তলে তলে পুতিনই কী তবে বিশ্বসেরা ধনী?

কথায় আছে, ক্ষমতার সঙ্গে অর্থের একটা অদৃশ্য যোগসূত্র আছে। কথাটা নানান ভাবেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তবে পশ্চিমা বিশ্বের অনেক সংবাদমাধ্যমেই এই কথাটির সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে জড়িয়ে নানা জল্পনা চলছে। পুতিন নিঃসন্দেহে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সর্বশেষ কয়েক বছর তিনি টানা এই খেতাবটি ধরে রেখেছেন। আর এই খেতাবের সূত্র ধরেই মিডিয়ায় এই জল্পনা যে, সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি আসলেই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিও নয়! তবে এই প্রশ্নের তেমন কোনো সদুত্তর মেলেনি, বা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কেও জানা যায়নি। কিন্তু তাই বলে জল্পনার পাখপাখালির ডালপালা মেলা তো আর বন্ধ থাকেনি। পশ্চিমা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম নানান সময়ে বিভিন্ন অসমর্থিত এবং কম বিশ্বাসযোগ্য সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে পৃথিবীর শীর্ষ ধনী হিসেবে উপস্থাপন করার প্রয়াস নিয়েছে। পুতিনের সম্পদের সুলুক সন্ধান নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার এসব জল্পনাগুলো নিয়েই এবারের আয়োজন- পুতিনের সম্পদের খোঁজে।

হাস্যোজ্জ্বল রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন; Source-sputniknews

বিশ্ববিখ্যাত ফরচুন ম্যাগাজিন এপ্রিলে প্রকাশিত তাদের এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, তলে তলে হয়তো পুতিনই বিশ্বের সেরা ধনী। অবশ্য এই প্রতিবেদনে তারাও স্বীকার করে নিয়েছে তাদের উপস্থাপিত সূত্রগুলো দূর্বল। এই প্রতিবেদনে তারা পুতিনের সম্পদ সংক্রান্ত সব ধরনের সূত্রেরই উল্লেখ করেছে। পুতিনের সম্পদের পরিমাণের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি যে সূত্রটি ব্যবহার করা হয় সেটি হচ্ছে ক্রেমলিনের মধ্যম সারির একজন সাবেক উপদেষ্টা স্তানিস্লাভ বেলকোভস্কির বক্তব্য।

রাশিয়া ছেড়ে পশ্চিমে আশ্রয় নেওয়া এই রুশ কর্মকর্তা ২০০৭ সালে বলেছিলেন, পুতিনের সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে ৪০ বিলিয়ন ডলার। এই পরিমাণ সম্পদ তাকে ফোর্বস ম্যাগাজিনের শীর্ষ দশ ধনীর তালিকায় অনায়াসেই জায়গা করে দেবে। তবে এসব সম্পদের কোনোটিই সরাসরি পুতিনের নামে না থাকায় বা প্রকাশিত না হওয়ায় ফোর্বস কখনো ধনীদের তালিকা তৈরির সময় তাকে বিবেচনায় নেয় না। ক্রেমলিনের এই সাবেক কর্মকর্তার অনুমান, পুতিনের নিয়ন্ত্রণে যেসব সম্পদ রয়েছে তার বেশিরভাগই দেশটির বিভিন্ন তেল ও গ্যাস কোম্পানীতে শেয়ার আকারে রয়েছে। তার ভাষ্যমতে, রাশিয়ার তেল কোম্পানী সারগুনেফটেগাজ এর ৩৭ শতাংশ শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করেন পুতিন। জ্বালানি খাতের আরেক শীর্ষ কোম্পানী গ্যাজপ্রম এ পুতিনের রয়েছে সাড়ে চার শতাংশ শেয়ার। এছাড়া গুনভর কোম্পানীতেও পুতিনের শেয়ার আছে বলে জানান তিনি। আমেরিকার ট্রেজারি কর্তৃপক্ষও ২০১৪ সালে একই সুর তুলেছিল। তবে প্রায় শত বিলিয়ন আয় করা এই কোম্পানীটি পুতিনের শেয়ার বা মালিকানার অংশ থাকার বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করেছে।

কৃষ্ণসাগরের তীরে পুতিনের প্রাসাদ; Source-assets6.thrillist.com

২০০৭ সালে ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বেলকোভস্কি বলেন, এছাড়াও আরো হয়তো অনেক সম্পদের উৎস রয়েছে যেগুলো আমি এই মুহুর্তে জানি না। পরে ২০১২ সালে বেলকোভস্কি অন্য একটি সাক্ষাৎকারে পুতিনের সম্পদ বাড়িয়ে বলেন,৭০ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্কটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য রকমের বড়। কারণ, বর্তমান পৃথিবীর শীর্ষ ধনী বিল গেটস এর ২০১৭ সালের অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ৮৯ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১২ সালে বেলকোভস্কি যখন অভিযোগটা তুলেছিলেন তখন বিল গেটস এর সম্পদ ছিল ৮৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বেলকোভস্কির দাবি সত্য হলে পুতিন পৃথিবীর শীর্ষ ধনীর খুব কাছাকাছিই অবস্থান করছেন।

