এক নতুন শাহজাহানের দ্বিতীয় তাজমহল তৈরির গল্প

“এক বিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল
এ তাজমহল।”

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ হয়তোবা আত্মোপলব্ধি থেকেই পঙক্তিগুলো লিখেছিলেন। কিন্তু ১৮ বছর বয়সী শাবানা নামের এক তরুণী বলছিলেন, ভালোবাসার অমর কীর্তিগুলো সম্পর্কে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বই-পুস্তক থেকে পড়ে জানতে পারি। আজকাল এক-আধটু ভালোবাসার গল্প লিখেই লেখকগণ ভেবে নেন যে তিনি একটা দারুণ কার্যসিদ্ধি করে ফেলেছেন। আসলেই কি ভালোবাসার স্বরূপ তাতে বোঝা যায়?

প্রেম স্রষ্টার এক অপার-অদ্ভুত সৃষ্টি। কখন তা আসে, কীভাবে কার জীবনে এসে দোলা দিয়ে যায় সেটা বলা যায় না। কেউ হয়তো তাকে পায় খুব গভীর ভাবে, কারো বা আঁচটুকু লেগেই ম্রিয়মাণ হয়ে ফিরে যায়, কে-ই বা রাখে তার খবর?

প্রেমের অমর নিদর্শন বলতেই প্রথমেই মনের কোণায় এসে নাড়া দেয় সেই স্মৃতির সৌধ যা প্রায় ৩৫০ বছর আগে সম্রাট শাহজাহান তৈরি করেছিলেন তার প্রিয়তম স্ত্রী বেগম মমতাজের প্রতি ভালোবাসার স্মৃতি রক্ষার্থে। সেই তাজমহল এখন শুধু ভারত বর্ষ নয়, গোটা পৃথিবীর কাছেই অতীব আশ্চর্যের একটি স্থান। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এটিকে।

সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল। ছবিসূত্র: New 7 Wonders of the World

সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের ইতিহাসই যে একমাত্র অমর ইতিহাস নয় তা প্রমাণ করে দিলেন ফয়জুল হাসান কাদরি নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার। স্ত্রীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তিনি রেখেছেন, গড়ে তুলেছেন তার স্বপ্নের তাজমহল। যদিও তা সম্রাট শাহজাহানের তৈরি তাজমহলের মতো রাজকীয় ঢঙ্গে গড়ে উঠেনি, তবুও এই মিনি তাজমহলের প্রতিটি গাঁথুনিতে কিন্তু ভালোবাসার কমতি নেই মোটেও। হ্যাঁ, এলাকাবাসীদের কাছে তা ‘মিনি তাজমহল’ নামেই পরিচিত।

ফয়জুল কাদরির মিনি তাজমহল। ছবিসূত্র: pointblank

ফয়জুল হাসান কাদরির জন্ম উত্তর প্রদেশের বুলন্দ শহরের কাসেরকেলা গ্রামে। স্ত্রী তাজামুল্লি বেগম। স্ত্রীকে পাগলের মতন ভালবাসতেন ফয়জুল। মাত্র ১৪ বছর বয়সে কাদরি বউ করে এনেছিলেন তাজামুল্লি বেগমকে। পড়াশুনা জানতেন না তাজামুল্লি। কাদরি তাকে উর্দু ভাষা শিক্ষা দেন, কিন্তু বেগম তার লিখতে পারতেন না। আচার ব্যবহারে তাজামুল্লি ছিলেন মিষ্টভাষিণী, সহজ-সরল ও অত্যন্ত মিষ্টি স্বভাবের। সকলেই তাকে খুব পছন্দ করতো। খুব সুখেই যাচ্ছিলো তাদের দাম্পত্য জীবন। শুধু দুঃখ কেবল একটাই। তারা ছিলেন নিঃসন্তান।

