আজকের লেখাটি একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক। চেঙ্গিস খান এবং তার হাতে গড়ে ওঠা দুর্ধর্ষ মঙ্গোল বাহিনীর নাম তো আপনি অবশ্যই শুনেছেন। তাদের ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা কেমন ছিলো সেই সম্পর্কে আপনার ধারণা কতটুকু? যদিও আজকের লেখার বিষয় মঙ্গোলদের ‘দ্য গ্রেট খান’ কিংবা তাদের বাহিনীর নিষ্ঠুরতা নয়, তবে লেখার সাথে ঐতিহাসিক এ বিষয়গুলোর মিল আছে বলেই এদিকে সামান্য আলোকপাত করা দরকার।
চেঙ্গিস খানের বাহিনীর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিলো তাদের নিষ্ঠুরতা। তাদের হত্যাযজ্ঞের কাহিনী চিন্তা করলে মনে হয়, এ তো কেবল গল্পেই সম্ভব! কিন্তু তারা সত্যিকার অর্থেই সেগুলো করেছিলো। কৈশোরে খাবারের বন্টন নিয়ে ঝামেলার সূত্র ধরে সৎভাইকে ধনুকের আঘাতে হত্যার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় চেঙ্গিসের নিষ্ঠুরতার। এরপর বয়স যত বাড়তে থাকে, যত তারুণ্য থেকে মধ্য বয়সের দিকে তিনি যেতে থাকেন, তার নিষ্ঠুরতাও যেন ততই পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কোথাও আক্রমণ করে জয়ের পর সেই এলাকার নারী-শিশু-বৃদ্ধ-পশুপাখি কোনো কিছুকেই ছাড় দিতো না মঙ্গোলরা। একে একে সবাইকে তলোয়ারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে শেষ করে দিত। এমনকি গর্ভবতী নারীদের পেট কেটে সন্তান বের করার মতো নির্মম কাজও তারা করতো। আর তাদের এ নির্মমতার খবর যেন দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে, যেন এ গণহত্যা না দেখা মানুষেরাও তাদের ভয়ে কাঁপতে থাকে, সেজন্য হত্যাযজ্ঞের পর নিহত সবার খুলি দিয়ে পিরামিড বানাতো তারা! ইরানের ইতিহাসবিদ রশিদ-আল-দীনের মতে মঙ্গোল বাহিনী মার্ভে আনুমানিক সত্তর হাজার আর নিশাপুরে আনুমানিক দশ লক্ষ লোককে হত্যা করেছিলো। ১২৭৯ সালে শেষ হওয়া তাদের চীন অভিযানে নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছিলো কোটির ঘর। উরগেঞ্চে মঙ্গোল বাহিনীর চালানো গণহত্যায় মারা যায় প্রায় দশ লক্ষ মানুষ।
এবার চলে আসা যাক মিয়ানমারে, তাকানো যাক সেখানে চলতে থাকা রোহিঙ্গা নিধনের দিকে। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো মিয়ানমারে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের উপর চালানো অকথ্য নির্যাতন। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, লুন্ঠন করা হচ্ছে ঘরবাড়ি, নির্বিচারে পশুর মতো হত্যা করা হচ্ছে মানুষজনকে, মা-বোনেরা হারাচ্ছে তাদের সম্ভ্রম। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললে প্রথম পাতা আর আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর পৃষ্ঠা জুড়ে থাকছে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশার খবর। টেলিভিশন অন করলে নিচে দিয়ে ভেসে যাওয়া খবর এবং মূল খবরের সময়গুলোতেও থাকছে তাদের নিয়ে আলোচনা।
মঙ্গোলদের অত্যাচারের বর্ণনা তো আমাদেরকে শত শত বছর আগেকার ঐতিহাসিকদের বর্ণনার উপর ভিত্তি করে জানতে হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের ঘটনাগুলো যেন আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। যখন–
- ত্রিশ বছর বয়সী আহেসান জানায় নিজের চোখের সামনে পরিবারের পাঁচ সদস্যকে খুন হতে দেখা এবং আপন বোনকে ধর্ষিত হতে দেখার কাহিনী;
- মাকে নিয়ে এ দেশে পালিয়ে আসা বারো বছর বয়সী কিশোর জসীম জানায় কষ্ট করে, মৃত্যুর পাশে পাশে হেঁটে আসার ভয়াবহ কাহিনী;
- তিন সন্তানের জননী রাশিদা জানান বনের জন্তু-জানোয়ারের চেয়েও ভয়ঙ্কর মিয়ানমারের সেনাসদস্যদের হাতে সবকিছু হারানোর দুর্বিষহ বেদনার কাব্য;
তখন আসলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না অনেকেই। অনেকের বুক চিরে বেরিয়ে আসে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস, যাতে মিশে থাকে স্বজাতির এমন অত্যাচারে একই স্বজাতির অন্য সদস্যদের দুরবস্থা দেখে মনের অন্তঃস্থলের দুঃখ। আমাদের দেশের জনগণও যথাসাধ্য সাহায্য করছে সাম্প্রতিককালের অন্যতম ভয়াবহ নির্মমতার শিকার এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। ত্রাণ আসছে বিশ্বের নানা দেশ থেকেও, যদিও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এমন ঘৃণ্য কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সেভাবে দাঁড়াচ্ছে না ক্ষমতাধর অনেক দেশই।
বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছেন মিয়ানমারের শান্তিতে নোবেল পদক জয়ী নেত্রী অং সান সু কি। নিজ দেশে একটি জনগোষ্ঠীর উপর এমন বর্বরতার বিরুদ্ধে তার ভূমিকা আরো বলিষ্ঠ হওয়া উচিত ছিলো নিঃসন্দেহে। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে তার অদ্ভুত নীরবতা বিস্মিত করেছে গোটা মানবজাতিকেই। এ ক্ষোভ থেকে অনেকেই দাবি করেছেন তার নোবেল পদকটি কেড়ে নেয়ার জন্য, যদিও নোবেল কমিটির নিয়মানুযায়ী সেটি সম্ভব না। অবশেষে গত মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে এ সংক্রান্ত কথাবার্তা বললেও সেটা যে খুব একটা জোরালো না, সে সম্পর্কে নিজেদের মত ব্যক্ত করেছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। এমনকি সেই ভাষণে একটিবারের জন্যও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহার করেন নি তিনি!
এবার আসুন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারে। সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, চায়ের দোকান সহ সবখানেই আজ সু কির নিন্দা, তাকে তুলোধুনো করে ছাড়ছে জনগণ। হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে, বিশ্বজুড়ে সু কির যে ভাবমূর্তি ছিলো, সে অনুযায়ী বলা যায় কিছুই করেন নি তিনি রোহিঙ্গাদের উপর চলমান এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধে। তবে আরো উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, সু কিকে এখানে সামনে বসিয়ে রেখে আড়ালে যে ব্যক্তিটি রোহিঙ্গা নিধনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, অধিকাংশ দেশের সরকারী বিবৃতিতে কিংবা সংবাদে তার নামটিই আসছে না! তিনি আর কেউ নন, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং লাইং। বিশ্ব যখন সু কির চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে ব্যস্ত, তখন পেছনে থেকে ঠিকই নির্দেশ দিয়ে চলেছেন মিন। আসলে তিনি নিজেও যে ঠিক এটাই চাচ্ছেন। সংবাদমাধ্যম থেকে জনগণ, তাবৎ দুনিয়া যখন সু কিকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন তার নির্দেশেই যে সেনাবাহিনী অমন জাতিগত নিধনের কাজ চালাচ্ছে, সেদিকে জনতার নজর দেয়ার সময় কোথায়?
সরকারি নানা স্থাপনায় আক্রমণের অভিযোগ তুলে সাধারণ রোহিঙ্গাদের উপর নিজের সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছেন সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাইং। গত কিছুদিন ধরে রোহিঙ্গাদের উপর যে দমন-নিপীড়ন অতিরিক্ত মাত্রায় শুরু হয়েছে, তার সূত্রপাত বলা যায় গত আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সেদিন শতাধিক রোহিঙ্গা যোদ্ধা বন্দুক, লাঠি ও ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ নিয়ে হামলা চালায় রাখাইন অঙ্গরাজ্যের উত্তরে থাকা পুলিশ পোস্টগুলোতে। এ আক্রমণে মারা যায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর ১২ সদস্য। রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরেই নির্যাতিত হয়ে আসছিলো, কিন্তু এরপর থেকেই যেন তাদের উপর সেনাবাহিনীর আক্রোশ লাগামছাড়া হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হতে থাকে। এখন পর্যন্ত চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সব হারিয়ে আমাদের দেশে এসে মাথা গোঁজার ঠাই খুঁজে নিয়েছে, প্রতিনিয়ত আসছে আরো অনেকে। মিয়ানমারের ভেতরে ও বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের দেয়া তথ্য মতে, এক লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এখন দেশটিতে সবকিছু হারিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, হত্যা করা হয়েছে আনুমানিক ৫,০০০ রোহিঙ্গাকে!
