গুমারো পেরেজ, বয়স ত্রিশের কোঠার এক মেক্সিকান সাংবাদিক, তার ৬ বছর বয়সী পুত্রের সাথে বড়দিন উদযাপন করতে ভ্যারাক্রুজের এক প্রাথমিক স্কুলে পৌঁছে গেলেন গত ডিসেম্বরের এক মঙ্গলবারের সকাল সকাল। দুপুরের আগেই খুন করা হলো তাকে। স্কুলে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে বন্দুকধারী দুই সন্ত্রাসী এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। স্থানীয় গণমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, ডজনখানি শিক্ষার্থীর সামনে প্রায় চার রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে হত্যা করা হয় পেরেজকে। পেরেজ ছিলেন অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিক। মাদক চোরাচালান থেকে শুরু করে মেক্সিকোর নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ লিখেছিলেন তিনি। পেরেজকে নিয়ে গত বছরে কেবল মেক্সিকোতেই খুন করা হলো ১২ জন সাংবাদিককে। তাদের অপরাধ, সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রগুলোকে শান্তিতে কাজ করতে না দেয়া। শুধু মেক্সিকোতেই নয়, সিরিয়া, তুরস্ক, মিশরসহ বেশ কয়েকটি গত বছর সাতেক ধরে একের পর এক সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে।
‘বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা দিবস’ পালনের মাধ্যমে সারা বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের সুরক্ষা আর গণমাধ্যমের মুক্তির জন্য একপ্রকার আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছে। মে মাসের ৩ তারিখে পালিত এই দিবসটি যেন নতুন করে একবার সবাইকে মনে করিয়ে দেয় ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ বিষয়টিকে কতটা ঠুনকো আর স্বল্প পরিসরের একটি চিন্তা হিসেবে দেখা হয়। বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা ইনডেক্সের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গত বছরের ২০ এপ্রিল। ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’, যারা মূলত রিপোর্টার্স স্যান ফ্রন্টিয়ার্জ (আরএসএফ) নামে পরিচিত, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সাংবাদিকরা এ প্রতিবেদনে বলেন,
“সরকারি এবং বেসরকারি উভয় পর্যায়ের গণমাধ্যমেই সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে। সেন্সরশিপ, প্রোপাগান্ডা, মতাদর্শ আর সংবাদ নিয়ন্ত্রণ নামক হাতিয়ারের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ তাদের স্বেচ্ছাচারিতা প্রকাশ করছে। বিশেষত ধর্মীয় উগ্রবাদকে পুঁজি করে নানা ধরনের আইন পাস হচ্ছে প্রতিনিয়ত, যা সাংবাদিকদের জন্য রীতিমতো বিভীষিকা।”
মুখে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বললেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকদের সাথে কী ঘটছে, চলুন তবে দেখে আসা যাক।
১) রাশিয়া
আরএসএফ প্রকাশিত ইনডেক্সে সাংবাদিকদের জন্য নিরাপত্তার ভিত্তিতে ১৪৮ তম অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া। “অনুসন্ধানী নিউজ আউটলেটগুলোর বেশিরভাগই হয় সাংবাদিকদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সরকারের আওতায় নিয়ে যাওয়া হয় অথবা সেই পেপারগুলোর পরবর্তীতে আর কোনো অস্তিত্বই থাকে না”, আরএসএফের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে রাশিয়ার এহেন অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে।
সোভিয়েত যুগ থেকে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো তো বটেই, পাশাপাশি বেসরকারি গণমাধ্যমগুলোও যেন নতুন করে সাংবাদিকদের পিছু নিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ আক্রমণের সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে গেছে। ইগোর ডমনিকভকে, রাশিয়ান ভিন্নমতাবলম্বী সংবাদপত্র ‘নোভায়া গ্যাজেটা’র সম্পাদক, নৃশংসভাবে আক্রমণ করা হয় ২০০২ সালে। সেই আক্রমণ কাটিয়ে উঠতে না পেরে শেষপর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি। গত বছরের মার্চ মাসে চেচনিয়ায় সংবাদ সংগ্রহের সময় একদল সাংবাদিকের উপর বর্বরোচিত হামলা করে সন্ত্রাসীরা, বিবিসি থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী এমনটাই জানা যায়।
