এক আজব প্রাণী মানুষ। কখনো সে পাহাড়ের সুউচ্চে খুঁজে পায় আপন ঠিকানা কখনো আবার সেই সুউচ্চে দড়ি বেঁধে তার উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে অবাক করে এই পৃথিবীকে। কখনো সে ছুটে যায় জনবিরল মেরুর বুকে শুভ্র প্রাণের সন্ধানে, আবার তারই বিচরণ জনাকীর্ণ বাজারের কলতানে মাঝে। তাকে পাওয়া যায় পরাবাস্তব অনুভূতির কেন্দ্রে পার্শ্বচরিত্রের বেশে। বংশগতির প্রবহমানতার নিমিত্তে করা যুদ্ধের সে দর্শক, আবার তাকেই পাওয়া যায় সেই জীবন যুদ্ধের নির্মম রঙ্গমঞ্চে। সে ক্ষণিকের চিত্রনাট্যের রচয়িতা আবার হাজার বছরের উপন্যাসের অভিনেতা। নানা রূপে, বিভিন্ন ঢঙে গল্প লিখে যাচ্ছে মানুষ। অন্যদিকে, পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন হাজারো-লাখো চলমান গল্পকে নিশ্চল ফ্রেমে বন্দী করে রাখেন কিছু ‘পাগলাটে’ ফটোগ্রাফার। গত জানুয়ারি মাসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের বাছাই করা এরকম নয়টি ছবি ও ক্যামেরার পিছনে থাকা সেসব কারিগরদের নিয়ে আজকের এই লেখা।
গিরিসকাশে
হিমালয় কন্যা নেপালের খুম্বুতে অবস্থিত আমা দাবলাম। প্রায় ২২ হাজার ফুট সুউচ্চ এই পর্বতকে বলা হয় Mother’s necklace; কারণ, দূর থেকে এই পর্বতটিকে দেখলে মনে হবে কোনো মা (আমা) দুই বাহু দিয়ে অতি আদরে আগলে রেখেছেন তার সন্তানকে। আর আনত হিমবাহ (দাবলাম) যেন তার সৌকর্যের কন্ঠহার। আমা দাবলাম জনপ্রিয়তার দিক থেকে হিমালয় পর্বতমালার তৃতীয় জনপ্রিয় গন্তব্য চূড়া। সাধারণত আমা দাবলামের পথে পর্বতারোহীগণ তিনটি বেস ক্যাম্প করেন। উপরের ছবিটি প্রায় ছয় হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত আমা দাবলামের ক্যাম্প-২। আমা দাবলাম থেকে নামার সময় ফটোগ্রাফার সাউলিয়াস এই ছবিটি তুলেছিলেন। মেঘমালার ‘ঝড়ে’ ঢেকে যাবার আগে হয়তো এমনই রহস্যে আবৃত থাকে আমা দাবলামের চারিপাশ।
দড়াবাজিকর
অনেক উঁচুতে দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়াতে অতিশয় পারদর্শী স্যামুয়েল ভলারি একজন বিশ্বরেকর্ডধারী দড়াবাজিকর। নাভাজিয়ো সৈকত গ্রিসের একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। সেখানেই ২১০ মিটার উঁচুতে দড়ি বেঁধে প্রায় আধ কিলোমিটার হেঁটে চমক দেখিয়েছেন স্যামুয়েল ভলারি। আর তার এই অসাধারণ কাজটিকে ক্যামেরায় ধারণ করেন অস্ট্রেলিয়ান ফটোগ্রাফার এইডেন উইলিয়াম।
আর্কটিকের ধূর্ত শৃগাল
উত্তরের বরফাচ্ছাদিত তুন্দ্রা বায়োম জুড়ে বসবাস অসাধারণ সুন্দর এই আর্কটিক শৃগালের। হাঁড়কাপানো ঠান্ডা আবহাওয়াতেও এরা দিব্যি ঘুরে বেড়ায় বিরান তুন্দ্রায়। সাধারণত এরা মেরু ভাল্লুকের রেখে যাওয়া খাবারের সন্ধান করে, যেমনটি এই চালাক শিয়ালটি করছিল। মেরু ভাল্লুকের ফেলে যাওয়া শিকার খুঁজতে গিয়ে তার এই ফিরে তাকানোর ধূর্ত চাউনি কানাডিয়ান ফটোগ্রাফার ফ্রেডের ক্যামেরায় ধরা পড়ে।
ব্যাংককের রাতের বাজার
থাইল্যান্ডের বিখ্যাত ট্রেন মার্কেট; যাকে থাইবাসীরা ডাকে Talad Nud Rod Fai নামে। এই মার্কেটগুলোর বিশেষত্ব হল, এগুলো বসে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইনের ধার ঘেঁষে। এই বাজার জমে ওঠে সন্ধ্যাকালে আর চলে রাত অবধি। থাইল্যান্ড ঘুরতে আসা পর্যটকমহলে খাদ্য ও শখের সামগ্রী কেনার জনপ্রিয় স্থান ব্যাংককের এই আলোকজ্জ্বল রাতের বাজার।
বেইজিংয়ের বজ্রপাত
