বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান এবং সম্মানজনক পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত হয় নোবেল পুরস্কার। প্রতি বছর ৬টি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। তবে এর মধ্যে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত, সমালোচিত এবং বিতর্কিত।
নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তন করেন সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল। ১৮৯৬ সালে তার মৃত্যুর পূর্বে ডিনামাইটের আবিস্কারক এই বিজ্ঞানী তার সমুদয় অর্থ দান করে যান একটি পুরস্কারের জন্য। প্রতি বছর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাক্ষেত্র, সাহিত্য, শান্তি এবং অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রাখা ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। তবে অন্য পুরস্কারগুলোর সাথে শান্তি পুরস্কারের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু পার্থক্য আছে।
মনোনয়ন পাওয়ার প্রক্রিয়া
নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়াটা একটু কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু এর জন্য মনোনয়ন পাওয়াটা আসলে খুবই সহজ। এতই সহজ যে, আপনিও একটু চেষ্টা করলেই মনোনয়ন পেয়ে পেতে পারেন। মনোনয়ন পাওয়ার জন্য শুধু নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির কাছে একটি চিঠি অথবা ইমেইল পাঠিয়ে সুপারিশ করাই যথেষ্ট।
এ সুপারিশ হয়তো আপনি নিজে করতে পারবেন না, কিন্তু যারা সুপারিশ করার যোগ্য, তাদের কাউকে না কাউকে আপনি সহজেই আপনার আশেপাশে পেয়ে যেতে পারেন। যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারেন প্রাক্তন নোবেল বিজয়ী কোনো ব্যক্তি। সেক্ষেত্রে আপনার সাথে যদি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূস অথবা গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের কারো সাথে ভালো পরিচয় থাকে, তাহলে আপনি তাদেরকে অনুরোধ পারেন আপনার ব্যাপারে সুপারিশ করার জন্য।
তারা রাজি না হলেও নিরাশ হওয়ার কিছু নেই, আপনার ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারবেন জাতীয় সংসদের যেকোনো সদস্য, সরকারের মন্ত্রীসভার যেকোনো সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরগণ, কিছু কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের অধ্যাপকগণ এবং বৈদেশিক নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠানের পরিচালকগণ। আশা করা যায়, আপনি এদের মধ্যে কাউকে রাজি করিয়ে ফেলতে পারবেন!
আপনার জন্য সুপারিশ করতে হলে তাকে শুধু বছরের ১লা ফেব্রুয়ারির আগেই নোবেল কমিটির কাছে একটি চিঠি অথবা ইমেইল পাঠাতে হবে এবং ব্যাখ্যা করতে হবে, তিনি কেন আপনাকে শান্তিতে নোবেল পাওয়ার জন্য উপযুক্ত মনে করেন। ব্যাস, কাজ শেষ। ইন্টারনেটে অনেক ওয়েবসাইটের সদস্য হওয়ার জন্যও এর চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়।
তবে কেউ সুপারিশ করলেই যে আপনি পুরস্কার পেয়ে যাবেন, এমনটা নয়। পুরস্কার পাওয়ার জন্য আপনাকে নোবেল কমিটির বিশেষ প্যানেলের মন জয় করতে হবে। অতীতে কোন কোন ধরনের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের মধ্যে কী কী বৈশিষ্ট্য ছিল, সেগুলো বিশ্লেষণ করে ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা একটি গাইডলাইন তৈরি করেছে, যা অনুসরণ করলে হয়তো আপনার ভাগ্যেও জুটে যেতে পারে এই পুরস্কারটি! চলুন দেখে নেওয়া যাক শান্তির অগ্রদূত হওয়ার শর্তগুলো কী কী।
১. আপনি পুরুষ হলে আপনার সম্ভাবনা বেশি
নারীদের শান্তিতে নোবেল অর্জনের পথে কোনো বাধা নেই, কিন্তু ইতিহাস থেকে দেখা যায়, নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। আলফ্রেড নোবেল যখন পুরস্কারটি প্রবর্তনের পরিকল্পনা করছিলেন, তখন বার্থা ভন সাটনার নামে এক নারী শান্তি আন্দোলনকর্মী সর্বপ্রথম তাকে পুরস্কারের ক্ষেত্র হিসেবে ‘শান্তি’কে অন্তুর্ভুক্ত করার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯০৫ সালে ভন সাটনার নিজে পুরস্কারটি পেলেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত এক্ষেত্রে নারীরা ভীষণ অবহেলিত ছিল। ১৯০১ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত মাত্র ৫ জন নারী শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য নারীদের পুরস্কার পাওয়ার হার কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু তারপরও পুরুষদের তুলনায় এ সংখ্যা অনেক কম। বর্তমানে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী পুরুষের সংখ্যা যেখানে ৮৭, সেখানে নারীদের সংখ্যা মাত্র ১৬। অর্থাৎ আপনি যদি পুরুষ হন, তাহলে আপনার নোবেল জয়ের সম্ভাবনা একজন নারীর তুলনায় ৫ গুণের চেয়েও বেশি। নারীদের চেয়ে যেকোনো প্রতিষ্ঠানেরও বরং পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এখন পর্যন্ত মোট ২২টি প্রতিষ্ঠান এ পুরস্কার পেয়েছে।
২. ধর্ম এবং মানবতার সেবায় জীবনকে উৎসর্গ করুন
