা অস্পষ্ট। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বাবার ইচ্ছা পূরণের জন্যই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাদশাহ আব্দুল্লাহ।

তবে পাঁচ বছর পর, ২০০৪ সালে, বাদশাহ হামজাকে ‘ক্রাউন প্রিন্স’ পদ থেকে সরিয়ে দেন। তিনি ভাইকে লেখা চিঠিতে বলেন,

ক্রাউন প্রিন্স শুধুমাত্র একটা সম্মানজনক পদবী। এটা তোমার স্বাধীনতাকে খর্ব করে। কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম এমন দায়িত্বগুলোর জন্য তোমার ওপর আস্থা রাখতে বাধা দেয় এই পদবী।

তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার ওপর থেকে ক্রাউন প্রিন্স পদবীর বাধা দূর করতে। এতে তুমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। একইসাথে তোমার ওপর আস্থা রেখে অর্পিত যেকোনো মিশন বা দায়িত্ব পালন করতে পারবে। এ কাজে তোমার সাথে আল হুসেইনের পুত্র আমাদের সকল ভাইরা এবং হাশেমী রাজবংশের অন্য সদস্যরাও থাকবে।

আব্দুল্লাহ ওই মুহূর্তেই হামজার স্থলাভিষিক্ত কোনো ক্রাউন প্রিন্সের নাম ঘোষণা করেননি। তবে ২০০৯ সালে তার ছেলে প্রিন্স হুসেইনকে এই পদবী দেন।

বাদশাহ আব্দুল্লাহর এসব সিদ্ধান্তগুলো ছিল হামজার মা নূর হুসেইনের কাছে অনেক বড় আঘাত। কারণ তিনি মনে করছিলেন তার পুত্র হামজাই হতে যাচ্ছিলেন পরবর্তী বাদশাহ। সিরিয়ান-আমেরিকান নূর হুসেইন আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন সেখানকার সরকারি কর্মকর্তা। সত্তরের দশকে বাদশাহ হোসাইনের সাথে পরিচয় হওয়ার আগে তিনি আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইরানে নগর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেন। ১৯৭৮ সালে তারা বিয়ে করেন। বাদশাহ হুসেইনের চার স্ত্রীর মধ্যে তিনি সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী ছিলেন। তাদের ছিল চার সন্তান।

রানী নূর আল হোসেইনের সাথে প্রিন্স হামজা; Image Source: Hussein Malla/Associated Press

নূর আল হুসেইন বিভিন্ন ইস্যুতে টুইট করে বিতর্ক সৃষ্ট করেছেন জর্দানে। গত ফেব্রুয়ারিতেও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রিন্সেস লতিফাকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে টুইট করেন। 

বাদশাহ আব্দুল্লাহ ক্ষমতা গ্রহণের পাঁচ বছর পর থেকে বাবার ছায়া থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেন। হাশেমীয় রাজবংশেও তার কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। ক্রাউন প্রিন্স পরিবর্তন করা নতুন কিছু ছিল না। তার বাবার সময়েই চারবার ক্রাউন প্রিন্স পরিবর্তন হয়েছে। তাছাড়া জর্দানের সংবিধানেও আছে বাদশাহর উত্তরাধিকারী হবেন তারই বড় ছেলে। হামজার পদাবনতিতে ভাইয়ের প্রতি তার যদি কোনো শত্রুতা থেকে থাকে, তা পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে গত কয়েক বছর ধরে হামজা তার ভাইয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা করে আসছিলেন।

জর্দানের রাজপরিবারের বংশধররা; Image Source: BBC

২০১৮ সালে যখন শ্রমিকদের কর বাড়ানোর আইন তৈরি হয়, হাজার হাজার মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। তখন হামজা প্রকাশ্যে সরকারের ব্যবস্থাপনাকে ব্যর্থ বলেছিলেন। তখন আব্দুল্লাহ এসবকে অত গুরুত্ব দেননি। কারণ রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী কোনো অবস্থানে ছিলেন না হামজা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হামজার সাথে দেশটির প্রভাবশালী গোত্র নেতাদের ব্যক্তিগতভাবে সম্পর্ক উন্নয়ন হতে থাকে। এদের অনেকেই বাদশাহ আব্দুল্লাহর শাসনযন্ত্র ধরে রাখার হাতিয়ার।