এসব অভিযোগ নিয়ে কর্তৃপক্ষ অবশ্য যথারীতি খুবই নীরব অথবা কূটনৈতিক অবস্থানে রয়েছে। তাদের মতে, সন্ত্রাসী হামলা যতটা না বাস্তবে বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি গুজব ছড়িয়ে পড়েছে মিডিয়াতে। সংঘবদ্ধ চক্রের প্রোপাগান্ডার ফলেই নাকি এমনটা হচ্ছে। “ক্রেমলিনের নীতি নির্ধারণী পন্থার সাথে বিন্দুমাত্র সহযোগিতা করছে না গণমাধ্যম। ‘তথ্য যুদ্ধ’ ঠেকাতে কিছু ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর অবস্থানে যেতেই হবে। কাজেই পক্ষপাতমূলক সংবাদ ছড়িয়ে কেউ পার পেয়ে যাবে, সেই সুযোগ আর থাকছে না”, সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ নিয়ে কথা বলার পরিবর্তে বরং নিজেদের পলিসি নিয়েই বেশি চিন্তিত রাশিয়ান সরকার।
২) তুরস্ক
আরএসএফের ইনডেক্সে সাংবাদিকদের জন্য নিরাপত্তার ভিত্তিতে তৈরি লিস্টে ১৫১ তম অবস্থানে রয়েছে তুরস্ক। গত ৭ বছরে রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ কিংবা তাকে অপমান করার অভিযোগে প্রায় ১,০০০ সাংবাদিককে অভিযুক্ত করেছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এছাড়া এখনো পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃত সাংবাদিকের সংখ্যাও ১০০ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানায় আরএসএফ।
তুরস্কের পুলিশ সাংবাদিকদের সাথে কেমন ব্যবহার করে তার একটি উদাহরণ দেয়া যাক। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোগানের বিরোধী হিসেবে বহুল পরিচিত একটি মিডিয়া গ্রুপে হানা দেয় পুলিশ। সেটি অক্টোবর মাসের কথা, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত সময়ের ঠিক আগের দিনটিই বেছে নিয়েছিল পুলিশ। রেইডটিকে পুলিশ চিহ্নিত করে ‘সন্ত্রাসবাদী প্রোপাগান্ডা এবং সন্ত্রাসবাদের অর্থদাতা হিসেবে সন্দেহভাজনদের সাথে সংশ্লিষ্ট’ হিসেবে। তাদের খবরদারির কারণে মিডিয়া হাউজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে এমন গণমাধ্যমের উদাহরণও নেহাত কম নয়।
দেশটির কুর্দিশ অংশের অবস্থা বেশি খারাপ। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার মতে, সরকার তাদের অনেক আগে থেকেই সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করে। “সাংবাদিকরা এখানে ক্রমাগত নিপীড়িত, দেশটির ইন্টারনেট সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রিত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘প্রেসিডেন্টকে অপমান করার অভিযোগে অভিযুক্ত’ করা হয় সাংবাদিকদের। আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট- যেমন সিরিয়া এবং তুরস্কের মধ্যকার যুদ্ধে পিকেকে কুর্দিদের নোংরাভাবে উপস্থাপনের পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমকে আরও হেয় করার ইস্যু পাচ্ছে সরকার। সোজা ভাসায় তাদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যায়িত করে কর্তৃপক্ষ,” জানায় আরএসএফ।
৩) মিসর
লিস্টের ১৫৯ তম অবস্থানে থাকা মিসরের রয়েছে সাংবাদিকদের হয়রানি এবং আটক করার দীর্ঘ ইতিহাস। সাংবাদিক প্রতিরক্ষা কমিটির মতে, সাংবাদিকদের জন্য এটিকে দ্বিতীয় বৃহত্তম জেল হিসেবে অভিহিত করা হয়। “জেনারেল সিসির (আব্দেল ফাত্তা) নেতৃত্বে, বর্তমান কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনা করছে ‘সিসিফিকেশন’ পরিচালনা করার। নব্য নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বিরুদ্ধে ডাইনি নিধনের মতো একটি অমানবিক প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যমকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে সিসি সরকার,” জানায় আরএসএফ।
