ভারতের ‘মি টু’ আন্দোলন: ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস উঠছে ঠিকই, কিন্তু স্থায়িত্ব কতক্ষণ?

ভারত জুড়ে এখন ‘মি টু’ আন্দোলনের জোয়ার উঠেছে। সম্প্রতি অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত বর্ষীয়ান অভিনেতা নানা পাটেকরকে যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত করার পরে চলচ্চিত্র তো বটেই, মিডিয়া জগতেরও অনেক নারীই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। এই দুই গণমাধ্যমেই ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এই আন্দোলন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, অনেকে তনুশ্রীর অভিযোগকে ‘দশ বছরের পুরোনো অতএব অর্থহীন’, এই বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও তার অভিযোগ ধৈর্য ধরে শুনছেন, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। ইতিবাচক দিক এটাই।

ইদানিংকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘মি টু’ আন্দোলন বেশ বড় ধরনের সাড়া ফেলেছে। সেদেশের শক্তিশালী চিত্র পরিচালক হার্ভে ওয়েইনস্টাইনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে মুখ খুলেছেন প্রখ্যাত সব শিল্পী। কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মচারীদের সঙ্গে অভব্য ব্যবহারের জন্যে নাইকির মতো বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডের রাঘব-বোয়ালদের বিদায় ঘটেছে এই বছরের গোড়ার দিকে। এমনকি সেদেশের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প বা তার পছন্দের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ব্রেট ক্যাভানওর বিরুদ্ধে নারীদের বিরুদ্ধে যৌন-সংক্রান্ত অভব্যতার আঙ্গুল উঠেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো শাস্তি হয়তো এখনও হয়নি, কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে ‘মি টু’ আন্দোলন এক বড় প্রভাব অবশ্যই ফেলেছে মার্কিন মুলুকে।

অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত দরজার আগল খুলে দিয়েছেন

ভারতে এই মুহূর্তে এই আন্দোলনের দানা বাঁধার একটি সম্ভাবনা তৈরি করেছে তনুশ্রীর অভিযোগ। তার মতো যৌন হয়রানির অভিযোগ হয়তো এর আগে অনেকেই করেছে কিন্তু তনুশ্রীর অভিযোগের মধ্যে অনেকে একটি বিশেষ সাহসী পদক্ষেপ দেখতে পেয়েছেন। এক তো বলিউডে সেভাবে নামীদামী কেউ না হয়েও, ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দেওয়ার এক দশক পরেও তিনি মুখ খুলেছেন এবং খুলেছেন এমন একজন নামী, প্রভাবশালী অভিনেতার বিরুদ্ধে যিনি বলিউডের পাশাপাশি মারাঠি চলচ্চিত্রেও একজন গণ্যমাণ্য ব্যক্তিত্ব।

২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জম্মুতে সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে প্রখ্যাত ভারতীয় অভিনেতা নানা পাটেকর; Source: Twitter handle of Nana Patekar @nanagpatekar

পাটেকরকে অভিযুক্ত করা মানে একটি আস্ত সামাজিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে খেপিয়ে দেওয়া আর তা তনুশ্রী করেছেন নির্ভিকভাবেই। একমনকি বছর দশেক আগে ঘটে যাওয়া তার ও তার পরিবারের উপর আক্রমণের পরেও। তনুশ্রীর এই পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যের এক নিদারুণ অবস্থান। আজকের ভারতে এই অবস্থানকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। তার ভিত্তি দশ বছরের পুরোনো ঘটনার উপরে হলেও।

তনুশ্রীর দেখাদেখি এখন অনেকেই নিজের অতীতের নানা অভিজ্ঞতার কথা তুলে আনছেন। গত কয়েকদিনে দেখা গেছে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমের দুনিয়ার সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীব্রতা। এমনকি অভিযোগের আঁচ পড়েছে স্বনামধন্য সাংবাদিক এবং বর্তমানে ভারত সরকারের বিদেশমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী এম জে আকবরের গায়েও। অর্থাৎ, আজ আর চুপ থাকতে রাজি নয় কেউই। গণতন্ত্রের এটিও একটি বড় গুণ। তা মানুষকে নির্ভীক হতে শেখায়।

