বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোটা ব্যবস্থা একটি অত্যন্ত আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা অঞ্চল এবং দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের অনগ্রসর, দলিত, দরিদ্র বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং আদিবাসী জনগণের জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
মূলত পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই কোটা ব্যবস্থা থাকলেও এর কোনো সুনির্দিষ্ট অনুপাত নেই। কোনো দেশের সামগ্রিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা, দেশটির জনসংখ্যার মূলধারা থেকে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এবং সামাজিক পার্থক্যসহ নানা বিষয় পর্যালোচনা করে কোটা ব্যবস্থাটি চালু রাখা হয়। বাংলাদেশেও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আজকের আয়োজনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের কয়েকটি অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের সামগ্রিক কোটা ব্যবস্থার পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
ভারত
ভারতের সরকারি চাকরিতে বর্তমান কোটা ব্যবস্থা প্রদেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন। প্রদেশেভেদে কোটা অনুপাতের কম-বেশি তারতম্য দেখা গেলেও সার্বিকভাবে সমাজের দলিত এবং বিভিন্ন উপজাতীয় সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার ভিত্তিতে সাংবিধানিকভাবে কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে শুধুমাত্র চাকরির ক্ষেত্রেই নয়, সরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও পিছিয়ে পড়া এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সুশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ভারতে জনসংখ্যার অনুপাতে কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের বৈষম্য রোধ করতে ১৯৮৯ সালে ভারতের আইনসভা কর্তৃক অনুমোদিত ‘দলিত, সংখ্যালঘু এবং উপজাতি বৈষম্য দূরীকরণ আইন’ নামে একটি সাংবিধানিক আইন রয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের ১৭ ধারা অনুসারে, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রতি যেকোনো ইচ্ছাকৃত বৈষম্য সৃষ্টি করা বা তাদের সাংবিধানিক কোনো সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় পড়ে।
নেপাল
নেপালে সরকারি চাকরি ব্যবস্থায় বর্ণ, জাত এবং লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে কোটা ব্যবস্থা সংরক্ষণ করা হয়েছে। নেপালে কোটার অনুপাতটি নিম্নরুপ-
- সাধারণ কোটা- ৫৫ শতাংশ
- সংরক্ষিত কোটা- ৪৫ শতাংশ
পুরো অনুপাতটিকে আবার কয়েকটি বিশেষ উপ-কোটায় ভাগ করা হয়েছে-
- মহিলা- ৩৩ শতাংশ
- উপজাতি- ২৭ শতাংশ
- মাদেশি- ২২ শতাংশ
- দলিত সম্প্রদায়- ৯ শতাংশ
- প্রতিবন্ধী- ৫ শতাংশ
- প্রত্যন্ত/ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী- ৪ শতাংশ
এই কোটা ব্যবস্থা নেপালের আইনসভা কর্তৃক স্বীকৃত। ১৯৯৩ সালে নেপালের আইনসভা প্রণীত ‘সরকারি চাকরি আইন’ নামের বিশেষ একটি আইনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা সুরক্ষিত।
পাকিস্তান
প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে পাকিস্তানের কোটা ব্যবস্থায় যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। সরকারি চাকরির পাশাপাশি পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশটির বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য জনসংখ্যার অনুপাতে কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া, প্রশাসনিক চাকরি ব্যবস্থায় মাত্র ৭.৫ শতাংশ সরাসরি মেধা, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয়। বাকি অনুপাতটি প্রাদেশিক বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
- সাধারণ কোটা- ৭.৫ শতাংশ
- পাঞ্জাব- ৫০ শতাংশ
- সিন্ধ- ১৯ শতাংশ
- খাইবার পাখতুনখোয়া- ১১.৫ শতাংশ
- বালুচিস্থান- ৬ শতাংশ
- গিল্গিত-বালতিস্তানের উপজাতি সম্প্রদায়- ৪ শতাংশ
- কাশ্মীর- ২ শতাংশ
সিন্ধ কোটা (১৯%) আবার দুটি বিশেষ ভাগে বিভক্ত-
- শহরাঞ্চল- ৪০ শতাংশ
- গ্রামাঞ্চল- ৬০ শতাংশ
এখানে উল্লেখ্য, সরকারি চাকরিতে পুরো আসন ব্যবস্থার উপরে ১০ শতাংশ আসন নারীদের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
ইতিবাচক পদক্ষেপ নীতি (Affirmative Action Plan)
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ‘ইতিবাচক পদক্ষেপ নীতি’র কারণে কৃষ্ণবর্ণ, হিস্পানিক জাতি এবং স্থানীয় উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর জন্য চাকরি এবং যথাযথ শিক্ষার বিষয়টি সুরক্ষিত হয়েছে। এছাড়া, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও তাদের একটি সুনির্দিষ্ট নীতি রয়েছে।
বেসরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন কোনো কোম্পানি বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যদি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাথে পুরো সামগ্রিক বছরে পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলারের উপরে লেনদেন করে থাকে এবং সেই কোম্পানির কর্মীসংখ্যা পঞ্চাশের অধিক হয়ে থাকে তবে নিয়োগের ক্ষেত্রে সবার জন্য সমান অধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত করতে কোম্পানিগুলোর নিজস্ব একটি পদক্ষেপ বা নীতি (AAP) থাকতে হবে।
এখানে উল্লেখ্য, বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় চাকরি, শিক্ষা কিংবা অন্য কোনো প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের বর্ণ বৈষম্য একটি শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।
কানাডা
কানাডার বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়, মহিলা এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি চাকরিসহ কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা ব্যবস্থা থাকলেও অনুপাতের সংখ্যাটি নির্দিষ্ট নয়। সরকারি বিভিন্ন বিভাগের ধরনভেদে এবং প্রদেশভেদে এই অনুপাতটি ৬-৪৫ শতাংশের মধ্যে থাকে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে-
কানাডায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের ‘সম্পত্তি এবং ঐতিহ্যে’ ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো অধিকার একটি বিশেষ আইনের মাধ্যমে রহিত করা হয়েছে। তবে তাদের ভূমি, বনাঞ্চল এবং প্রাকৃতিক সম্পদে অধিকার রয়েছে।
জাপান
জাপানে বুরাকুমিন এবং কোরিয়ান সম্প্রদায়কে সরকারি চাকরিতে বিশেষভাবে প্রাধান্য প্রদান করা হয়। এছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন কিংবা বেসরকারি কোনো পণ্য এবং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীসংখ্যা পাঁচ শতাধিক হলে বুরাকুমিন এনং আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য ৫ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শুধু চাকরির ক্ষেত্রে নয়, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য জাপানে কম মুনাফায় ব্যাংক লোন, শুল্ক অব্যাহতি এবং এমনকি বিদ্যালয়/কলেজে বিনা বেতনে লেখাপড়ার সুযোগও রাখা হয়েছে।
চীন
চীনের সামগ্রিক জনসংখ্যার ৮ শতাংশ হচ্ছে বিভিন্ন জাতিগত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়। এই জনগোষ্ঠীর জন্য চীনে সরকার স্বীকৃতভাবে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অন্যদের থেকে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য মাসিক সরকারি বৃত্তির পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষা খরচে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিনা শিক্ষা খরচে পড়াশোনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এছাড়া এই গোষ্ঠীগুলোকে চীনের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নীতি (উদাহরণস্বরূপ- চীনের জন্ম নিয়ন্ত্রণ নীতি) থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এছাড়া তাদের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদানসহ শুল্কনীতিতে বিভিন্ন ছাড় দেয়া হয়।
বাংলাদেশ
বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কোটা মিলিয়ে ৫৬ শতাংশ কোটার কথা বলা আছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, অনগ্রসর জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে এক শতাংশ কোটা বরাদ্দ আছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। তখন মেধাতালিকা ২০ শতাংশ বরাদ্দ রেখে ৪০ শতাংশ জেলাভিত্তিক, ৩০ শতাংশ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য এবং ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ নারীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার এই কোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়।
সামগ্রিক বিশ্বের কোটা ব্যবস্থা পর্যালোচনা
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল এবং দেশের কোটা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মূলত সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের জনসংখ্যার মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে বিশেষ কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন আদিবাসী, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র/দলিত শ্রেণী কিংবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থাকতে পারে। একটি দেশের সার্বিক অবস্থা, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ নানা কাঠামোর উপরে নির্ভর করে এই জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা এবং বিশেষ সুবিধা বরাদ্দ করা হয়।
‘কোটা ব্যবস্থার সংস্কার’ একটি চলমান প্রক্রিয়া
বিভিন্ন দেশের কোটা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কোটা বরাদ্দের অনুপাতটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই কোটা বরাদ্দ করা হয় বিধায় সময়ের সাথে সাথে ঐ জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নতি হলে বিভিন্ন সময়ে এই ব্যবস্থায় সংস্কার সাধন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ- ভারত, চীন এবং জাপানের কথা বলা যেতে পারে।