জর্দানের ৯০ লাখ জনগণের মধ্যে এক বড় অংশ ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ সালে বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিন থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা। বাকি অংশ জর্দানের এসব গোত্রের জনগণ। তাদের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখা যেকোনো বাদশাহর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গোত্রদের মধ্যে হামজা এখন তার বাবার মতোই জনপ্রিয়। এসব বিষয়কে আব্দুল্লাহ হুমকির চোখে দেখছেন। কারণ আব্দুল্লাহ তার ২৬ বছর বয়সী পুত্র হুসেইনকে মিডিয়াতে আলোচনার কেন্দ্রে রাখতে চাচ্ছেন উত্তরাধিকারী হিসাবে। কিন্তু সেখানে এসে প্রচারের আলোয় ভাগ বসাচ্ছেন তার সৎ ভাই।

জর্দানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ; Image Source: Getty Images

জর্দানের গোত্রীয় নেতারা মনে করেন বাদশাহ আব্দুল্লাহ কোভিডের সময় অর্থনীতির গতি, সিরিয়া থেকে আসা ৬ লাখ শরণার্থী কিংবা প্রশাসনের দুর্নীতি কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। অন্যদিকে হামজা দুর্নীতিবিরোধী ভাবমূর্তি গড়ে তুলছেন জনগণের কাছে।

সম্প্রতি জর্দানের সিটি অব সল্টের এক হাসপাতালে অক্সিজেন সঙ্কটের কারণে বেশ কয়েকজন কোভিডে আক্রান্ত রোগী মারা যায়। হামজা সেখানে গিয়ে ওই অঞ্চলের মানুষদের সাথে কথা বলেন, গোত্র নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা পান সবার কাছ থেকে। এর ছ’দিন পর বাদশাহ আব্দুল্লাহও সেখানে ভ্রমণ করেন। কিন্তু দেখা যায় বাদশাহর তুলনায় তার সৎ ভাই-ই হৃদয় জয় করতে পেরেছেন বেশি। এসব ঘটনার ধারাবাহিক ফলাফলই হামজার গৃহবন্দী হওয়া।

বিদেশি শক্তির সাহায্য ছিল কতটা?

জর্দান দেশটি ভূরাজনৈতিক দিক দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর সাথে রয়েছে সিরিয়া, ইরাক, ইসরায়েল ও ইসরায়েলের দখলে থাকা ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের সীমান্ত। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষায় জর্দানকে অপরিহার্য অংশ মনে করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে জর্দান আমেরিকারও মিত্র দেশ। আমেরিকা স্বাভাবিকভাবেই বাদশাহ আব্দুল্লাহর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। ফিলিস্তিন থেকে আসা শরণার্থী থাকায় ও দেশটি জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদের আনুষ্ঠানিক অভিভাবক হওয়ায় ভবিষ্যতে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল বিষয়ক সঙ্কটে মধ্যস্থতার জন্য জর্দানের স্থিতিশীলতা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  

জর্দানের উপপ্রধানমন্ত্রী সাফাদি বিদেশি শক্তির মদদের কথা বললেও এর পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে এখানে দুটি দেশের হাত থাকতে পারে- সৌদি আরব ও ইসরায়েল।

সৌদি আরবের প্রসঙ্গ এসেছে হামজার সাথে বাসেম আওয়াদুল্লাহর সম্পর্কের কারণে। সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আওয়াদুল্লাহর সাথে জর্দানের রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নব্বই দশকে ও শূন্য দশকের শুরুর দিকে বাদশাহ আব্দুল্লাহর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছেন। ২০০৭ সালে রয়েল কোর্টের প্রধান হন। ২০০৮ সালে অজানা কারণে পদত্যাগ করেন।

বাসেম আওয়াদুল্লাহ; Image Source: Getty Images

বর্তমানে তিনি দুবাইভিত্তিক এক আর্থিক পরামর্শ দানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হিসাবে কাজ করছেন। তিনি সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে বিভিন্ন সময়ে কাজ করছেন বলে শোনা যায়। গত মাসে সৌদি সরকারের বিনিয়োগের এক সম্মেলনেও যোগ দিয়েছেন।

সৌদি আরবের পক্ষ থেকে অবশ্য এই অভ্যুত্থান চেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে জর্দানে বাদশাহ আব্দুল্লাহর সাথে দেখা করেন। সেখানে তারা বাদশাহর প্রতি সমর্থন থাকার কথা জানান। জর্দানের নিরাপত্তা রক্ষায় যেকোনো সাহায্য করতে সৌদি প্রস্তুত বলেও জানান। ওয়াশিংটন পোস্টে খবর আসে, সৌদি প্রতিনিধিরা বাসেম আওয়াদুল্লাহকে না নিয়ে জর্দান ত্যাগ করতে চাচ্ছিল না। তবে সৌদি প্রতিনিধিরা তা ‘ভুয়া’ বলে উড়িয়ে দেন।