এই আন্দোলনের প্রয়োজন নিঃসন্দেহে যথেষ্ট; কিন্তু স্থায়িত্ব?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে: এই ‘মি টু’ আন্দোলনের স্থায়িত্ব ভারতে কি বেশিদিন থাকবে? একথা ঠিক যে যারা এখন মুখ খুলছেন তারা তা করে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দেখাচ্ছেন। কিন্তু যদি আদৌ কোনো আইনি পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত তুলে তাদের আটকানো হয় শিগগিরই, তাহলে এই আন্দোলনের ঢেউ মিইয়েও যাবে একদিন। মাঝেমধ্যে একটা-দুটো কাহিনী শোনা যাবে ঠিকই, কিন্তু তা শুধুমাত্র আমজনতার ‘কনজাম্পশন’-এর স্তরেই থেকে যাবে। ‘মি টু’ আন্দোলনের প্রকৃত সাফল্য তখনই আসবে, যখন প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে এর প্রতিকার করা হবে।

কিন্তু সেই প্রতিকারের বাস্তবায়নের পথটি কতটা মসৃণ?

আন্দোলনে শামিল হচ্ছেন অনেকেই; Image Source: AP Photo/Altaf Qadri

গা বাঁচিয়ে চলার প্রবণতা যথেষ্ট চোখে পড়ছে

প্রথমত, পশ্চিমে আমরা যেভাবে ‘মি টু’ আন্দোলনকে দানা বাঁধতে দেখেছি, সেটা ভারতে কি আদৌ সম্ভব? এখানে একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন অবশ্যই রয়েছে। হলিউডে ওয়েইনস্টাইনের বিরুদ্ধে একের পর এক নামকরা চলচ্চিত্র শিল্পী এগিয়ে আসেন সমস্ত ইন্ডাস্ট্রির ভালোর কথা ভেবে। কিন্তু এখানে আমরা এখনও দেখছি অনেকেই আছে যারা হয় নিজেদের পিঠ বাঁচাচ্ছেন আর নাহয় এর বা ওর পক্ষ নিয়ে অপরজনকে তীব্র আক্রমণ করছেন। এই দু’টির কোনোটিই ঠিক অবস্থান নয়। কে দোষী, কে নয় তা ঠিক করা আইন-আদালতের কাজ। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির সহকর্মী হিসেবে অন্যান্যদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন যারা আজ সাহস করে নিজেদের কথা বলছেন, তাদের কথা যত্ন নিয়ে শোনা। এব্যাপারে অনেক তরুণ শিল্পীকেই দেখা যাচ্ছে যথেষ্ট গভীরে গিয়ে নিজেদের মতামত জানাচ্ছেন। কিন্তু অন্যদিকে, অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীকেই দেখা যাচ্ছে, হয় ব্যাপারটি এড়িয়ে যাচ্ছেন বা মুখ বন্ধ করে রয়েছেন। অনেকে আবার অভিযোগকারীকেই তীব্র আক্রমণ করে বসছেন। যদি ইন্ডাস্ট্রির অভিজ্ঞ এবং বর্ষীয়ান সদস্যরাই এমন দায়সারা মনোভাব নেন, তবে হলিউডের মতো বলিউডে ‘মি টু’ আন্দোলনের সাফল্যের সম্ভাবনা যথেষ্ট কম।

ভারতের বিদেশমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী এম জে আকবর; প্রখ্যাত এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও উঠেছে যৌন হয়রানির অভিযোগ; Source: Twitter @NeelamSancheti

