মিডিয়ার কল্যাণে ‘আর্থিক সংকট’ শব্দগুচ্ছ এখন বহুল প্রচারিত এবং আমাদের কাছে অনেকাংশেই পরিচিত। ২০০৮ এবং তার পরবর্তী কয়েক বছরের ভয়াবহ আর্থিক সংকট কাঁপিয়ে দিয়েছিল সারা দুনিয়ার আর্থিক ব্যবস্থাকে। উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা ততটা টের পাইনি এই সংকটের ভয়াবহতা। কিন্তু উন্নত দেশগুলো তখন পার করেছে স্মরণকালের ভয়াবহতম আর্থিক বিপর্যয়। ধ্বসে পড়েছিল ওদের ব্যাংকিং ব্যাবস্থা। দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল লেম্যান ব্রাদার্সের মতো ঐতিহ্যবাহী বিনিয়োগ ব্যাংক। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বেকারত্ব। নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল অনেক পরিবার, যারা এমনকি হারিয়েছিল মাথা গোঁজার শেষ ঠাঁইটুকু। এককথায়, ২০০৮ সালের এই আর্থিক সংকটকে শুধুমাত্র তুলনা করা যায় গত শতাব্দীর ৩০ দশকের মহামন্দার সাথে, যা ভেঙে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড।
উপরের এই দুটো ঘটনা ছাড়াও সভ্য পৃথিবী দেখেছে আরো অনেকগুলো ভয়াবহ আর্থিক সংকট। এসব সংকটের পিছনে নানা ধরনের কারণ দায়ী থাকলেও প্রতিটি ঘটনার মূলে গেলে দেখা যাবে যে, মানুষের সীমাহীন লোভ ডেকে এনেছে এই অচিন্ত্যনীয় দুর্ভোগ।
প্রশ্ন আসতেই পারে, আর্থিক সংকট আসলে কী? খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে, আর্থিক সংকট হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যার ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা আর্থিক সম্পদ খুব দ্রুত তার মূল্য হারায়। উদাহরণস্বরুপ আমরা বলতে পারি পুঁজিবাজারের কথা। পুঁজিবাজারে যেসব শেয়ার লিস্টেড থাকে সেগুলো যদি কোনো কারণে দ্রুত মূল্য হারায় তাহলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সবাই তখন চেষ্টা করে তার বিনিয়োগ করা অংশ বিক্রি করে দিয়ে যতটা কম সম্ভব ক্ষতি স্বীকার করে বাজার থেকে মূলধন তুলে আনার। ফলে বাজারে আরো বড় পরিসরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং আরো দ্রুত এই বাজারে লিস্টকৃত শেয়ারগুলো মূল্য হারায়। মূলত, আর্থিক ব্যবস্থা একটি চমৎকারভাবে সাজানো বৃত্তাকার চক্র, কোনো কারণে এই চক্রের কোনো অংশের স্বাভাবিক পরিচালনায় গোলমাল হলে পুরো ব্যবস্থার উপরে এর প্রভাব পড়ে।
প্রিয় পাঠক, আসুন তাহলে দেখে নেওয়া যাক এরকম দুটো আর্থিক সংকট, যা কাঁপিয়ে দিয়েছিল সমসাময়িক আর্থিক ব্যবস্থা আর ডেকে এনেছিল সীমাহীন দুর্ভোগ, দারিদ্র এবং মানবিক বিপর্যয়।
১. ওপেক তেল সংকট- ১৯৭৩
ওপেক (OPEC: Organization of the Petroleum Exporting Countries) হলো তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট যার বেশিরভাগ সদস্যই আরব। ১৯৭৩ সালের চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের সময় ইজরায়েলকে উদার হাতে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছিল পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ওপেকভূক্ত দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের তেল রপ্তানীতে অবরোধ আরোপ করে। এই অবরোধের ফলাফল ছিল ভয়াবহ। ১৯৭৪ সালের মধ্যেই তেলের দাম ৩ ডলার/ব্যারেল থেকে বেড়ে হয়ে গেল ১২ ডলার/ব্যারেল। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উন্নত দেশগুলো রাতারাতি অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির শিকার হলো। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হওয়া অর্থনৈতিক স্থবিরতা দেশগুলোকে ঠেলে দিল আরো বড় সংকটের দিকে।
এই সংকটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এর মাধ্যমেই মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশগুলো প্রথম তাদের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এর আগপর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলো নামেমাত্র মূল্যে তাদের কাছ থেকে তেল নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে তেল সমৃদ্ধ আরব দেশগুলো উচ্চমূল্যে তেল বিক্রির টাকায় সম্পদশালী হয়ে ওঠা শুরু করে।
অন্যদিকে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো সাবধান হয়ে যায় ভবিষ্যতের কথা ভেবে। তারা তখন থেকেই পরিকল্পনা শুরু করে কিভাবে মধ্যপ্রাচ্যকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসে এই বিপুল তেল সম্পদের উপরে নিজেদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পাকাপোক্ত করা যায়।
পশ্চিমাদের পরিকল্পনা কতটুকু সফল হয়েছে তা বিচারের ভার পাঠকের উপরে ছেড়ে দিলাম।
২. লাতিন আমেরিকার সার্বভৌম ঋণ সংকট- ১৯৮২