হামজার সাথে ইসরায়েলের যোগসূত্র আসে তার ইসরায়েলি ব্যবসায়ী বন্ধু রয় শাপোশনিকের সাথে। তিনি হামজার স্ত্রী আর সন্তানদের একটা ব্যক্তিগত বিমান দিয়ে জর্দান থেকে পালিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। জর্দানের গণমাধ্যমে প্রচারিত খবর অনুযায়ী, দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা মনে করছে শাপোশনিক একজন মোসাদের এজেন্ট। ইসরায়েলের সাথে দেশটি ১৯৯৪ সাল থেকে শান্তিচুক্তিতে আছে।

শাপশোনিক এক ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে প্রিন্স হামজার সাথে তার বন্ধুত্বের ব্যাপারে জানান। হামজা তার পরিবার নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে তার কাছে সাহায্য চান। তিনি তখন তাদেরকে ইউরোপে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সাথে তার জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।

হামজার সাথে বিদেশিদের সম্পর্ক অভ্যুত্থানে তাদের কিছুটা হলেও সাহায্য থাকার ইঙ্গিত দেয়। আব্দুল্লাহর দাবির সাথে কিছু যৌক্তিকতা থাকলেও বাস্তবে এরকমটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাসেম আওয়াদুল্লাহ জর্দানে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা হিসাবে অজনপ্রিয় ব্যক্তি। অন্যদিকে প্রিন্স হামজা দুর্নীতিবিরোধী ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন জর্দানের জনগণের কাছে। তিনি অভ্যুত্থানের জন্য আওয়াদুল্লাহর সাথে যুক্ত হওয়ার ঝুঁকি নেওয়ার কথা না। আর রাজপরিবারের সদস্যদের সাথে বিদেশিদের সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়, বরং এটা খুবই প্রচলিত। বাদশাহ আব্দুল্লাহই ব্রিটেনের সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ করেছেন একসময়।

জর্দানের শতবর্ষ পূর্তিতে সাবেক বাদশাহ হুসেইনের কবরের সামনে মাঝখানে বর্তমান বাদশাহ আব্দুল্লাহ এবং বাম থেকে দ্বিতীয় স্থানে প্রিন্স হামজা; Image Source: Associated Press

বাদশাহ আব্দুল্লাহ বরং হামজাকে গ্রেফতারের মাধ্যমে এক বার্তা দিতে চেয়েছেন সবার কাছে- এখন থেকে কোনো ভিন্নমত সহ্য করা হবে না। এমনিতে জর্দানে বাদশাহকে নিয়ে সমালোচনা করা নিষিদ্ধ। তবে প্রিন্সদের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এর আওতার বাইরে থাকেন। তবে এখন মনে হচ্ছে সেরকম রীতি আর থাকছে না।

আব্দুল্লাহর সাম্প্রতিক কিছু কার্যক্রমের ধারাবাহিকতাও এরকমটাই সমর্থন করে। ২০১৮ সালে কর নিয়ে আন্দোলনকে তার সরকার কঠোরভাবে দমন করে। গত বছর শিক্ষকদের ট্রেড ইউনিয়নের অফিস বন্ধ করে দেওয়ার জন্য তারা প্রতিবাদে নামলে এক হাজার শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়। কোভিড পরিস্থিতি নিয়েও সম্প্রতি জন-অসন্তোষ বাড়ছে জর্দানে।

হামজা বাদশাহর আনুগত্য স্বীকার করে নিলেও তাদের তিক্ততা ভবিষ্যতেও প্রকাশ্যে দেখা যেতে পারে। আব্দুল্লাহও বুঝিয়ে দিয়েছেন ভিন্নমত দমনে প্রয়োজনে নিজের পরিবারকেও ছেড়ে কথা বলবেন না। রাজপরিবারের এই সঙ্কট যে সহসা মিটছে না, তা অনুমিতভাবেই বলা যায়।

This is a Bengali article written about recent Jordan royal family feud. All the references are hyperlinked in the article. 

References: 

1. Vox 

2. New York Times

3. BBC 

Featured Image: Getty Images

Related Articles

Exit mobile version