“তোমার বাবা ছিলো ইঞ্জিন ড্রাইভার, আমার বনেদী ব্যবসা
বংশের ইজ্জত রাখতে হলে, বউ হতে হবে ফরসা।
বাঙালির ছেলে তাই গলায় গামছা দিয়ে ফেললাম করেই বিয়ে
ছোট্টবেলার প্রেম আমার কালো মেম, কোথায় গেলে হারিয়ে…”
ম্যারি অ্যানের প্রেমিক অঞ্জন সেকেলে (বর্ণবাদী) বাঙালি পরিবারে জন্মেছিলেন বলে লিরিকটা অমন হয়েছিলো। কিন্তু যদি অঞ্জন জন্ম নিতেন মৌরিতানিয়ায়? তখন লিরিকটা বোধ হয় হত নিচের মতো-
“বাবার গাঁটে আছে তেল বেচার টাকা, মন নেই আমার ব্যবসায়
বংশের ইজ্জত রাখতে হলে, বউ হতে হবে স্থূলকায়।
ঐতিহ্যে প্রেম তাই ‘শুকরিয়া’ বলে ফেললাম করেই বিয়ে
ছোট্টবেলার প্রেম আমার রোগা মেম, কোথায় গেলে হারিয়ে…”
উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়াতে অবস্থা এমনই। সেখানে বিয়ের বাজারে মোটা মেয়ের কদর আকাশচুম্বী। তাই কনে হিসেবে দর বাড়াতে বাড়তি খেয়ে মোটাতাজা হবার ভালো রকম অনুশীলন আছে দেশটিতে। অধুনা বিশ্ব যখন ‘জিরো সাইজ’কে আদর্শ বানিয়ে ক্ষীণ হবার চেষ্টায় ব্যস্ত, তখন এই একটি দেশের মেয়েদের যেতে হচ্ছে ‘কনে মোটাতাজাকরণ কেন্দ্রে’! উন্নত বিশ্বে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাশযাপন হিসেবে ছেলেমেয়েরা ক্যাম্পিং করে। তার আদলে মৌরিতানিয়ান মেয়েরা যায় (আদতে পাঠানো হয়) সেই সব মোটাতাজাকরণ কেন্দ্রে।
সৌন্দর্যের রকমফেরে স্থূলতার ‘সাফাই’
একেক স্থানে নারীর সৌন্দর্য বা কনের ধরন নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গী একেক রকম। এই যেমন মিয়ানমারের বেশ কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর কাছে সরু গলদেশের মেয়ে হলো আকর্ষণীয়, নাগাল্যান্ডের এক আদিবাসী গোষ্ঠীর কাছে নিচের ঝোলা ঠোঁট আকর্ষণীয়, আবার চীন-জাপানের অনেক সেকেলে মানুষের কাছে মেয়ের শিশুসুলভ ছোট্ট পায়ের পাতা আকর্ষণীয়। যেসব সৌন্দর্য ধারণ করতে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের অনুশীলন শেখানো হয়, গলায়-ঠোঁটে-পায়ে ধাতব বেড়ি পরানো হয়। আবার পুরো ভারতে এমন উপকথা আছে বা আকর্ষণীয় কিছু গবেষণাও আছে যে, দক্ষিণী ছবির দর্শকেরা নায়িকার পেট দেখতে কেন এত বেশি পছন্দ করেন!
তো উপর্যুক্ত অবস্থাদৃষ্টে বলাই যায় যে, বিরাট স্থূলকায় মেয়ে আপনার পছন্দ হতেই পারে। তবে জাতিসুদ্ধ সকলের ভেতর ব্যাপারটি বদ্ধমূল হয়ে যাওয়াটা তো অবশ্যই বিশেষ কিছু! মোটা মেয়ের চড়া দাম আর তাদের মোটাতাজাকরণ কেন্দ্রে পাঠিয়ে, জোর করে খাইয়ে বৃহদাকায় বানাবার এই পুরো প্রথার নাম লেবলাউহ। শুধু মৌরিতানিয়া নয়, লেবলাউহ বরং প্রচলিত উত্তর সাহারার বেশ কয়েকটি স্থানেই। ইউরিয়া-ভূষি খাইয়ে গবাদিপশুর গায়ে বাড়তি মাংস চড়িয়ে বাজারদর বাড়ানোর তরিকার সাথে লেবলাউহ’র তাত্ত্বিক পার্থক্য কমই! মোটা মেয়েকে ধরা হয় সৌন্দর্য-আভিজাত্যের প্রতীক, যা তার নিজ পরিবার ও শ্বশুরপক্ষের জন্য সম্মানের; অন্যদিকে ক্ষীণকায় মেয়েরা দারিদ্র্য-ক্লীষ্টতা ও অপকর্ষের প্রতীক!