সার্বভৌম ঋণ সংকট (Soverign Debt Crisis) হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যখন কোনো দেশ তার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়। লাতিন আমেরিকার সার্বভৌম ঋণ সংকটের পেছনে ওপেক তেল সংকটের বড় ভূমিকা ছিল। তেলের দাম প্রায় রাতারাতি ৪-৫ গুণ বেড়ে যাওয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলো মহাবিপদে পড়ে যায়। তেল আমদানীকারক দেশগুলো এই বাড়তি খরচের সংস্থান করার জন্য বৈদেশিক ঋণের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই ঋণের বেশীরভাগই ছিল পশ্চিমাদের বিভিন্ন সংস্থা, যেমন বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নেওয়া। এদিকে ওপেক তেল সংকটের ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। ফলে এই ঋণগুলোর উপরে এতটাই বেশী সুদ চলে আসে যেটা পরিশোধ করা ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর সাধ্যের বাইরে চলে যায়।
প্রশ্ন জাগতে পারে, ঐ সময়ে তাহলে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে এত ঋণ কেন দেওয়া হয়েছিল। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। প্রথমত, সেই আমলে এটা ধরে নেওয়া হতো যে, একটি দেশ কখনো ঋণখেলাপী হতে পারে না। কারণ দেশের সরকার জনগণের ওপর করারোপ করতে পারে এবং সেই করের বা ট্যাক্সের টাকা দিয়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে এটা সত্য হলেও বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। যেমন কিছুদিন আগেও (২০০৯/১০ সালের দিকে) গ্রিস তার জাতীয় ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, যার ফলশ্রুতিতে পুরো ইউরো অঞ্চলে ছড়িতে পড়েছিল আর্থিক সংকট যা ইউরোপ অঞ্চলের সার্বভৌম ঋণ সংকট নামে পরিচিত।
দ্বিতীয়ত, ঐ সময়ে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর মেক্সিকোর মতো দেশগুলো উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতো এবং এই দেশগুলোর বেগবান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মেলানোর জন্য দরকার ছিল বিপুল অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এই বিশাল অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের বেশিরভাগই বাস্তবায়িত হয়েছিল বৈদেশিক ঋণ দিয়ে। কিন্তু একটা সময় গিয়ে দেখা গিয়েছিল, অর্জিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঋণ পরিশোধ করার জন্য যথেষ্ট নয়।
তৃতীয়ত, ওপেক তেল সংকটের সময় আরব দেশগুলো তেল বিক্রি করে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়েছিল সেটাই আবার আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং চ্যানেলে অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টি করেছিল।
ব্যাংকগুলো সেই অতিরিক্ত তারল্য বিনিয়োগ করেছিল তখনকার সময়ের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল বিনিয়োগ অঞ্চল লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে। তবে এভাবে উদার হাতে ঋণ দিয়ে কোনো দেশকে কোণঠাসা করে সেখানে নিজস্ব প্রভাব বলয় সৃষ্টি করাও অনেক পুরোনো একটি কৌশল এবং সেটাও এই সংকটের পেছনের একটি কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সবকিছু মিলিয়ে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, ১৯৮২ সালে মেক্সিকো ঘোষণা করল তার পক্ষে আর বৈদেশিক ঋণের কিস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। যে ব্যাংকগুলো লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে ঋণ দিয়ে রেখেছিল তারা রাতারাতি আতঙ্কিত হয়ে পড়ল এবং তাদের দেওয়া ঋণ সুদ-আসলে আদায় করে আনতে তৎপরতা শুরু করল। ফলাফল হলো আরো খারাপ। এই অঞ্চলে দেওয়া অধিকাংশ ঋণই ছিল স্বল্পমেয়াদী। যখন এই ঋণগুলো ফেরত দেওয়ার সময় চলে এলো তখন আর কোনো ব্যাংকই সেটা নতুন করে দিতে আগ্রহ দেখাল না।
যখন ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলো একসাথে সবার ঋণ ফেরত দিতে ব্যর্থ হলো, তখন সেই ঋণগুলোই আরো উচ্চসুদে শ্রেণীকরণ করে তাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হলো। আর এই বিপুল ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দেশগুলো সবধরণের আভ্যন্তরীণ উন্নয়নমূলক খাত, সামাজিক কল্যাণ প্রোগ্রাম, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার পূরণের জন্য যেসব অত্যাবশ্যকীয় কার্যক্রম থাকে সেগুলো থেকে টাকা সরিয়ে নিয়ে এসে তুলে দিতে লাগল ঋণদাতাদের হাতে।
ফলশ্রুতিতে ল্যাটিন আমেরিকার অর্থনৈতিক মেরুদন্ড পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছিল। বিপুল বেকারত্ব, উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর ক্রমাগত কমতে থাকা ক্রয়ক্ষমতা নাগরিকদের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিল। এক হিসেবে দেখা গেছে যে, আশির পরবর্তী এক দশকে এই অঞ্চলের মানুষের প্রকৃত আয় ২০-৪০% কমে গিয়েছিল! অবধারিতভাবেই কমে গিয়েছিল জাতীয় উৎপাদন, মাত্র ৫ বছরে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে ৯% ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল! পরিস্থিতির ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে পুরো ‘৮০র দশককেই বলা হয় লাতিন আমেরিকার ‘হারিয়ে যাওয়া দশক’।
আজ এ পর্যন্তই। পরের লেখাগুলোতে আলোচনা হবে আরো সব আর্থিক বিপর্যয় নিয়ে।
ফিচার ইমেজ- activistpost.com