আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আয়ার্সের একটি গোপনীয় কক্ষে নাৎসিদের কম করে হলেও ৭৫টি নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের এসব নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে স্বয়ং হিটলারের আবক্ষ মূর্তিসহ আরও বেশ কয়েকটি জিনিস!
গত মঙ্গলবার আর্জেন্টাইন পুলিশ এক বিবৃতি প্রদান করে এই বলে যে, তারা এ সকল নিদর্শন এক সংগ্রাহকের বাসা থেকে উদ্ধার করেছে; যদিও তারা সেই সংগ্রাহকের নাম বলেনি। সাংস্কৃতিক নিদর্শন সুরক্ষার জন্য বিশেষভাবে নিয়োজিত পুলিশ কমিশনার মার্সেলো এল হাইবে বলেন, “তদন্ত করার পর আমরা এসব নিদর্শন খুঁজে পেয়েছি বই রাখার আলমারির পিছনে লুকিয়ে রাখা গোপন কক্ষ থেকে।”
গোপন কক্ষ থেকে যেসব নাৎসি নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে সেগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের নাৎসি পার্টির উচ্চপদস্থ কোনো ব্যক্তিরই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশের ভাষ্যমতে, “এগুলোর মধ্যে একটি ম্যাগনিফাইং লেন্স এবং কয়েকটি ছবির নেগেটিভ পাওয়া গিয়েছে যে ছবিগুলোতে স্বয়ং হিটলার ঐ ম্যাগনিফাইং লেন্সটিই হাতে ধরে আছেন!” আর্জেন্টিনার ফেডারেল পুলিশ প্রধান নেস্টর রোনক্যালিয়া মন্তব্য করেন, “আমরা ইতিহাসবিদদের জিজ্ঞাসা করেছি এবং তারা সম্মত হয়েছে যে, এই লেন্সটি আসলেই হিটলার ব্যবহার করেছিলেন।” আর্জেন্টিনার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্যাট্রিশিয়া বুলরিখও নিদর্শনগুলোর নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে দেখেছেন। নেগেটিভ ছবিগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ না করলেও অ্যাসোসিয়েশন প্রেসের কার্যালয়ে প্রদর্শন করা হয়েছে।
এছাড়াও নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে বাদ্যযন্ত্র এবং খেলনা, যেগুলোর উপর চিহ্নিত করা রয়েছে নাৎসিদের প্রতীক স্বস্তিকা চিহ্ন। এল হাইবে বলেন, “এগুলো হলো নাৎসিদের প্রোপাগান্ডা, এসব খেলনা মূলত বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এখানে রয়েছে পাজল এবং খেলনা বাড়ি বানানোর জন্য ছোট কাঠের টুকরো, কিন্তু সেগুলো আসলে নাৎসি পার্টি সম্পর্কিত বিভিন্ন ছবি আর প্রতীকেরই সমাবেশ।”
জুনের ৮ তারিখ, ইন্টারপোল এবং আর্জেন্টিনার ফেডারেল পুলিশের যৌথ উদ্যোগে সংগ্রাহকের বাড়িতে তদন্ত চালানো হয়। বুয়েনোস আয়ার্সের বেক্কার অঞ্চলের এক বাড়িতে থাকা এই সংগ্রাহক ব্যক্তির নাম সাংবাদিকদের সামনে প্রকাশ না করলেও, সে এগুলো কোথায় পেয়েছে সে ব্যাপারে তার উপর জিজ্ঞাসাবাদ চালানো হচ্ছে। তিনি মূলত প্রাচীন মিশরীয় এবং চীনের বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে ব্যবসা করেন বলে জানা গেছে।
৭৫টি নিদর্শনের মধ্যে এছাড়াও রয়েছে চিকিৎসাবিদ্যার যন্ত্র যার সাহায্যে মানুষের মাথার আকার পরিমাপ করা হতো এবং সেগুলো দিয়ে নাকি পরীক্ষা করা হতো সে আর্য কিনা! স্বস্তিকা চিহ্ন সংবলিত বালিঘড়িও পাওয়া গিয়েছে এই বিশাল সংগ্রহের মধ্যে। পুলিশ চেষ্টা চালাচ্ছে কীভাবে এই নিদর্শনগুলো আর্জেন্টিনায় প্রবেশ করলো সেটা জানার।
তবে ধারণা করা হচ্ছে, এসব নাৎসি রেলিকসগুলো বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়েই আর্জেন্টিনায় প্রবেশ করেছিল যখন আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি হুয়ান ডোমিঙ্গো পেরন নাৎসিদের প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল ছিলেন। হলোকাস্ট বিশেষজ্ঞ ড. ওয়েসলি ফিশারের মতে, “এই নিদর্শনগুলো শুধুমাত্র উচ্চপদস্থ নাৎসি কর্মকর্তাদের কাছেই থাকতে পারে, তবে হতে পারে এগুলো চুরি হয়ে গিয়েছিল এবং অন্য কেউ আর্জেন্টিনায় নিয়ে এসেছে। এসব ঐতিহাসিক বস্তু বিক্রি করার জন্য অপরাধী সংগঠনগুলো জড়িত থাকার সূক্ষ্ম সম্ভাবনা থাকলেও আমার মনে হয় এগুলো বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই আর্জেন্টিনায় প্রবেশ করেছে।”