গুলি, শিরোশ্ছেদ, বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা- এমন কোনোকিছুই বাদ নেই না করছে না মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এ সবই মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এমনকি নিষ্পাপ, অবুঝ শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না তাদের ক্রোধানল থেকে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জাইদ রা’আদ আল হুসেইন রোহিঙ্গাদের উপর সামরিক বাহিনীর এ আক্রমণকে তাই উল্লেখ করেছেন “পাঠ্যবইয়ে থাকা জাতিগত নিধনের নমুনা” হিসেবে।
তো অং সান সু কি এই সেনাপ্রধানকে থামাতে কেন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না? উত্তর হলো- তিনি নিতে পারবেন না, তার সেই ক্ষমতাই নেই! হুম, অদ্ভুত শোনালেও এ কথাটাই সত্য। সেনাবাহিনী-প্রণীত মিয়ানমারের সংবিধানে সেনাবাহিনীর উপর কোনো ক্ষমতাই দেয়া হয় নি সু কির নেতৃত্বাধীন সরকারকে। জনগণের নির্বাচিত সু কির সরকারের কোনো নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য নয় সেনাবাহিনী। ওদিকে এই সেনাবাহিনী আবার নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ, সিকিউরিটি সার্ভিস, জেলখানা, সীমান্ত সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি এবং অধিকাংশ সরকারি চাকরি। শুধু তা-ই নয়, সংসদের শতকরা ২৫ ভাগ আসন সংরক্ষিত আছে সেনাবাহিনীর জন্য। মিয়ানমারের সংবিধানের কোনো বিষয়ে পরিবর্তন আনতে চাইলে শতকরা ৭৫ ভাগ সংসদ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। ২৫ ভাগ যেখানে সেনাবাহিনী একাই নিয়ে রেখেছে, সেখানে বাকি ৭৫ থেকে পুরোটা যে পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব, তা তো সহজেই অনুমেয়। ফলে আপনি ধরে নিতে পারেন যে, মিয়ানমারে দ্বিতীয় আরেকটি সরকার আছে, যার প্রধান হলেন মিন অং লাইং, যে সরকার সশস্ত্র ক্ষমতার অধিকারী!
বোঝাই যাচ্ছে যে, মিনের নেতৃত্বাধীন ভূমিকাই বরং এখানে বেশি খলনায়কসুলভ। এ কথা ভুলেও ভাবতে যাবেন না যে, মিনের উপর দায় চাপিয়ে লেখক সু কিকে শান্তির দূত বানাতে চাইছেন! সু কির ভূমিকা যে মারাত্মক প্রশ্নবিদ্ধ, যা আশা করা হয়েছিলো তার ধারেকাছেও নেই, সেটা তো আগেই বলা হয়েছে। তবে আমরা যখন কেবল সু কিকে নিয়ে মেতে আছি, তখন রোহিঙ্গাদের হত্যায় পর্দার পেছনে কলকাঠি নেড়ে যাওয়া ব্যক্তি যে আসলে আরেকজন, সেটাই বলা হলো। শুধু সাম্প্রতিক সময়ই না, অতীতে রোহিঙ্গা সহ মিয়ানমারের আরো বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার নিয়েও তাকে নিয়ে তদন্তে নেমেছিলো জাতিসংঘ। এমনকি কাচিন ও শান প্রদেশেও তার নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর হাত রঞ্জিত হয়েছে সাধারণ মানুষের রক্তে।
১৯৫৬ সালে মিয়ানমারের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তানিন্থারাই প্রদেশের রাজধানী দাওয়েই শহরে জন্ম নেন মিন অং লাইং। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বাবার ছেলে মিন ১৯৭২ সালে ইয়াঙ্গুনের লাথায় অবস্থিত বেসিক এডুকেশন হাই স্কুল নাম্বার ওয়ান থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৭৩-৭৪ সালে রেঙ্গুন আর্টস এন্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটিতে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। ’৭৪ সালে তিনি ভর্তি হন ডিফেন্স সার্ভিসেস একাডেমিতে। তার আচার-আচরণ ততটা বন্ধুসুলভ না হওয়ায় সহপাঠীরা বরাবরই এড়িয়ে চলত তাকে।
গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর মিনের দায়িত্ব পড়ে মন প্রদেশে। ২০০২ সালে পদোন্নতি পেয়ে তিনি ট্রায়াঙ্গল রিজিওনাল কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০০৯ সাল থেকেই তার খ্যাতি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সেই বছর দেশটির উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত শান প্রদেশের কোকাং অঞ্চলে বিদ্রোহী মিয়ানমার ন্যাশনালিটিস ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির বিরুদ্ধে চালিত অপারেশন ছিলো এর মূল কারণ। ২০১০ সালের জুনে তিনি নিযুক্ত হন দেশটির নৌ, বিমান ও সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফ হিসেবে। ২০১১ সালের ৩০ মার্চ তিনি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নতুন কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে দায়িত্ব পান। পরের বছরের ৩ এপ্রিল মিন পদোন্নতি পেয়ে হন ভাইস-সিনিয়র জেনারেল, যা দেশটির সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদমর্যাদা। সবশেষে ২০১৩ সালের মার্চ মাসে তিনি আরো একধাপ পদোন্নতি পেয়ে হন সিনিয়র জেনারেল, এখন পর্যন্ত আছেন এই সর্বোচ্চ পদেই।