লিঙ্গবৈষম্যের চেয়েও বড় হচ্ছে ক্ষমতার সমীকরণ

দ্বিতীয়ত, আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই হয়রানির সমস্যাটি যতটা না লিঙ্গবৈষম্য সংক্রান্ত, তার অনেকটাই বেশি ক্ষমতা সংক্রান্ত। যৌন হয়রানির খবরের সঙ্গে আমরা নিমেষে যুক্ত করে ফেলি কোনো নারীকে, কিন্তু এই ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় অনেক পুরুষকেও। আর এক্ষেত্রে যারা হয়রানি করছে, তাদের দুষ্কর্মের প্রধান কারণটি হয় যে তারা বেশি শক্তিশালী। কমবয়সী ছেলে-মেয়েকে তারা হয়রান বা উত্যক্ত বা প্রকাশ্যে গালিগালাজ করতেও পিছপা হয় না, কারণ তারা জানে, এদের চাকরির সুতোটি তাদের হাতে বাঁধা। আর তাই এক ধরনের ব্ল্যাকমেইলিং-এর কৌশল নিয়ে মানসিক নিপীড়নে তাদের বিন্দুমাত্র বাধে না। আমরা যখন ‘মি টু’ আন্দোলন নিয়ে ভাবছি, তখন আমাদের চিন্তাভাবনার অভিমুখ যেন শুধু একজন মেয়ে বা নারীর উপরে যৌন নিপীড়নের দিকেই না থাকে। তাতে অনেকের অন্যান্য নানা রকম হয়রানির কথা অন্তরালেই থেকে যাবে। ‘মি টু’ আন্দোলনের শরিক যে পুরুষরাও হতে পারে, সেটাও আমাদের বোঝা জরুরি।

অমিতাভ বচ্চন; তনুশ্রী দত্ত-নানা পাটেকর বিতর্ক নিয়ে তাকে সম্প্রতি প্রশ্ন করা হলে তা এড়িয়ে যান বর্ষীয়ান এই অভিনেতা; Source: Twitter @RashmiS65909910

গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যক্তির অধিকারের জয় কতটা সুনিশ্চিত?

তৃতীয়ত, আমাদের সমাজে এখনও গোষ্ঠীর জয়জয়কার। তা রাজনৈতিক অর্থে হোক বা সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের নিরিখে, এক ধরনের গোষ্ঠীবোধ আমাদের মধ্যে প্রখর। আর সেই কারণে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রে আমরা এখনও সেভাবে বিশ্বাসী হতে শিখিনি। তনুশ্রী দত্তের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি চোখে পড়ার মতো। তনুশ্রী বলিউডের তরফ থেকে যেরকম সাড়া পেলেন, তাতে এটা পরিষ্কার যে, তার ব্যক্তিগত অবস্থানকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে রাজি নন অনেকেই। হয়তো তিনি যদি সে অর্থে কোনো কেউকেটা হতেন, তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো কিন্তু যেহেতু তিনি তা নন, বলতে গেলে ইন্ডাস্ট্রিতে একজন ‘বহিরাগত’ই, তাই তার ব্যক্তিসত্ত্বাকে যেন একটু হেয় করেই দেখা হল। বিরাট নামযশ না থাকলেও যে একজন মানুষের মানসম্মান কোনোভাবেই ছোট নয়, সেই উপলব্ধিটি বোধহয় এই ঘটনাটিতে বলিউডের বেশিরভাগ সদস্যদেরই আসেনি। আর এটাই ভারতের ‘মি টু’ আন্দোলনের সাফল্যের পথে এক বড় অন্তরায়। অব্জেক্টিভিটি বা ন্যায়চিন্তার অভাব।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই হয়রানির সমস্যাটি যতটা না লিঙ্গবৈষম্য সংক্রান্ত, তার অনেকটাই বেশি ক্ষমতা সংক্রান্ত; Image Source: Adage India

ভারতের এই সামাজিক আন্দোলন কোনদিকে যাবে তা সময়ই বলবে, কিন্তু নিদেনপক্ষে যে এর সূচনা ঘটেছে দুনিয়ার সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে, সেটাই বড় কথা। প্রত্যেক আন্দোলনই চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চলে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে, ‘মি টু’ও যাবে। শঙ্কা একটাই: আন্দোলনের কাণ্ডারিরা যেন মাঝপথে রণে ভঙ্গ না দেন।

Featured Image Source: PUNIT PARANJPE/AFP/GETTY IMAGES

Related Articles

Exit mobile version