রোহিঙ্গাদের চিঠি: স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করছে শরণার্থীরা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে তাদের স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে চিঠি আদান প্রদান করছে রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি। মিয়ানমারের কারাগারে আটকা পড়ে থাকা অনেকেই জানতে চেয়েছে তাদের পরিবার সদস্যরা বাংলাদেশের শরনার্থী শিবিরে নিরাপদে পৌঁছাতে পেরেছে কিনা। আবার এদেশে থাকা শরণার্থীরাও জানতে চেয়েছে তাদের প্রিয়জন যারা সীমান্ত পেরিয়ে আসতে পারেনি তারা বেঁচে আছে কিনা

রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক সদস্যরা মিয়ানমারের কারাগার ও বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোর মাঝে যে চিঠি আদান-প্রদান করিয়ে দিচ্ছে তা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের মাঝে একটি আশার আলো হিসেবে কাজ করছে। রেড ক্রস জানায়, আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশি শরণার্থী শিবির থেকে প্রায় ১৬০০টিরও বেশি চিঠি সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মাঝে প্রায় ১৬০টি চিঠি রাখাইনের কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশে সেগুলোর উত্তর পাঠানো হয়েছে।

শরণার্থী শিবির থেকে মিয়ানমারে নিখোঁজ আত্মীয়ের জন্য বার্তা সংগ্রহ করছেন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্যরা; Image Source: Reuters/Mohammad Ponir Hossain

বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত ৫৮ বছর বয়সী সাইত বানু নামের এক রোহিঙ্গা শরণার্থী রাখাইনের কারাগারে থাকা তার স্বামীর নিকট থেকে চিঠি পেয়েছেন। চিঠিতে সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পিতা লিখেছেন,

আমার কন্যা উনা জামিনের জন্য যদি ভাল পাত্র খুঁজে পাও, তাহলে তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারো। চিন্তা করো না, কারাগারে কোনো সমস্যা নেই।

শত শত মাইল দূরে অবস্থিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কারাগার থেকে পাঠানো এই বার্তাটিই গত আগস্ট মাসের পরে স্বামীর কাছ থেকে সাইত বানুর কাছে আসা প্রথম খবর। তার স্বামী গত আগস্টে রাখাইনে হওয়া সেনা অভ্যুত্থানের সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন। এসময় প্রায় ৭ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানের সাথে সাইত বানু তার নয় বাচ্চাসহ বাধ্য বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়।

মিয়ানমারের কারাগার থেকে স্বামীর পাঠানো চিঠি পড়ছেন সাইত বানু; Image Source: REUTERS/Zeba Siddiqui

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে এ সময় মিনানমারের সেনারা হত্যা, ধর্ষণ ও শত শত রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করে। জাতিসংঘ এটিকে জাতিগত নিধন বলে অভিহিত করে।

রয়টার্স রেড ক্রস কর্মকর্তাদের দেওয়া সাতটি চিঠির প্রতিলিপি দেখে। সেগুলোর উপরে হাতের লেখায় রেড ক্রসের নাম থাকলেও রয়টার্স এর সত্যতা যাচাই করতে পারেনি বলে প্রকাশ করেছে। চিঠিগুলো শরণার্থীদের প্রিয়জনদের বেঁচে থাকার প্রাথমিক প্রমাণ স্বরূপ। এগুলো পরিবারের সদস্যদের টুকরো খবরও পরিবহন করছে। মিয়ানমারের কারাগার থেকে আসা একটি চিঠিতে একজন লিখেছেন,

আমাকে তিন বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমার জন্য দুশ্চিন্তা করো না।

এদিকে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো এক চিঠিতে একজন লিখেছেন,

আমাদের সবসময়ই আপনার কথা অনেক মনে পড়ে। আমি জানি আপনারও আমাদের কথা মনে পড়ে।

মিয়ানমারের  বাংলাদেশি শরনার্থী শিবিরে থাকা স্ত্রীকে পাঠানো গত ফেব্রুয়ারি মাসের একটি চিঠিতে মিয়ানমারে আটকে থাকা এক রোহিঙ্গা লেখেন,

অনুগ্রহ করে সবার একটি ছবি পাঠাবে। তোমাদের সবাইকে দেখতে পারলে আমার খুব ভালো লাগবে। বাচ্চাদের খবর জানিও।

শরণার্থী শিবির থেকে মিয়ানমারে নিখোঁজ আত্মীয়ের জন্য বার্তা সংগ্রহ করছেন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্যরা; Image Source: REUTERS/Zeba Siddiqui