জাতিসংঘের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, জেনারেল মিনের সেনারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই কাচিন ও শান প্রদেশে সাধারণ জনগণকে হত্যা করেছে; ধর্ষণ করেছে রোহিঙ্গা নারীদের, গুলি চালিয়েছে সেখানকার মানুষজনের উপর, জ্বালিয়ে দিয়েছে তাদের বাড়িঘর। এসব ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ড তাকে নিশ্চিতভাবে একজন মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে। শুধু রোহিঙ্গা শিশুদের সাথে তার সেনাবাহিনীর তিনটি নির্মমতার কথা শুনলেই আঁতকে উঠবে যে কেউ।
- জন্মের পরপরই এক রোহিঙ্গা শিশুকে বুট জুতা দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছিলো এক সেনা।
- মাকে ধর্ষণ করছিলো সেনারা, ক্ষুধার্ত বাচ্চাটি কাঁদছিল দুধের জন্য। নিজেদের পশুবৃত্তি চরিতার্থ করতে শিশুটি বাঁধা (!) দেয়ায় তাকে মেরে ফেলে মিনের সেনারা।
- গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়ার পর সেখান থেকে যেসব শিশু পালাচ্ছিলো, তাদেরকে পেছন থেকে গুলি করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, যে সেনাপ্রধান সম্পর্কে এত অভিযোগ, যাকে বলা হচ্ছে রোহিঙ্গা গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড, তার প্রতি বিশ্বের অন্যান্য দেশের আচরণ কেমন? অদ্ভুত ব্যাপার হলো, হত্যার নেতৃত্বদানকারী মিন যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই উষ্ণ অভ্যর্থনায় তাকে বরণ করে নেয়া হয়েছে!
গত অক্টোবরে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারের উপর আরোপকৃত অনেক নিষেধাজ্ঞাই তুলে নেন, যা ছিলো বিশেষত দেশটির সেনাবাহিনীকে দমিয়ে রাখার জন্যই। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সেনাদের জন্য আয়োজন করা হয় প্রশিক্ষণের। এ বছরের শুরুর দিকে অস্ট্রিয়া আর জার্মানিতে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয় মিনকে। সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণের আলাপের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর জন্য যুদ্ধাস্ত্র কিনতে বিভিন্ন ফ্যাক্টরিও পরিদর্শন করেন তিনি। গত বছর ইতালী ভ্রমণে গিয়ে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সাথে মিটিং সেরে আসেন তিনি। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সামরিক প্রধানদের সম্মানজনক সম্মেলনেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো তাকে!
এবার আসা যাক এশিয়াতে। ভারত ও জাপানে রাষ্ট্রীয় সফর সেরে এসেছেন তিনি, দেখা করেছেন সেসব দেশের প্রধানমন্ত্রীদের সাথেও। রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান শুরু করার পর মিন ঘুরে এসেছেন ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড থেকে, আলোচনা করেছেন সামরিক মৈত্রী সুদৃঢ়করণ নিয়ে।
অনেকে মনে করেন, বাইরের দেশগুলোর সাথে এ সুসম্পর্কই মিনকে মানসিকভাবে শক্তিশালী, স্বেচ্ছাচারী করে তুলছে। তিনি মনে করছেন, তিনি যা চাইবেন, ঠিক সেটাই করতে পারবেন। ইয়াঙ্গুনের এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, “জেনারেল কেন হঠাৎ করেই এখন থেমে যাবেন? সামরিক বাহিনী এ বিষয়টাকে (মিয়ানমারের) সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবেই দেখছে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো খুব কম মানুষই আছে যারা জেনারেলকে পিছু ফেরাতে সক্ষম। তিনি এখানকার সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ।”
বিশ্বমানবতার মানবাত্মা জেগে উঠুক, অবসান হোক রোহিঙ্গা সহ বিশ্বের সকল নির্যাতিত জনগণের উপর চলমান বর্বরতার, জয় হোক বিশ্বের কল্যাণকামী মানুষের- এ প্রত্যাশায় আজকের লেখার ইতি টানছি এখানেই।