কিন্তু এসব দাবিও পুতিনকে বিশ্বের শীর্ষ ধনীতে পরিণত করতে পারছে না। তাহলে কীসের ভিত্তিতে পুতিনকে বিশ্বের শীর্ষ ধনী বলে অভিযোগ তুলেছে? তাদের অভিযোগের আরেকটি দূর্বল সূত্র হচ্ছে হেজ ফান্ড ম্যানেজার বিল ব্রাউডারের দাবি। চলতি বছরের মার্চে সিএনএন এর উপস্থাপক ফরিদ জাকারিয়ার এক অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে বিল দাবি করেন, পৃথিবীর শীর্ষ ধনী ব্যক্তি হচ্ছেন পুতিন। এই বিল ব্রাউডার এক সময় রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বিদেশী বিনিয়োগকারী ছিলেন। তিনি ওই অনুষ্ঠানে দাবি করেন, পুতিন প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারে মালিক। তার দাবি সত্য হলে পুতিন হবেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনী। সিএনএনের অনুষ্ঠানে ফরিদ জাকারিয়া ব্রাউডারকে জিজ্ঞাসা করেন, “পুতিনের আনুমানিক সম্পদ কত?” জবাবে ব্রাউডার বলেন, “আমার মনে হয় তা ২০০ বিলিয়ন ডলার হবে।”

হেজ ফান্ড ম্যানেজার বিল ব্রাউডার যখন রাশিয়ায়; Source- photoshelter

ব্রাউডার এই সাক্ষাৎকারে জানান, সাবেক কেজিবি কর্মকর্তা পুতিন ১৭ বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় রয়েছেন। ১৯৯৯ সালের আগস্টে তিনি রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং ২০০০ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ব্রাউডার আরো অভিযোগ তোলেন, স্কুল, সড়ক এবং হাসপাতাল নির্মাণ না করে পুতিন এসব সম্পদ সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছেন এবং শেয়ার ও অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। ব্রাউডার বলেন, ক্ষমতার প্রথম ১০ বছরেই পুতিন যতটা পারা যায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি করেছেন। ২০০০ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে প্রায় ৭ শতাংশ। এ সময় জিডিপির আকার ছয়গুণ বেড়েছে। তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে রাশিয়ার অর্থনীতিতে তখন রমরমা অবস্থা বিরাজ করছিল। অর্থনৈতিক উন্নতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পুতিন তার ক্ষমতাকে সংহত করেছেন এবং নতুন কোটারি গোষ্ঠী তৈরি করেছেন, যারা পুতিনের প্রতি অনুগত। তবে ব্রাউডার তার অভিযোগের পক্ষে শক্ত কোনো প্রমাণ দাখিল করতে পারেন নি। তিনি শুধু পুতিনের কিছু সম্পদ এবং বিলাসী জীবনযাপনের কথা তুলে ধরে তার ২০০ বিলিয়ন ডলার সম্পদ রয়েছে বলে দাবি করেন। এই ব্যাপারে রাশিয়ার পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত সরাসরি কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

গুঞ্জণ রয়েছে, গ্রেসফুল নামের এই সুপার ইয়টের মালিক পুতিন; Source- superyachfan

পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় তার কৃষ্ণসাগরের পাড়ের বিশাল একটি প্রাসাদোপম বাড়ি। অনেকের মতে এই বাড়ির দাম এক বিলিয়ন ডলার। এই বাড়িটি তৈরি করা থেকে শুরু করে এর রক্ষণাবেক্ষণ এমনকি নিরাপত্তার কড়াকড়িসহ সবকিছু নিয়েই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। এমনকি ইন্টারনেটের দুনিয়ায় এই বাড়িটির অন্দরমহল বা বহির্পার্শ্বেরও তেমন ভালো কোনো ছবি মেলে না। এই প্রাসাদের পাশাপাশি পুতিনের আরো প্রায় ২০টি বাড়ি রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও আরো অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে- ৫৮টি বিমান ও হেলিকপ্টার এবং পাঁচ লাখ ঘড়ির সংগ্রহ। এসব ঘড়ির সম্মিলিত মুল্য ৪ লাখ ডলারেরও বেশি বলে অনুমান করেছিলেন রাশিয়ার একজন সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া গুঞ্জন রয়েছে গ্রেসফুল নামের ১০০ মিলিয়ন ডলারের একটি বিলাবহুল সুপার ইয়টেরও মালিক পুতিন নিজেই। মস্কো শহরে একটি সুসজ্জিত তিনতলা বাড়িও রয়েছে রুশ এই লৌহমানবের।

বিভিন্ন সময় পুতিনের পরা ঘড়ির একটি কোলাজ ছবি

তবে এতক্ষণ যেসব সম্পদের মালিকানা পুতিনের ওপর আরোপ করা হয়েছে তার কোনোটিরই বাস্তবে কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। পুতিন কখনো তার ব্যক্তিগত সম্পদের বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করেন না। আর রাশিয়ায় একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী পুতিনের সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করার সাহস বোধহয় কারো হবে না। ফলে পুতিনের সম্পদের ব্যাপারে যে রহস্য তা হয়তো কখনো প্রকাশ পাবে না। কিন্তু তারপরও এসব অভিযোগ আর জল্পনা-কল্পনা কখনো থেমেও থাকবে না। তবে সম্পদ থাক আর না থাক, পুতিন কিন্তু নিজেকে শুধূ ইউরোপের না বিশ্বের সেরা ধনী বলেই মনে করেন। নিউইয়র্ক টাইমস এর রিপোর্টার স্টিভেন লি মেয়ার তার দ্য নিউ জার বইয়ে পুতিনকে উদ্ধৃত করেছেন ঠিক এভাবে, “আমি শুধু ইউরোপের নই, আমি বিশ্বেরও সেরা ধনী। কারণ, তারা (রুশ জনগণ) দুই দুই বার আমার ওপর আস্থা রেখেছেন।  আমার সম্পদ হচ্ছে তাদের বিশ্বাস এবং ভালোবাসা।”

ফিচার ছবি: bbc.com

Related Articles

Exit mobile version