কেন এবং কীভাবে?
এই প্রথায় মনে করা হয় মেয়ের শরীর যত বড় হবে, অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে সে যতটুকু জায়গা দখল করবে, সে তার স্বামীর মনের মধ্যেও ততখানি বিশাল জায়গা জুড়ে আসীন হতে পারবে। এতে করে স্বামীর মনে অন্য কারো জায়গা পাবার সম্ভাবনাও কমে আসবে ব্যস্তানুপাতিক হারে! প্রাচীন হিন্দু সমাজে কন্যাশিশু বিয়ে দেওয়ার তিনটি বয়স ছিলো- ৮ (গৌরী), ৯ (রোহিণী) ও ১০ (কন্যকা)। তেমনি মৌরিতানিয়ান মেয়েদের মোটাতাজাকরণ কেন্দ্রে পাঠানোরও বয়সও তিনটি- ৫, ৭ ও ৯! প্রাত্যহিক দুই কিলো জোয়ারের (শস্য) মিলেট, দুই পেয়ালা ভরা মাখন, ২০ কেজি উটের দুধ আর কয়েকশ খেজুর খাওয়ানো হয় তাদের। আরেকটু বড় হলে পদে যুক্ত হয় জলপাইয়ের তেলে সিক্ত যবের রুটি, পাঁঠা/ভেড়ার মাংস আর ডুমুর। এভাবে করে দিনে প্রায় ১৬,০০০ ক্যালরি, যেখানে গড়পরতা কন্যাশিশুর দৈনিক চাহিদা মাত্র ১,৫০০ থেকে ২,০০০ ক্যালরি!
মোটাতাজাকরণ কেন্দ্রের অন্দরকথা!
এসব কেন্দ্রে মেয়েদের পাঠানো হয় সাধারণত স্কুলগুলোতে বড় কোনো বন্ধ দিলে অথবা বর্ষাকাল এলে, যখন দুধের প্রাচুর্য থাকে। তবে স্বাভাবিকভাবে বয়স কম হওয়ায় এখানকার মেয়েরা নিজেরাও জানে না যে, তারা কেন এখানে এসেছে! তারা কেবল এটিই শিখে এসেছে যে, এই মোটা হওয়াই তাদের সুখী করবে ভবিষ্যতে। তবে একটা শিশুর পক্ষে কি এতখানি খাবার স্বাভাবিক অবস্থায় নেওয়া সম্ভব বলে মনে হয় আপনার? কখনোই না। সুতরাং বল প্রয়োগের নীতিই তো ভরসা! বেতের ভয় দেখিয়ে খাওয়ানো হয় কেন্দ্রের মেয়ে শিশুদের। তবুও খেতে অস্বীকৃতি জানালে দেওয়া হয় ‘জায়ার’ নামের শাস্তি, যেখানে দুটো বেত পায়ের পাতার দু’পাশে রেখে চাপ দেওয়া হয়!