গত আগস্ট মাসের এক সকালে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের একটি গ্রাম থেকে সাইত বানুর স্বামীকে গেফতার করা হয়। তবে কেন তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে সে সম্পর্কে পুলিশ কিছু জানায়নি। সাইত বানু বলেন, “সেদিন আমাদের গ্রাম থেকে ৫০ জন লোককে গ্রেফতার করা হয়।” তার স্বামীকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এমন কোনো ধারণা ছাড়াই সাইত বানু তাকে ছাড়া পালাতে বাধ্য হয়। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারা গুলি করে হত্যা করছিল, তাই আমরা পালিয়ে এসেছি।

ডিসেম্বর মাসে তাদের আশ্রয়স্থলের আশেপাশের রেড ক্রস স্বেচ্ছাসেবকরা পরিবারের কাছে লিখতে চিঠি লিখতে চায় এমন শরণার্থীদের ডাকে। সাইত বানু তার আত্মীয়দের কাছ থেকে শুনেছিলেন তার গ্রামের বেশিরভাগ লোককে সিত্তে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাই তিনি তাদেরকে তার স্বামীর নাম ও অন্যান্য বিবরণ দেন। রেড ক্রস কর্মীরা পরে মায়ানমারের সিত্তে কারাগারে তাকে খুঁজে বের করে।

জাতিগত নিধন বা গ্রেফতার ও রোহিঙ্গাদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে অত্যাচারের ব্যাপারে ফোনে ও ইমেইলের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র ও পুলিশের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তারা এ ব্যাপারে কোনো সাড়া দেননি। চিঠি আদান প্রদানের ব্যাপারেও কোনো মন্তব্য করেননি তারা।

শরনার্থী শিবিরে যাচ্ছেন রেড ক্রিসেন্টের একজন সদস্য; Image Source: Reuters/Mohammad Ponir Hossain

মিয়ানমার জানিয়েছে, গত আগস্ট মাস থেকে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) সংগঠনের সাথে যুক্ত সন্দেহের ভিত্তিতে ৩৮৪ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মিয়ানমারের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতে, রাখাইন রাজ্যের দুই প্রধান কারাগারে ২,৭০০ জনেরও বেশি বন্দীকে আটক রাখা হয়েছে, যদিও তাদের মধ্যে কতজন রোহিঙ্গা সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। মিয়ানমারের কারাগারের বিভাগের মুখপাত্র মিন টুন সোই এআরএসএ’র সাথে যুক্তের অভিযোগে কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা উল্লেখ করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্তদের কারাগারে রাখা হয়েছিল।

মায়ানমার রেড ক্রসের মাঠকর্মী ৩০ বছর বয়সী ইউজানা ফেব্রুয়ারি কারাগার প্রদর্শন করেন। তিনি রোহিঙ্গা বন্দীদের অনেক উদ্বিগ্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। রোহিঙ্গা ভাষার লিখিত রূপ থাকলেও শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে অনুবাদকের সাহায্যে ইংরেজিতে লিখে রাখেন রেড ক্রস কর্মীরা। আর রাখাইনের কারাগারের চিঠিগুলো লেখা হয় বার্মিজে যেন সেন্সরের জন্য সেগুলো পড়া যায়। মিয়ানমারের জেল থেকে আসা সমস্ত যোগাযোগ সেন্সর করে দেওয়া হয়, ফলে চিঠিগুলো পরিবারের খবর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। রোহিঙ্গারা গত বছরের সহিংসতা সম্পর্কে বা কেন তাদের গ্রেফতার করা হয় সে সম্পর্কে কিছু লিখতে পারে না বলে জানান রেড ক্রস কর্মকর্তারা।

ছেলে জীবিত থাকার খবর পেয়ে কাঁদছেন রোশান বেগম; Image Source: Reuters/Mohammad Ponir Hossain

সম্প্রতি জাদিমুরা শরণার্থী শিবিরে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মকর্তা মিয়ানমারের কারাগারে জীবিত ১৬ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন। এই তালিকা শুনতে আরও অনেকের সাথে আলি মিয়ান নামে ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধও হাজির হন। তার ছেলের নাম শুনে তিনি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি। পরিবারিক বিবরণ নিশ্চিত করা হলে তিনি বুঝতে পারেন তার একমাত্র পুত্র জীবিত আছে। তিনি কাঁদতে শুরু করেন। স্ত্রীকে জানানোর জন্য লাঠির উপর ভর দিয়ে তিনি আশ্রয়স্থলে ফিরে যান। তিনি জানান, ছেলে থাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে খাবারের জন্য রিলিফ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না। তার স্ত্রী রোশান বেগমও ছেলের জীবিত থাকার খবর পেয়ে কাঁদতে শুরু করেন। ছেলের কাছে চিঠি লিখবেন বলেও জানান তিনি।

বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পারিবারিক সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার একটি মানবিক দায়িত্ব পালন করলেও আটককৃত রোহিঙ্গাদের মুক্তি ও লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরে গিয়ে নিরাপত্তা ও সমগ্র অধিকারের সাথে বসবাস নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

Featured Image Source: REUTERS/Zeba Siddiqui

Related Articles

Exit mobile version