সাহিত্যচর্চা একটি সৃজনশীল বিষয়। আমরা সচরাচর খবরে মিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী বা চিত্রতারকার ব্যাংক ব্যালেন্সের মুখরোচক খবর দেখে থাকি। সিলিকন ভ্যালিতে সফল স্টার্টআপ অথবা হিট সিনেমার জন্য বড় অঙ্কের পে চেক- এভাবেই খবরের শিরোনাম হন ব্যবসায়ী বা তারকারা। কখনো ভেবে দেখেছেন কি, বিশ্ববিখ্যাত বেস্টসেলার লেখকরা কেমন উপার্জন করেন?
শুধুমাত্র বই লিখেই কাড়ি কাড়ি টাকা ঘরে আনছেন নামকরা সব উপন্যাসিকরা। ভক্তরা অধীর আগ্রহে প্রিয় লেখকদের বইয়ের জন্য অপেক্ষা করেন, লেখকরাও হাজির হন নিত্যনতুন বই নিয়ে। দুই মলাটের মাঝে মোহনীয় সব প্লট সাজান তারা। প্রকাশনা সংস্থাগুলো লেখকদের হাতে তুলে দেয় রয়্যালটির অর্থ। পৃথিবীর অন্যতম ধনী আট লেখককে নিয়ে আজকের এই আয়োজন। তালিকায় হয়তো খুঁজে পাবেন আপনার কোনো না কোনো প্রিয় লেখকের নাম!
জেমস প্যাটারসন
নেট অর্থমূল্য: $৭৫০ মিলিয়ন
জেমস প্যাটারসন এই তালিকায় একটি বিশেষ কারণে সবার থেকে আলাদা। শুনে অবাক হবেন, আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সাথে তিনি যৌথভাবে একটি থ্রিলার উপন্যাস লিখছেন। বইটির নাম ‘দ্য প্রেসিডেন্ট ইজ মিসিং’। প্যাটারসন বইটির জন্য সাত অংকের পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। এক সময় বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করতেন তিনি। প্রথম বই প্রকাশের জন্য কয়েকবার প্রকাশকের দরজা থেকে ফিরে যেতে হয়েছে তাকে। আজ তিনি আমেরিকায় সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের লেখকদের একজন।
২০০১ সাল থেকে প্যাটারসনের বইগুলো টানা বেস্টসেলার তালিকায় নাম লেখাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে তার বই ৩০০ মিলিয়নের বেশি বিক্রি হয়েছে। একটি অন্যরকম রেকর্ডও আছে তার সাফল্যের পুঁথিতে। প্রথম লেখক হিসেবে এক মিলিয়ন ই-বুক বিক্রির মাইলফলক ছুঁয়েছেন তিনি। বিগত বছর ৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পারিশ্রমিক পেয়ে সর্বোচ্চ আয় করা লেখকের মুকুট প্যাটারসনের মাথাতেই পরাতে হবে!
ড্যান ব্রাউন
নেট অর্থমূল্য: $১৪০ মিলিয়ন
‘দ্য ডা ভিঞ্চি কোড’ বইটি লিখে নন্দিত এবং নিন্দিত হয়েছেন জনপ্রিয় উপন্যাসিক ড্যান ব্রাউন। রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের এই লেখক পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে। ছোটবেলায় বাবা-মার হাত ধরে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মায় তার। একদিন হুট করে ‘ডিজিটাল ফোরট্রেস’ নামের উপন্যাস লেখা শুরু করেন তিনি। তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশককে খুশি করতে পারলেও পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়নি। ড্যান ব্রাউন আশাহত না হয়ে লেখালেখি চালিয়ে যান। ‘এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস’ তার লেখা রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের প্রথম বই। থ্রিলার ঘরানার এই সিরিজ যখন জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করে, তখন তিনি লেখেন সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘দ্য ডা ভিঞ্চি কোড’। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৮০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়ে ইতিহাসে স্থায়ী আসন পেয়ে গেছে এই কন্সপিরেসি থ্রিলার।
সম্প্রতি লেখক ভিঞ্চি কোডের কিশোর সংস্করণ প্রকাশ করেন। দ্য ডা ভিঞ্চি কোডের ঈর্ষণীয় সাফল্য তার বাকি বইগুলোর কাটতিও বাড়িয়ে দেয়। গেল বছর ৯.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেন এই লেখক।
জর্জ আর আর মার্টিন
নেট অর্থমূল্য: $৬৫ মিলিয়ন
সমগ্র পৃথিবী কাঁপছে ‘গেম অফ থ্রোনস’ নামক জ্বরে। ক’দিন আগেই মুক্তি পেল এই টিভি সিরিজের সপ্তম সিজন। এপিক ফ্যান্টাসি ঘরানার এই বইয়ের সিরিজ গোগ্রাসে গিলে চলেছে পাঠক সমাজ। ঢাউস সাইজের একেকটা বই লিখতে জর্জ আর আর মার্টিন কতগুলো কাগজ ব্যবহার করেছেন কে জানে? কিন্তু বেস্টসেলার সিরিজটির বদৌলতে মার্টিন যে ধনী লেখকদের দলে যোগ দিয়েছেন, তা অনেকেই জানেন। এইচবিও টিভি সিরিজের স্বত্ব কিনে নিলে বইয়ের কাটতি বেড়ে যায়, মার্টিন বনে যান সিরিজটির একজন নির্বাহী প্রযোজক।
