৬৫ বছরের বেশি সময় হতে চলেছে। সেই ১৯৫৩ সালে উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যকার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান হলেও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলে এসেছে পুরোটা সময় ধরেই। এই দীর্ঘ সময়ে মিত্র দেশগুলোর তরফ থেকে ঠিক যেমন শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে বহুবার, ঠিক তেমনি নানা প্রতিকূলতার কারণে সেসব উদ্যোগও নস্যাৎ হয়েছে ততবার।
উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি তাদের ‘পরমাণু কর্মসূচি’ থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিলে কোরিয়া উপদ্বীপ অঞ্চলে পুনরায় শান্তি স্থাপনের বেশ বড় একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। শুধু দুই কোরিয়ার পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি নয়, এমনকি কখনো আলোর মুখ না দেখা উত্তর কোরিয়া-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি সফল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়েও সাম্প্রতিক সময়ে ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কোরিয়া উপদ্বীপ অঞ্চলে এই শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়ার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়েই আজকের আয়োজন।
বিরোধের পটভূমি
১৯৫০ সালে, পটভূমি কোরীয় যুদ্ধ। সোভিয়েত রাশিয়ার সহযোগিতায় কোরিয়ার উত্তর অংশ দক্ষিণ অংশে আক্রমণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন সাম্যবাদ প্রতিহত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। স্বভাবতই তারা জাতিসংঘের নেতৃত্ব প্রদানকারী দেশ হিসেবে দক্ষিণের পক্ষে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে, উত্তরকে সাহায্য করার জন্য চীন অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের স্বেচ্ছাসেবী সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
প্রায় তিন বছর ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে তিন পক্ষের মধ্যে (জাতিসংঘ, উত্তর অংশের সেনাবাহিনী এবং চীন) একটি ‘যুদ্ধবিরতি চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অসম্মতি জানায়। এই যুদ্ধবিরতির মূল ভাষ্য ছিল-
দুই কোরিয়ার মধ্যে কোনোরূপ শান্তি সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত দুই পক্ষ থেকে কোনোরূপ সামরিক শক্তি এবং শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব প্রদর্শন থেকে বিরত থাকা।
এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি থেকে দুই কোরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রায় ২ কিলোমিটারের একটি ‘কর্তৃত্ববিহীন বেসামরিক অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখনকার শান্তিপ্রচেষ্টা তেমন কোনো কাজে আসেনি। দুই দেশের মধ্যে তৎকালীন সামরিক যুদ্ধের অবসান হলেও ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ বস্তুতপক্ষে এখনো চলছে। একদিকে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার সাথে কোনোরকম কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি, ঠিক তেমনি উত্তর কোরিয়াও সেই সময় থেকে দক্ষিণ কোরিয়াকে একটি ‘স্বাধীন, সার্বভৌম এবং স্বতন্ত্র দেশ’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করতে অস্বীকার করে।
বিভিন্ন সময়ের অস্থিতিশীলতা
সেই ‘৫০ এর দশক থেকে এই দুই দেশের মধ্যে বৈরি সম্পর্ক বিদ্যমান। বিভিন্ন সময়ে এই সম্পর্কে নানা উত্তেজনা এবং টানাপোড়ন সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৬ সালে দুই দেশের মধ্যকার বেসামরিক অঞ্চলটিতে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের হাতে দুই মার্কিন সৈন্য নিহতের ঘটনা কিংবা ২০১০ সালের দক্ষিণ কোরিয়ার নৌযান ডুবির ঘটনার জেরে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরিয়ার পারস্পরিক সম্পর্ক সেই ’৫০ এর দশক থেকেই বেশ বৈরিভাবাপন্ন। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার ‘পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচী’ নিয়ে এই দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘ সময়ের শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব কাজ করে এসেছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ের বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি, যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে জাতিসংঘের তরফ থেকে উত্তর কোরিয়ায় যেকোনো ধরনের তহবিল প্রদান বন্ধ ঘোষণাসহ নানা ঘটনা প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে অতীতে বার বার বলা হয়েছে-
উত্তর কোরিয়া তাদের পারমাণবিক কর্মসূচী বাদ না দিলে কোনো ধরনের আলোচনা কর্মসূচী একদমই সম্ভব নয়।
আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন তার দেশের পরমাণু কর্মসূচী রহিতকরণের বিষয়ে ইতিবাচক ইংগিত প্রদান করেছেন।
শান্তি প্রচেষ্টার প্রাথমিক ধাপ
কোরীয় উপদ্বীপ অঞ্চলে অশান্তির মূল কারণ হিসেবে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনের ‘পরমাণু কর্মসূচি’ প্রত্যাহার না করাকে দায়ী করা হচ্ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিম উত্তর কোরিয়ার সকল ধরনের পরমাণু কর্মসূচী রহিতকরণের বিষয়ে ইতিবাচক ইংগিত প্রদান করলে বস্তুতপক্ষে এই অঞ্চলের যাবতীয় অশান্তির একটি স্থায়ী সমাধানের পথ উন্মোচিত হয়। শান্তি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে চলতি বছরের এপ্রিলের শেষের দিকে আন্তঃকোরিয়ার ইতিহাসে এক ‘অবিস্মরণীয় পদক্ষেপের’ সূত্রপাত ঘটে।
