রিগোলেট, কানাডার পূর্ব কোণের এক ছোট শহর, বাইরের সাথে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তিনশত বাসিন্দার এই শহরটির সাথে আধুনিক পৃথিবীর যোগাযোগের অন্যতম একটি মাধ্যম হলো প্রচন্ড ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া লেক আর নদী। হিমাংকের নীচের তাপমাত্রায় প্রচন্ড ঠাণ্ডায় আশপাশের লেক আর নদীর পানি জমে গিয়ে তৈরী হয় পৃথিবীর দুর্গম এক হাইওয়ে। আর এই হাইওয়েতে ভর করেই জীবনধারায় অভ্যস্ত পৃথিবীর দক্ষিণতম এই ইনুইট সম্প্রদায়ের।
কারা এই ইনুইট?
আলাস্কা, গ্রীনল্যান্ড, সাইবেরিয়া আর কানাডার পূর্বাংশে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এই ইনুইটদের দেখা যায়। সাধারণ মানুষের কাছে ‘এস্কিমো’ নামেই এরা পরিচিত। তবে ‘এস্কিমো’ শব্দের প্রকৃত অর্থ ‘কাঁচা মাংসখেকো’ হওয়ায় অনেকের মতেই এই নামটি এড়িয়ে যাওয়া উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন করেই রহিত করে দেওয়া হয়েছে ‘এস্কিমো’ শব্দটি। মেরু অঞ্চলের সাদা তুষারের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা এই মানুষগুলো নিজেদেরকে ‘ইনুইট’ বা ‘মানুষ’ নামে ডাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
পৃথিবীজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেশ এদেরও ছুঁয়ে গেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে একদিকে যেমন মেরুর বরফ গলছে, সাথে এই ইনুইটদের জীবনধারাও বদলে যাচ্ছে। একটু আগেই যে বরফের হাইওয়ের কথা বলা হচ্ছিলো সেগুলো দিনে দিনে নড়বড়ে আর ভঙ্গুর হয়ে উঠছে, মেরু ভালুক সহ বরফের সাথে মিতালি করে বেঁচে থাকা এসব প্রাণীদের উপর সৃষ্টি হচ্ছে চাপ।
৬১ বছর বয়সী এক ইনুইট শিকারী ডেরিক পোটল নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছিলেন, তুষারের কঠিন আর রুক্ষতাকে ভালোবাসা এসব ইনুইটদের জন্য জীবন কতটা কঠিন হয়ে উঠেছে। জীবনের প্রতি বছরই কোনো না কোনো তুষারঝড় পাড়ি দিয়েছেন, স্লেজ টানা গাড়ির পথ পড়ি দিয়ে স্নো-মোবাইলের যুগটাও বেশ উপভোগ করছেন। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সাতটি মরু ভালুক শিকার করেছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন রিগোলেট সহ আশপাশের বিস্তৃত এলাকা।
নিজ ভূমে পরবাসী
চার দশক আগেও যেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারতেন ইনুইটরা সেখানে ধীরে ধীরে দেখা যাচ্ছে ফাটল, জায়গায় জায়গায় কমছে বরফের পুরুত্ব। স্নো-মোবাইল কিংবা স্লেজ টানা গাড়ি দিয়ে যাতায়াত হয়ে উঠছে অনেকটাই বিপজ্জনক। ডেনরিকের মতে, তার জীবদ্দশাতেই রিগোলেট এবং আশাপাশের এলাকার বরফের পুরুত্ব কম করে হলেও চল্লিশ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
নিউফাউন্ডল্যান্ড মেমোরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষকদল সম্প্রতি বরফের পুরুত্ব কমে যাওয়ার ফলে ইনুইট এবং এই এলাকার প্রাণীবৈচিত্র্যের উপর সৃষ্ট প্রভাব নিয়ে কাজ করছে। তাদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই এলাকায় অনেক বেশী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি মেরুর বরফ গলে যাওয়ায় তৈরী হচ্ছে ‘Arctic amplification’। এটি মূলত একটি দুষ্টচক্রের মত কাজ করে। যেমন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরুর বরফ গলে যাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির পরিমাণ বাড়ছে। শ্বেতশুভ্র বরফ সমপরিমাণ পানির তুলনায় অনেক কম তাপ গ্রহণ করে। বরফের রঙ সাদা হওয়ার কারণেই এটি সুর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে দেয়। এর তুলনায় পানি অনেক বেশী তাপ গ্রহণ করে। ফলে সমুদ্রের পানিতে অনেক বেশী তাপ বন্দি হয়ে থাকে, যা আবার পৃথিবীর উষ্ণায়ন এবং মেরুর বরফ গলনে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে। এভাবেই ‘Arctic amplification’ এর দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খেয়ে মেরু এলাকার বরফের পুরুত্ব কমছে প্রতি বছর। আর দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস করে আসা এই ইনুইটরা নিজ ভূমেই পরবাসী হয়ে পড়েছেন। অনেকটা দুঃখ নিয়েই ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস‘কে দেওয়া এক বিবৃতিতে ডেনরিক বলেন,
“You can’t get in or out of communities. We’re almost like prisoners.”