আল জাজিরা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, “নজিরবিহীন কঠোর ব্যবস্থার নামে দেশটির সাংবাদিক ইউনিয়ন থেকে দুজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এমনটি আগে আর কখনো ঘটেনি।” ২০১৪ সালের জুন মাসে, আল জাজিরার একাধিক সাংবাদিককে দোষী সাব্যস্ত করে সরকার। মুসলিস ব্রাদারহুডকে সহায়তা করার অপরাধে সেসব গণমাধ্যমকে এককথায় ‘সন্ত্রাসী সংস্থা’ হিসেবে অভিহিত করে কর্তৃপক্ষ।
৪) চীন
অসংখ্য সাংবাদিকের উপর নির্যাতন চালানো ও তাদের কারারুদ্ধ করার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে তালিকার ১৭৬ তম অবস্থানে রয়েছে চীন। “সাংবাদিকদের কাজে অনধিকার চর্চা করে তাদের উপর গণহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার,” চীনে সাংবাদিকদের হালচাল সম্পর্কে এমনটাই জানায় আরএসএফ। “রাষ্ট্রযন্ত্রের গোপন নথি এবং অপরাধ আইনের সাথে মানিয়ে নিতে সাংবাদিকদের অনেকে ভয়ঙ্কর অস্ত্রাগারের সাথে যোগাযোগ রাখতে বাধ্য হচ্ছে। নিয়ম-কানুনের কড়াকড়ির নামে সাংবাদিকদের বরং অন্যায়ের পথে ঠেলে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।”
টুইট করা, সরকারের অপছন্দের কোনো তথ্য ফাঁস করা, এমন কোনো প্রতিবেদন লেখা যা পড়ে সরকারের মনে হয়েছে এখানে তাদের পক্ষ নেয়া হয়নি- এসব অপরাধে হরহামেশাই কারাগারে পাঠানো হচ্ছে সাংবাদিকদের। ঝি জিনপিং চায়না প্রধান হওয়ার পর থেকে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। “শীর্ষ সংবাদের শিরোনামে অবশ্যই ঝি জিনপিংয়ের নাম উল্লেখ করতে হবে। আর দ্বিতীয় প্রধান শিরোনামে প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের কথা থাকতে হবে,” ‘দ্য গার্ডিয়ান’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানান চীনের শীর্ষস্থানীয় একটি গণমাধ্যমের সম্পাদক। তার ভাষ্যমতে, “চীনের একটি পত্রিকা পড়া মানে সবগুলো পত্রিকা পড়ে ফেলা!”
৫) ইরিত্রিয়া
পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটিতে সাংবাদিকদের সাথে গত ৮ বছরে যে ব্যবহার করা হয়েছে, তার ফলশ্রুতিতে তারা ইনডেক্সের ১৮০ তম অবস্থানে রয়েছে। “এই মুহূর্তে কম করে হলেও অন্তত ১৫ জন সাংবাদিক কারাগরে রয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে নির্জন কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে,” জানায় আরএসএফ। “ইরিত্রিয়ার আর প্রতিটি বিষয়ের মতো গণমাধ্যমও পুরোপুরি প্রেসিডেন্ট ইসায়াস আফিওয়ার্কির ইচ্ছেমত পরিচালিত হয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে গলা টিপে হত্যা করা এই প্রেসিডেন্টের মধ্যে গণমাধ্যমকে ছাড় দেয়ার বিন্দুমাত্র কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না”।
ইরিত্রিয়ার সরকার পরিচালিত একমাত্র গণমাধ্যম ইরি টিভি ছাড়া সেই অর্থে সক্রিয় আর কোনো গণমাধ্যম নেই। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ অনুসন্ধান করে দেখেছে, সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বহির্বিশ্বের কোনো খবর ইরিত্রিয়ায় ঢুকবে, এমন কোনো সুযোগ নেই। সুইডিশ-ইরিত্রিয়ান সাংবাদিক দাওয়িত ইসাক বলেন, “নির্জন কারাগারে নিক্ষেপ আর কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই গ্রেপ্তার করার এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয় ২০০১ সালে। গত ১৩ বছরে পরিবার বা আইনজীবীদের সাথে কথা বলার সুযোগ পাননি এমন সাংবাদিক এখনো জেলখানায় রয়েছেন”।
ইনডেক্সে তালিকার শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যান্ড, এরপর যথাক্রমে রয়েছে নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, ডেনমার্ক আর নিউজিল্যান্ড। যুক্তরাষ্ট্র ৪৯ তম অবস্থান থেকে এ বছর ৪১ তম অবস্থানে এসেছে।
ফিচার ইমেজ- alshahidwitness.com