সকল ধরনের বিরোধ এবং ভেদাভেদ পাশ কাটিয়ে দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান কিম জং উন এবং মুন জাও-ইন দুই কোরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পরস্পরের সাথে সাক্ষাত করেন। দুই নেতা একটি ফলপ্রসূ আন্তঃকোরীয় শান্তিপূর্ণ পরিবেশের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। শুধু আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়ন নয়, এই সম্মেলনকে পরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শান্তি প্রচেষ্টার পরবর্তী ধাপ
দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে ফলপ্রসূ সাক্ষাতকারের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার দীর্ঘদিনের উত্তেজনা প্রশমনের বিষয়ে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার তরফ থেকে ‘পরমাণু কর্মসূচি’ স্থগিত করার বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত প্রদান করার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান কিম জং উনের সাথে দেখা করার বিষয়ে একমত হয়েছেন। সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া থেকে তিনজন আমেরিকান বন্দীকে মুক্তি দেয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার অফিশিয়াল টুইটারে বলেন–
জুন মাসের ১২ তারিখে সিংগাপুরে কিম জং উন এবং আমার বহুল প্রত্যাশিত সাক্ষাত হতে যাচ্ছে। আশা করছি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের সাক্ষাত একটি ‘সফল মুহূর্ত’ হসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
The highly anticipated meeting between Kim Jong Un and myself will take place in Singapore on June 12th. We will both try to make it a very special moment for World Peace!
— Donald J. Trump (@realDonaldTrump) May 10, 2018
প্রসংগত উল্লেখ্য, সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে প্রেসিডেন্ট পর্যায়ের ‘সর্বপ্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক সাক্ষাত’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সম্মেলনের নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে সিংগাপুর আগ্রহের সাথে এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে।
দক্ষিণ কোরিয়া আসন্ন এই সাক্ষাতকে স্বাগত জানিয়েছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে–
জুনের ১২ তারিখে আসন্ন উত্তর কোরিয়া-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্মেলনকে আমরা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। আমরা আশা করছি, এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কোরীয় উপদ্বীপ অঞ্চলে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ কর্মসূচিসহ একটি চিরস্থায়ী শান্তি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
চীনের প্রভাব
চীন উত্তর কোরিয়ার ‘বন্ধুপ্রতিম’ রাষ্ট্র হিসেবে বেশ আগে থেকেই পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঠিক যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সর্বাত্মক সহযোগিতায় এগিয়ে আসে, ঠিক তেমনি উত্তর কোরিয়া এবং চীনের মধ্যেও পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার বেশ পুরনো ইতিহাস রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সাম্প্রতিক ‘পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে’ চীনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার এই পরমাণু কর্মসূচি স্থগিত করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বস্তুত সাম্প্রতিক সময়ের উত্তর- দক্ষিণ কোরিয়ার ফলপ্রসূ সম্মেলন সম্ভব হয়েছে। পরবর্তীতে ইতিবাচক আলোচনার মাধ্যমে যদি উত্তর কোরিয়া-মার্কিন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় অথবা কোরিয়া উপদ্বীপ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, সেক্ষেত্রে চীনের বর্তমান ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। আসন্ন সিঙ্গাপুর সম্মেলন উপলক্ষে চীনের তরফ থেকে বলা হচ্ছে-
আমরা এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। চীন সেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়ায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী।
শান্তি প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ
২য় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ঠিক যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি দেশের সমঝোতার ভিত্তিতে ‘সানফ্রান্সিস্কো শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছিল, ঠিক তেমনি কোরিয়া অঞ্চলে স্থায়ী ভিত্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু এই দুই দেশ নয়, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সম্পৃক্ততা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সর্বজনীন পদক্ষেপের প্রয়োজন। উত্তর কোরিয়া-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনসহ দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা সমাধানে সবাইকে সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে। চীনের প্রভাবে কিম জং উন ঠিক যেমন নমনীয় মনোভাব নিয়ে আলোচনার জন্য এগিয়ে এসেছেন, ঠিক তেমনি মার্কিন তরফ থেকে আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকলে সত্যিকারভাবে কোরীয় উপদ্বীপ অঞ্চলে স্থায়ী ভিত্তিতে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
ফিচার চবি: youtube.com