ফয়জুল হাসান কাদরি। ছবিসূত্র: dailymail.co

খুব বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি ফয়জুল কাদরি তার অতি প্রিয় সহধর্মিণীকে। প্রথমদিকে ডাক্তাররা তার রোগ নির্ণয় করতে পারেননি। পরবর্তীতে ফয়জুল তার বেগমকে আলীগড় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখান। তখন ধরা পড়ে থ্রোট ক্যান্সার। ক্যান্সার এমন অবস্থায় ছিল যে কেমোথেরাপি নেওয়ার মত শারীরিক অবস্থাও ছিলনা তাজামুল্লি বেগমের। অবশেষে মাত্র ৫৮ বছরের সংসার জীবনের ইতি টেনে ২০১১ সালে মারা যান তিনি।

মৃত্যুর সময়ে বিছানায় দুঃখ প্রকাশ তার স্বামী ফয়জুলকে করে বলেছিলেন, তাদের নাম বহন করার মতো কেউ নেই, নেই কোনো স্মৃতি। আর সেদিনই ফয়জুল ঠিক করে নিয়েছিলেন এমন কিছু একটা করবেন যা তার স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসাকে অমর করে রাখবে। মারা যাওয়ার পূর্বেই ফয়জুল কাদরি তার স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন, তাদের নিঃসন্তান প্রেমের দুঃখ ঘুচাতেই তৈরি করবেন এক তাজমহল। এ কোনো নবাবের বানানো নয়, নেহাত এক নিঃসন্তান সরকারি কর্মচারীর গভীর প্রেমের নিদর্শন মাত্র। এতে থাকবে না কোনো বাদশার সম্পদের জৌলুশের প্রচারের ছোঁয়া, এটি বয়ে বেড়াবে শুধু তাদের প্রেমের স্বাক্ষর।

ফয়জুল হাসান কাদরি ও তার স্ত্রী তাজামুল্লি বেগম। ছবিসূত্র:bangkokpost

ফয়জুল কাদরির বয়স এখন ৮০ বছর। স্ত্রী মারা যেতেই তিনি তার প্রতিশ্রুতি পূরণের কাজ শুরু করেন। আর্থিক টানাপোড়েন ছিল বটে তারপরও কারিগরদের সঙ্গে নিয়ে নিজে চলে যান আগ্রার তাজমহলে। সব দেখিয়ে আনেন তাদের। কিন্তু কারিগরদের কাজ তার পছন্দ হয়নি। তারপর নীল নকশা বানিয়ে নেন নিজের মতো করেই। তার গ্রামেই তৈরি করেন তাজমহলের ছোট একটা সংস্করণ।

ফয়জুল হাসান কাদরির তাজমহল। ছবিসূত্র: india.com

তিল তিল করে জমানো টাকা দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন এই স্মৃতিসৌধ। পেনশনের কিছু টাকাও এর পিছনে ঢেলে দিয়েছিলেন। প্রথমে তার জমি বিক্রি করে পান ৬ লাখ রুপি। সাথে তার স্ত্রীর সোনা ও রূপোর গয়না বিক্রি করে আরও জোগাড় করেন দেড় লাখ রুপি। তা দিয়েই কাজ শুরু করেন সমাধি সৌধের।

ঐ এলাকার আসগর নামের এক রাজমিস্ত্রি তাকে সাহায্য করেছিল কাজ শুরু করতে। আসগর কেন্দ্রস্থ সৌধের চতুর্দিকের চারটি মিনার ও গম্বুজ গড়ে দিয়েছিল যা ২৭ ফিট উচ্চতার চেয়ে সামান্য বেশি। কাদরি ২০১২ সাল থেকে নিজের হাতেই গড়ছেন এই মিনি তাজমহল। প্রতিদিন আট ঘণ্টার কাছাকাছি কাজ করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত মোট ১১ লক্ষ টাকা খরচ করেছেন তিনি। এখন বছরে প্রায় এক লক্ষ টাকার কাছাকাছি খরচ করেন ভালবাসার স্মৃতিসৌধের রক্ষণাবেক্ষণে।

স্ত্রীর স্মৃতিতে ফয়জুলের তাজমহল। ছবিসূত্র: hindustantimes

সৌধের চারপাশের বাগান আর মার্বেল পাথরের কাজ করতে খরচ হবে ৬-৭ লক্ষ রুপি। এছাড়াও তিনি সৌধের পেছনের দিকে একটি ঝর্ণাও তৈরির আশা রাখেন। ফয়জুল কাদরিকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন গ্রামের অনেকেই, কিন্তু তাদেরকে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। কারণ এ ব্যাপারে তিনি কারোর সাহায্য নিতে মোটেই রাজি নন৷