দক্ষিণ আমেরিকায় এর আগেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পালিয়ে আসা উচ্চপদস্থ নাৎসি কর্মকর্তারা আস্তানা গেড়েছিল। হলোকাস্টের অন্যতম খলনায়ক অ্যাডলফ আইখম্যান, জার্মান প্যারা মিলিটারি বাহিনী ‘শুৎজটাফেই’ কমান্ডার এরিখ প্রিবকে এবং থার্ড রাইখের প্রধান কর্মকর্তাদের একজন জোসেফ মেংগেলেসহ আরও অনেক নাৎসি কর্মকর্তার খোঁজ পাওয়া যায় আর্জেন্টিনায়।
তবে সবাই ড. ওয়েসলি ফিশারের সাথে একমত হয়েছেন, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। ‘হান্টিং ইভিল: দ্য নাজি ওয়ার ক্রিমিনালস হু এসকেপড’ বইয়ের লেখক গাই ওয়াল্টার্সের মতে, “যেহেতু এগুলো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যেই থাকা সম্ভব, সেহেতু এগুলো আইখম্যান কিংবা মেংগেলের মতো লোকদের কাছেই থাকার কথা। কিন্তু আর্জেন্টিনায় পালিয়ে আসার সময় তাদের কারো কাছেই ভারী জিনিসপত্র থাকার প্রমাণ মেলেনি। তাছাড়া এরা দুজনেই এমন কোনো মানুষ ছিলেন না, যারা আর্টিফ্যাক্টসগুলো নিজেদের সাথে নিয়ে আসার মতো আগ্রহী হবেন। এছাড়া বেশিরভাগ শুৎজটাফেই কর্মকর্তা নিজেদের পরিচয় গোপন করে পালানোর সময় নিশ্চয় এমন কোনো কাজ করবে না, যা তাদের পরিচয় প্রকাশ করে ফেলবে!”
আইখম্যান এবং মেংগেলে উভয়েই প্রায় এক দশক ধরে আর্জেন্টিনার রাজধানীতে লুকিয়ে ছিলেন। ১৯৬০ সালে স্যান ফার্নান্দো ডিস্ট্রিক্ট থেকে আইখম্যানকে শনাক্ত করে ফেলে এক মোসাদ এজেন্ট এবং পরবর্তীতে তাকে ইসরাইলে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মেরে ফেলা হয়। বলা হয়, হলোকাস্ট পরিকল্পনাকারী অ্যাডলফ আইখম্যানকে ধরে ফেলা ছিল মোসাদ গোয়েন্দা বিভাগের অন্যতম সফল একটি অপারেশন।
‘রিকার্দো ক্লেমেন্ট’ ছদ্মনামে ইউরোপ থেকে পালিয়ে আসা আইখম্যান ব্যবহার করেন রেড ক্রিসেন্টের পাসপোর্ট। ১৯৫০ সালের ১৭ জুন ইতালির জেনোয়া বন্দর থেকে জাহাজের মাধ্যমে বুয়েনোস আয়ার্সে পা ফেলার পর প্রথমদিকে কয়েকদিন দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। এরপর মার্সিডিজ বেঞ্জের কারখানায় কাজ পেয়ে যান তিনি এবং কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে যান!
আইখম্যান ধরা পড়ে যান তার ছেলের কারণে। তার ছেলে ক্লাউস আইখম্যান তার বান্ধবী সিলভিয়ার কাছে কথায় কথায় বলে ফেলেন তার বাবা নাৎসিদের বড় ধরনের কর্মকর্তা ছিলেন। সিলভিয়া এ কথা নিজের বাবাকে বলে দেয়। সিলভিয়ার বাবা লোথার হারম্যান ছিলেন ১৯৩৮ সালে প্রাণের ভয়ে দেশছাড়া এক জার্মান ইহুদী। হারম্যান এই খবর জানিয়ে দেন জার্মানিতে এবং এভাবেই আইখম্যানের খোঁজ পায় মোসাদ। মোসাদের নির্দেশে আর্জেন্টিনায় তদন্ত করতে চলে যায় ইসরাইলের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা বাহিনী ‘শিন বেথ’-এর প্রধান ইন্টারোগেটর জহি আহারোনি। আহারোনি তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করেন এবং পরবর্তীতে গোপন অপারেশনের মাধ্যমে হলোকাস্টের অন্যতম প্রধান সংগঠককে ধরে ফেলা হয়। ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিয়ে শেষ করা হয় আইখম্যানের ভবলীলা।
এদিকে আইখম্যান ধরা পড়ার সংবাদ শুনে ব্রাজিলে পালিয়ে যান জোসেফ মেংগেলে। ড. ফস্টো রিন্ডোন নামের আড়ালে লুকিয়ে থেকে সাও পাওলোতে বাড়ি বানিয়ে সেখানেই থাকা শুরু করেন তিনি। ব্রাজিলে চলে যাওয়ার পর শরীর খারাপ হতে শুরু করে সাবেক এই নাৎসি অফিসারের। ১৯৭৬ সালে একবার স্ট্রোক করেন তিনি, পরবর্তীতে সাঁতার কাটার সময় আরেকবার স্ট্রোক করে ডুবে মারা যান ‘অ্যাঞ্জেল অফ ডেথ’।
ফিচার ইমেজ সূত্র: Rare Historical Photos