আর যদি কেউ খেয়ে বমি করে ফেলে, তবে তাকে জোর করা হয় সেই বমিই খেতে! ভয়ে তখন বমিটাও বন্ধ করতে হয় তাদের। আর এভাবেই ১২ বছরের মেয়ের ওজন ছাড়ায় ৮০ কিলো আর ১৫ বছর বয়সীকে চোখের দেখায় মনে হয় ৩০! সম্প্রতি অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, কৃত্রিম উপায়ে ক্ষতিকারক ইউরিয়া ও নানা হরমোন ব্যবহার করে মেয়েদের মোটা করা হচ্ছে কেন্দ্রগুলোতে, যার ফলে পাকস্থলী, মুখমণ্ডল, বক্ষদেশ ফাঁপা-স্ফীত হলেও বাহু, উরু বলিষ্ঠ হয় না! যা আদতে তাদের শুধু শারীরিকভাবে দুর্বলই বানায় না, বরং মেয়েদের সম্মুখীন করে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির।
প্রথার পেছনের কথা
লেবলাউহ প্রথার শুরুটা আসলে উপনিবেশিক যুগের আগেই। মৌরিতানিয়ার শ্বেত ম্যুর আরবদের বেশিরভাগই ছিলো যাযাবর। এই যাযাবরদের মধ্যে ধনী পুরুষেরা সারাদিন ঘরের বাইরে হাড়ভাঙা খাটতেন, স্ত্রীদের কোনো কাজই করতে দিতেন না, তাদের সমস্ত কাজ করে দিত কৃষ্ণাঙ্গ দাসী-বাঁদিরা। এভাবেই আরাম-আয়েশ করতে গিয়ে বেশ স্থূলকায় হয়ে যেতেন স্ত্রীরা। তখন থেকেই স্থূলতা হলো ভালো স্বামীর ফলাফল, সৌন্দর্য আর আভিজাত্যের প্রতীক! মেয়েদের স্থূলদেহের ঝোলা চামড়াকে মৌরিতানিয়ানরা বলে ‘তেবতাহ’, যাকে ভাবা হয় নারীদেহের অলঙ্কার! সেই সঙ্গে কোমরের চারপাশের চর্বিকে বলা হয় ‘লেখওয়াসার’, কবিতা-গানে যার শত গুণকীর্তন করেন মৌরিতানিয়ানরা!
লেবলাউহর যৌবনে ভাটা
সময় বদলের সাথে চিন্তা-ভাবনাতেও আসছে বদল। বিশ্বায়নের যুগে পাশ্চাত্যের ক্রমপ্রভাবে লেবলাউহ হারাচ্ছে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি। মেয়েরা চাইছে হলিউড নায়িকা বা লেবানীজ পপস্টারদের মতো ছিপছিপে গড়ন পেতে, মোটাতাজাকরণ কেন্দ্রের বদলে শহুরে মেয়েদের তাই ভিড় বাড়ছে সাইক্লিং ক্লাবে, জিমে বা সুইমিং পুলে। অভিভাবকরা একটু গাঁইগুই করলেও যুগের প্রয়োজন মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন তারাও। আর ছেলেদের কী পছন্দ? ‘ফোর্স-ফিডিং’ বিরোধী ক্যাম্পেইন নিয়ে কাজ করা নারী অধিকার কর্মী মিন্ট এলি জানালেন, মৌরিতানিয়ান ছেলেরা এখনো কিছুটা গোলগাল মেয়ে পছন্দ করলেও আগের মতো অতটা থলথলে-মেদবহুল পছন্দ করে না! তার মতে, পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলেছে। বাল্যবিবাহ ও নারীস্বাস্থ্যর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত হওয়ায় অনেকেই এখন এই অপপ্রথার বিষয়টির গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন, বিরুদ্ধ প্রচারণা চালাচ্ছেন।
সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা সামাজিক সচেতনতা কার্যক্রমের দরুন শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে এই প্রথা আজকাল হারাতে বসেছে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বর্তমানে ১১% মেয়েকে এই প্রথার মধ্য দিয়ে যেতে হয়! তবে গ্রামাঞ্চলে বা মফস্বলে এর প্রভাব এখনো হারায়নি। যেসব জায়গায় লেবলাউহর প্রভাব নেই বলে হয়তো আপনি ভাবছেন, খোঁজ করে দেখুন, সেখানে আজও মা তার শিশু মেয়েটিকে এমন এক রূপকথার গল্প শোনায় যেখানে এক মরুদ্যান আছে, মিষ্টি সুস্বাদু সব খাবার আছে এবং যেখানে একবার যেতে পারলে তার আদুরে কন্যা ফিরবে অনিন্দ্য সুন্দরী হয়ে!
ফিচার ইমেজ: marieclaire.com