উত্তর প্রদেশের মূখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব ইতিমধ্যে এই স্মৃতি সৌধটি দেখে গিয়েছেন। তিনি ফয়জুল কাদরির মহান উদ্দেশ্যকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। যাদব জেলা প্রশাসক বিশাল সিং মারফত খবর পাঠিয়েছিলেন যে তিনি বাকি অসম্পূর্ণ কাজের জন্যে অনুদান দিতে ইচ্ছুক। কিন্তু কাদরি সেটাও গ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন এবং জানিয়ে দেন যে এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগেই তিনি সমাপ্ত করতে চান।

উত্তর প্রদেশের মূখ্যমন্ত্রী কর্তৃক ফইজুল হাসান কাদরিকে তার কাজের জন্য সম্বর্ধনা জ্ঞাপন। ছবিসূত্র: muslimissues

শুধু তাই হয়, ফয়জুল কাদরি শেষ শয্যার পর যাতে তাকে তার স্ত্রীর পাশেই কবর দেওয়া হয় সে উদ্দেশ্যেই তিনি তার স্ত্রীর কবরের পাশেই তার জন্যে জায়গা করে রেখেছেন। এমনকি ওয়াকফ বোর্ডের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও দিয়ে রেখেছেন তার ভাইকে।

স্ত্রীর পাশেই নিজের কবর যাতে হতে পারে সেজন্য ফয়জুল কাদরি নিজের কবরও তৈরি করেছেন। ছবিসূত্র: ndtv

জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এসবই তিনি সম্ভব করেছেন কেবল তার তীব্র ভালবাসার জোরে। বেঁচে থাকতে থাকতেই তিনি এই তাজমহলের সম্পূর্ণ রূপ দেখে যেতে চান। আপাতত সিমেন্ট বালি দিয়েই গাঁথা হচ্ছে এই মহল। ফইজুলের আশা, ভবিষ্যতে আরও আধুনিক করে ফেলবেন তার সাধের তাজমহলকে। ইতিমধ্যেই ‘মিনি তাজমহল’ দেখতে লোকজন এসে ভীড় জমাচ্ছেন। মুখে মুখে দিকে দিকে ছড়াচ্ছে ফইয়জুলের নাম ও সাথে তার স্ত্রীর নামটিও। এটাই তো চেয়েছিলেন ফয়জুলের স্ত্রী। সার্থক ফয়জুলের প্রেম, সার্থক তার মনের মতো করে তাজমহলের প্রতিষ্ঠা।

স্ত্রীর স্মৃতিফলক হাতে ফয়জুল হাসান কাদরি। ছবিসূত্র:pointblank7

আমাদের সমাজের প্রেমিক পুরুষেরা স্ত্রী বা গার্লফ্রেন্ডকে খুশি করতে ‘তোমার জন্য চাঁদ আনতে পারি’, ‘তোমার জন্য তাজমহল বানিয়ে দেব’ ইত্যাদি কত ভালো ভালো কথাই না চিরকাল বলে এসেছেন বলেই শোনা যায়। কিন্তু উত্তর প্রদেশের কাসেরকালান গ্রামের বাসিন্দা ফয়জুল হাসান কাদরি শুধু ‘প্রতিশ্রুতি’ দিয়েই ভুলে যাননি। স্ত্রীর প্রতি তার গভীর ভালোবাসা স্বরূপ সত্যি বানিয়ে দেখিয়েছেন ‘দ্বিতীয় তাজমহল’৷

তথ্যসূত্র

  • http://www.hindustantimes.com/india/this-retired-up-postmaster-built-a-taj-mahal-for-his-mumtaz/story-UfM3OzKHuphGgMiBtsglHM.html
  • http://www.bbc.com/news/world-asia-india-23339485
  • http://www.dnaindia.com/india/report-retired-uttar-pradesh-postmaster-builds-replica-of-taj-mahal-to-immortalise-love-for-wife-1833334

Related Articles

Exit mobile version