২০১৭ সালের জুন-জুলাই। বেইজিংবাসী টানা কয়েক সপ্তাহের নিম্নচাপ আর গুমোট আবহাওয়ায় অস্থির হয়ে পড়েছিলো। গ্রীষ্মকাল যেন তার তাবৎ উষ্ণতা নিয়ে জেঁকে বসেছিল। তারপর শীতলতার আগমনীবার্তা নিয়ে এলো এই মেঘমালা; সাথে নিয়ে আসলো বজ্র-বিদ্যুতের আলোর ঝলকানি। রাতের বেইজিং হয়ে উঠলো আরো আলোকময়। ফটোগ্রাফার কিং হু দেরি করেননি। ঝটপট ক্যামেরা নিয়ে বের হয়ে যান আর তিন সেকেন্ডের লং এক্সপোজারে তুলে ফেলেন পরাবাস্তব এক অনুভূতি জাগ্রত করা এই অসাধারণ ছবিটি।
বংশগতির রক্তাক্ত লড়াই
পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম ইন্দোনেশিয়ার কমোডো দ্বীপ। আর এখানেই আবাস পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টিকটিকি কমোডো ড্রাগনের। নিজের উত্তরাধিকারী রেখে যাবার জন্য পুরুষ কমোডো ড্রাগনদের বেশ কঠিন এক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। স্ত্রী কমোডো ড্রাগনের সাথে মিলনের নিমিত্তে তারা নিজেরা লিপ্ত হয় এক ভয়ানক যুদ্ধে। জয়-পরাজয় নিষ্পত্তি না হবার আগ পর্যন্ত চলতে থাকে এই লড়াই। ফটোগ্রাফার ডেভিড সোমালির ছবিতে উঠে এসেছে এরকমই দুই পুরুষ কমোডো ড্রাগনের লড়াইয়ের ছবি।
মৃত্যু দেয়ালের চক্র
বাংলায় একে বলা হয় মৃত্যকূপ। হুম, এটি কারো কারো কাছে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে খেলা; আবার কেউবা এমনও আছে যার কাছে এই মৃত্যুকূপই জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার এক নির্মম মাধ্যম। বনবন করে ঘুরে ঘুরে অন্যকে বিনোদন দেওয়া এই মানুষেরা নিজেরা থাকে দারিদ্র্যকে আলিঙ্গন করে। তাদের অধিকাংশই এই বিপদজনক পেশায় আসে জীবিকার তাগিদে। প্রাণের মায়া তাদের কাছে পেটের ক্ষুধার সাপেক্ষে অতি নগণ্য। খেলাটি মোটর সাইকেলের পাশাপাশি চার চাকার মোটরগাড়ি দিয়েও দেখানো হয়। ফটোগ্রাফার সুদীপ্ত মল্লিকের এই ছবিটি ভারতের বিহারের রাজধানী ঐতিহাসিক পাটনার সোনেপুর মেলায় তোলা যেখানে তিনজন পেশাদার খেলোয়াড় তাদের মোটর সাইকেল নিয়ে একসাথে চক্কর দিয়ে যাচ্ছে কাঠের তৈরি মৃত্যুকূপে। নিচে অপেক্ষারত দুটি মোটরগাড়ি ও একটি মোটর সাইকেল; আর উপরে? শত শত উৎসুক চোখ (ছবিতে নেই)।
বরফের গুহামুখ
Mer de Glace– ফরাসী আলপ্সের এক নয়নাভিরাম হিমবাহ উপত্যকা। সাড়ে সাত কিলোমিটার লম্বা আর ২০০ মিটার গভীর এই হিমবাহ প্রকৃত অর্থেই যেন বরফের এক ‘বিশাল সমুদ্র’। দুঃসাহসী অভিযাত্রিকদের কাছে এই হিমবাহের গভীরতা এক চ্যালেঞ্জের প্রতিশব্দ। ফরাসী ফটোগ্রাফার ম্যাথিস ডুমার তোলা এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, Mer de Glace-এর হিমবাহে ক্ষণিকের জন্য তৈরি হওয়া এক বরফ গুহার দেয়াল বেয়ে উঠে যাচ্ছে এক অভিযাত্রী আর তার উলম্ব পথপানে তাকিয়ে আছে আরেক সহযাত্রী।
ভেলায় ভেসে আসে গোধূলি সন্ধ্যা
জাপান ও চীনে হাজার বছর ধরে চলে আসা মাছ ধরার এই অদ্ভুত পদ্ধতিটির নাম Cormorant fishing। Cormorant একধরনের পাখি যাদের দিয়ে মাছ শিকার করা হয়। জেলেরা এদের গলায় একধরনের ফাঁস পরিয়ে দেয়। এর ফলে Cormorant-এর নিঃশ্বাস বন্ধ হয় না ঠিকই, কিন্তু তাকে খুব অসৎ উপায়ে ধোঁকা দেওয়া হয়। পানির নিচে গিয়ে মাছ শিকার করে গলাধঃকরণ করার সময় গলার কাছে আটকে যায় শিকার। এই সুযোগে তার গলা থেকে মাছটি বের করে নিজের ঝুড়িতে তুলে রাখে ভেলায় লগি হাতে বসে থাকা জেলে। মাছটি রেখে আবার পানির নিচে পাঠানো হয় সোজা-সরল পাখিগুলোকে। ফটোগ্রাফার কস কারাথানাসিসের তোলা এই ছবিটি চীনের গুইলিনে অবস্থিত লি নদীর এক সন্ধ্যাবেলার। শরতের সেই গোধূলি বেলায় ভেলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো দুই জেলে আর তাদের প্রশিক্ষিত পোষা দুই Cormorant পাখি।
ফিচার ইমেজ: Edited by writer