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তদের একটি বড় অংশ ধর্ম এবং মানবতার সেবায় সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন। এদের মধ্যে ডেসমন্ড টুটু, দালাই লামা সহ আরো ক’জন ধর্মযাজক যেমন আছেন, তেমনি আছেন মাদার তেরেসা। বাংলাদেশের ড. মোহাম্মদ ইউনূস মূলত দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যই শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অন্য পদ্ধতিগুলোর চেয়ে এ পদ্ধতি বরং অনেক বেশি কষ্টকর। মাদার তেরেসা সারা জীবন কলতাকার গরীব-দুঃখীদের মধ্যে কাটিয়েছেন, ডেসমন্ড টুটু এবং বিশপ জিমেনেস বেলো হত্যার হুমকি পেয়েছেন। আবার মালালা ইউসুফজাই খুব বেশি কিছু না করলেও, তালেবানদের হাতে গুলি খাওয়ার কারণে নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন।
কাজেই আপনি যদি ধর্মের শান্তির বার্তা প্রচার করেন, নিপীড়িত, অত্যাচারিত, গরীব-দুঃখী মানুষদের সাহায্যে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, তাহলে হয়তো আপনার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।
৩. মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেষ্টা করুন
ধর্মীয় নেতাদের পরেই শান্তিতে সবচেয়ে বেশি নোবেল পাওয়া পেশার মানুষ হচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টগণ। ১৯০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২১ জন প্রেসিডেন্টের মধ্যে ৪ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯০৬ সালে থিওডোর রুজভেল্ট পেয়েছিলেন রাশিয়া-জাপান যুদ্ধ বন্ধ করার উদ্যোগের কারণে, ১৯১৯ সালে উড্রো উইলসন পেয়েছিলেন লিগ অফ নেশনস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কারণে, ২০০২ সালে জিমি কার্টার পেয়েছিলেন বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচারণা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর কল্যাণে কাজ করার জন্য। সর্বশেষ ২০০৯ সালে বারাক ওবামাও নোবেল পেয়েছিলেন, কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো সংকট সমাধানের জন্য না।
শুধু প্রেসিডেন্ট না, আমেরিকার দুজন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীও নোবেল পেয়েছিলেন। কাজেই আপনি যদি একান্তই নোবেল পেতে ইচ্ছুক হন, তাহলে আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলেও হতে পারে!
৪. প্রেসিডেন্ট হতে না পারলেও অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হোন
এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর সংখ্যা খুবই কম। সে তুলনায় ইউরোপ এবং আমেরিকাতে জন্মগ্রহণকারীদের সংখ্যা অনেক বেশি। ৯ জন নোবেল বিজয়ীর জন্ম ফ্রান্সে, ১১ জনের জন্ম যুক্তরাজ্যে, আর সবচেয়ে বেশি ১৭ জনের জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কাজেই আপনার জন্ম যদি যুক্তরাষ্ট্রে হয়ে থাকে, তাহলে তো খুবই ভালো। আর না হলেও এখনই যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বসবাস শুরু করে দিতে পারেন।
৫. প্রতিষ্ঠান স্থাপন করুন
নোবেল শান্তি পুরস্কার ব্যক্তির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানও পেতে পারে। এখন পর্যন্ত মোট ২২টি প্রতিষ্ঠান এ পুরস্কার পেয়েছে, যাদের মধ্যে আছে দু’বার পুরস্কার পাওয়া জাতিসংঘের শরণার্থীদের জন্য সংগঠন UNHCR এবং তিনবার পুরস্কার পাওয়া আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ICRC। ২০০৬ সালে ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সাথে তার প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকও এ পুরস্কার অর্জন করে। কাজেই, আপনি ব্যক্তিগতভাবে কিছু করতে না পারলেও সারা বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষকে সহায়তার জন্য কোনো সহায়তাকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে পারেন। নোবেল যদি না-ও পান, একটা ভালো কাজ তো করা হবে!
৬. ধৈর্যশীল হন
আপনি অনেক কিছু করার পরেও যদি শান্তি পুরস্কার না পান, অধৈর্য হবেন না। অপেক্ষা করতে থাকুন এবং আপনার সৎকাজ চালিয়ে যেতে থাকুন। যদিও মালালা ইউসুফজাই মাত্র ১৭ বছরেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, কিন্তু সবাই এরকম সৌভাগ্যবান হয় না। নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার গড় বয়স হচ্ছে ৬১ বছর। অধিকাংশ মানুষই তাদের জীবনের শেষভাগে এসে এই পুরস্কার লাভ করেন।
৭. তারপরেও যদি না পান…
অনেক ভালো কাজ করার পরেও যদি আপনি নোবেল পুরস্কার না পান, হতাশ হবেন না। বরং আনন্দিত হন এই ভেবে যে, বিশ্বের অধিকাংশ যোগ্য ব্যক্তিই আসলে নোবেল পুরস্কার পাননি। তারা নোবেল পুরস্কারের আশাও করেন না, নীরবে-নিভৃতে মানবতার জন্য কাজ করে যান।
তাছাড়া নোবেল শান্তি পুরস্কারটা ভীষণ বিতর্কিত একটি পুরস্কার। এটি দিনে দিনে এতই বিতর্কিত হয়ে উঠছে যে, পুরস্কারটি পেলেই বরং মানুষ সন্দেহ করে বসতে পারে, আপনাকে কেন এই পুরস্কার দেওয়া হলো? এর পেছনে উদ্দেশ্য কী? আপনি কোনো আন্তর্জাতিক পরাশক্তির দালালি করছেন না তো? তাই আপনি বরং খুশি হতে পারেন এই ভেবে, যে পুরস্কারটি হেনরি কিসিঞ্জার, শিমন পেরেজ, আইজাক রবিন এবং অং সান সু চির মতো ব্যক্তিরা পেয়েছে, সেটি আপনার না পাওয়াই ভালো!
ফিচার ইমেজ- sciencemag.org