প্রতি সিজনে অন্তত একটি পর্বের কাহিনী তিনি নিজে লেখেন। ‘গেম অফ থ্রোনস’ এর জন্য প্রতি বছর এইচবিও লেখককে ১৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে থাকে, তাছাড়া বইয়ের প্রকাশকের কাছ থেকেও প্রচুর অর্থ রয়্যালটি পান জর্জ মার্টিন।
জন গ্রিন
নেট অর্থমূল্য: $১০ মিলিয়ন
‘দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস’ সিনেমাটি দেখেছেন নিশ্চয়ই। দুই ক্যান্সার আক্রান্ত কিশোর-কিশোরীকে উপজীব্য করে লেখা বইটির লেখক জন গ্রিন। ৩৭ বছর বয়সী এই লেখক তার ভাই হ্যাংক গ্রিনকে নিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলেছিলেন। আজ তাদের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। প্রথম উপন্যাস ‘লুকিং ফর আলাস্কা’ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেন তিনি। মোট ৬টি বই লিখেছেন গ্রিন, যার মধ্যে ৫টিরই সিনেমা স্বত্ব বিক্রি হয়ে গেছে। প্রযোজনা সংস্থা থেকে মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক পান তিনি। উল্লেখ্য, ‘দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস’ বইটি ১০ মিলিয়নের বেশি বিক্রি হয়েছে।
স্টিফেন কিং
নেট অর্থমূল্য: $৪০০ মিলিয়ন
হরর বই ভালোবাসেন অথচ স্টিফেন কিং-এর নাম শোনেন নি, এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া দুস্কর। কোটি পাঠকের কাছে স্টিফেন কিং ‘দ্য গ্র্যান্ডমাস্টার অফ হরর’ হিসেবে পরিচিত। ১৯৭৩ সালে ‘ক্যারি’ উপন্যাস লিখে মাত্র ২,৫০০ ডলার পেয়েছিলেন তিনি, বর্তমানে স্টিফেন কিংয়ের সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার! আজও ৭০ বছর বয়সী এই লেখক লিখেই চলেছেন। তার উপন্যাসের সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়েছে অনেক আগেই, সবগুলোই বেস্টসেলার। পাঠকদের জানিয়ে রাখা ভালো, বিখ্যাত সিনেমা ‘দ্য শাইনিং’,‘দ্য শশ্যাংক রিডেম্পশন’ আর ‘দ্য গ্রিন মাইল’ কিন্তু স্টিফেন কিংয়ের বই অবলম্বনে বানানো। ২০১৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পীদের জন্য শ্রেষ্ঠ সম্মাননা ‘ন্যাশনাল মেডেল অফ আর্টস’ পেয়েছেন স্টিফেন কিং। প্রাচুর্যের ক্ষেত্রেও তিনি শীর্ষস্থানীয়। ২০১৬ সালে তার আয় ১৫ মিলিয়ন ডলার।
জে কে রোলিং
নেট অর্থমূল্য: $৮০৫ মিলিয়ন
ইতিহাসে একমাত্র সাহিত্যিক হিসেবে বিলিয়নিয়ার হবার গৌরব অর্জন করেছেন ব্রিটিশ লেখিকা জোয়ান ক্যাথেলিন রোলিং। হতাশা তার জীবনকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল, কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। ট্রেন ভ্রমণের সময় হ্যারি পটার চরিত্রের আইডিয়া তার মাথায় আসে, সেই চরিত্র নিয়ে পরবর্তীতে ৭টি বই প্রকাশ পায় তার হাত ধরে। দাতব্য সংস্থায় অর্থ সাহায্য দেওয়ায় তিনি এখন আর বিলিয়নিয়ার নন, তবুও তার সম্পত্তির পরিমান শুনলে চোখ কপালে উঠে যেতে বাধ্য। ৮০৫ মিলিয়ন ডলারের মালিক রোলিং তার অমর সৃষ্টি হ্যারি পটার থেকে প্রতি বছর যে রয়্যালটি পান, সেটি তার অর্থমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতি বছর। ২০১৬ থেকে এ বছরের জুন অবধি তার আয় ৯৫ মিলিয়ন ডলার।
জন গ্রিশাম
নেট অর্থমূল্য: $২২০ মিলিয়ন
একজন আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন জন গ্রিশাম। পরবর্তীতে লেখালেখির জগতে আসেন। ক্রাইম ফিকশন ঘরানার বই লিখে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। তার বই অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ‘দ্য ফার্ম’ ও ‘পেলিকান ব্রিফ’ এর মতো প্রশংসিত সিনেমা। গ্রিশামের বইয়ের বিক্রির সংখ্যা ৩০০ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। গেল বছরে তার আয়ের পরিমাণ ছিল ১৮ মিলিয়ন ডলার।
শুধুমাত্র বই লিখে রাজকীয় ম্যানশন বা প্রাইভেট জেট কিনে ফেলছেন অনেক বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক। তাদের শুরুটা সহজ না হলেও কঠোর পরিশ্রমের জোরে সচ্ছল জীবনের দেখা পেয়েছেন তারা। পেশা হিসেবে সাহিত্যচর্চা মন্দ নয় বটে!
ফিচার ইমেজ- The Independent