চরম খাদ্য সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে ইনুইটরা
ইনুইটদের খাদ্যাভ্যাসের এক বড় অংশ জুড়ে আছে মেরু ভালুক, সিল, বিভিন্ন ধরনের মাছ, পাখি আর কয়েক ধরনের তিমি (Bow-head whale)। ভাল নেই এই প্রাণীদের কেউই, অনেকটা বাধ্য হয়েই সবাই পা দিয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের নির্মম ফাঁদে। সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন জরিপ আর সমীক্ষা বলছে, মেরুর সাদা ভালুকের সংখ্যা কমছে আশঙ্কাজনক হারে।
কানাডার বাফিন দ্বীপে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের করা একটি ভিডিওচিত্রে উঠে এসেছে কীভাবে খাদ্যের অভাবে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে একটি মেরু ভালুক। মূলত ‘সিল’ নামক একধরনের সামুদ্রিক প্রাণীর উপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকে এই মেরু ভালুক। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কালো থাবায় নষ্ট হচ্ছে সিলের বাসস্থান আর প্রজননক্ষেত্র। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মেরু ভালুক, ইনুইট সহ এই খাদ্যশৃংখলের বাকী সবাই। খাদ্যশৃংখলের একটি প্রাণীর স্বাভাবিক জীবনধারা ব্যহত হলে যে বাকিরা কত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় তা টের পাচ্ছেন এই ইনুইটরা।
অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে ইনুইটরা
সমস্যা সমাধান এবং ইনুইটদের পুনর্বাসনের একটি সম্ভাব্য উপায় খুঁজে বের করতে বেশ কয়েক বছর ধরেই বিজ্ঞানীরা কানাডার রিগোলেট এলাকার অধিবাসীদের নিয়ে গবেষণা করছেন। বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রার বৃদ্ধির ফলে খাদের একদম কিনারায় দাঁড়িয়ে এই মানবগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হচ্ছে বলেই এসব গবেষণা থেকে উঠে এসেছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রার প্রাণিজ প্রোটিনে আর চর্বি সমৃদ্ধ খাদ্যে অভ্যস্ত এই জনগোষ্ঠী দ্রুত তাদের খাদ্যাভ্যাস বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। তাতে একদিকে যেমন দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা, পাশাপাশি তারা শিকার হচ্ছেন নানা মানসিক প্রতিবন্ধকতার। এমনকি কানাডার রিগোলেট এলাকায় বসবাসরত ইনুইট জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার সর্বোচ্চ। আমেরিকান জার্নাল অফ পাবলিক হেলথে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ১৯৯৩ সাল থেকে শুরু করে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কানাডিয়ান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা গেছে, কানাডায় বসবাসরত ইনুইট জনগোষ্ঠীর তরুণদের মধ্যে বাসা বেঁধেছে আত্মহত্যার প্রবণতা। উচ্চ আত্মহত্যার এই প্রবণতার পেছনে পরিবেশগত কারণে উদ্ভূত সমস্যাগুলোকেই দায়ী করছেন অনেকেই।
কিছুই কি করার নেই?
বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বাড়ছে, এই বাক্যটি নানাভাবে উন্নত দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা অস্বীকার করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ভুয়া বলেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে এই উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলো প্রতিনিয়ত ভোগান্তির মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষদের। মেরুর ইনুইট জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে উপকূল কিংবা দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে বসবাসরত মানুষদের নীরব কান্না শোনার মত কেউ নেই। একদিকে যখন বরফ গলে যাবার ফলে মেরু অঞ্চলে সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশগত শূন্যতা, সেই শূন্যতায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে ইনুইটের মত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, মেরু ভালুক আর সিলের মত প্রাণীরা। অন্যদিকে তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে উপকূল আর দ্বীপের মানুষগুলো হচ্ছে জলবায়ু শরণার্থী। এক দশক আগের উর্বর জমিগুলোও লবণাক্ততার বিষাক্ত ছোঁয়ায় হারাচ্ছে ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বিশ্ব নেতাদের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরী। রাতারাতি হয়তো কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে এনে বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে একদম থামিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এখনই যদি কার্বন ডাইঅক্সাইড সহ গ্রীন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণকে উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে না আনা যায়, তাহলে হয়তো পৃথিবীর এক বিপুল অংশ আর বাসযোগ্য থাকবে না। হয়তো হারিয়ে যাওয়ার সেই তালিকায় ইনুইটদের নামটাই উঠে যাবে।
ফিচার ইমেজ- share.america.gov