ইংল্যান্ডের রাজশিশুরা যেসব অদ্ভুত নিয়মের মাঝে বড় হয়

ব্রিটিশ রাজপরিবারে নতুন শিশুর আগমনের জের ধরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোদ ইংল্যান্ডেই সমালোচনার ঝড় বইছে। ইংল্যান্ডের আইন অনুযায়ী তিন অথবা তার বেশি শিশু থাকলে, যেকোনো ধরনের সরকারি ভাতা থেকে বঞ্চিত হবে তার পরিবার। সাধারণ জনগণ প্রশ্ন তুলেছে, কেন রাজপরিবারের শিশুর জন্যেও একই নিয়ম ধার্য করা হবে না? এটি বাদেও সমালোচনা জন্ম উপলক্ষে আরো অনেক নিয়ম পালন করতে হয়। এরকমই কয়েকটি নিয়ম সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক তাহলে।

জন্ম হবে বাড়িতে

রাজপরিবারে চলে আসা নিয়ম অনুযায়ী শিশুদের জন্মের জন্য তাদের বাড়িকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতো। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ পর্যন্ত তার সব সন্তানকে বাসাতেই জন্ম দিয়েছেন। কোনো জটিলতা থাকলে বিশেষায়িত বাসা কেনা হতো। সেই বাসায় সবরকম ব্যবস্থা করা হতো শিশুর আগমনের জন্য। রাজশিশুর জন্ম যেকোনোভাবে রাজপরিবারের জমিতেই হতে হবে। প্রথম এই নিয়ম ভঙ্গ করেন প্রিন্সেস ডায়ানা। উইলিয়াম ও হ্যারি দুজনেরই জন্ম হয় বেসরকারি হাসপাতালে। কেট মিডলটনের সন্তানদেরও একই হাসপাতালে জন্ম হয়েছে। যদিও কেট ভাবছিলেন পূর্বের নিয়ম ফিরিয়ে আনার কথা, বিভিন্ন জটিলতার কারণে শেষ মুহূর্তে কেটকে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়।

শিশুর জন্মের সাক্ষী

শিশুটি আসলেই জন্মাচ্ছে কিনা, এ বিষয়ে সাক্ষী হতে একজন প্রত্যক্ষদর্শী রাখা হতো। তিনি শিশু জন্মের পুরোটা সময় আঁতুড়ঘরে থেকে নিশ্চিত করতেন শিশু জন্মের ঘটনা সত্য। প্রিন্স চার্লসের জন্মের আগে এ প্রথা বাতিল হয়ে যায়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেরি ফিসেল বলেন, সেন্ট জেমস প্রাসাদে দ্বিতীয় জেমসের সন্তান জন্ম উপলক্ষে ৪২ জন প্রত্যক্ষদর্শী ছিল। তা সত্ত্বেও সস্তা সংবাদপত্রে, কফি হাউজে গুজবের ঝড় ওঠে বাস্তবে নাকি শিশুটির জন্ম হয়নি, কোনো এক উপায়ে শিশুটিকে আঁতুড়ঘরে আনা হয়েছে। এসব গুজবের কারণে দ্বিতীয় জেমসের সন্তান রাজা হতে পারেননি। শিশুর জন্মস্থলে অন্য ব্যক্তি আমন্ত্রিত হলেও শিশুর পিতার কিন্তু সেখানে থাকা নিষেধ। তবে এই নিয়মও ভাঙা হয়েছে।

পড়ালেখা হবে বাড়িতেই

মাননীয় ক্যামব্রিজের রাজকুমার জর্জ! Source: Marie Claire

রাজশিশুদের জন্য প্রাসাদেই শিক্ষক রেখে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হতো। প্রিন্স চার্লস পর্যন্ত এ নিয়ম বহাল থাকলেও ডায়ানা তার ছেলেদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। কেট এবং উইলিয়াম তাদের ছেলেকে বাড়ির বাইরে পাঠাচ্ছেন, তবে তা নামীদামী বেসরকারি বিদ্যালয়ে।

শিশুর আগমন জানানোর পদ্ধতি

টোনি এপেলটন; Source: MassLIve.com

নতুন শিশুর জন্মের খবর রাজপরিবার থেকে নিশ্চিত হতে একটু সময় লাগত। শিশুর জন্মের পর প্রথমে জানতে হবে রানীকে। তার আগে এই তথ্য আঁতুড়ঘরের বাইরের কাউকে জানানো যাবে না। আগে যা দূত মারফত জানানো হতো, এখন তা মুঠোফোনেই হয়ে যায়। সন্তানদের জন্মের পর প্রিন্স উইলিয়াম তার দাদীকে এনক্রিপটেড টেলিফোনে খবর দিয়েছিলেন। চিকিৎসকদের সাক্ষরিত একটি রাজকীয় ঘোষণা প্রাসাদের বাইরে চিত্রফলকে আটকে দেওয়া হয়। সেখানে সার বেঁধে মানুষেরা নিজ চোখে শিশুর জন্মের খবর পড়ে যায়। আজও হাসপাতালের সামনে অনেক মানুষের ভিড় জমে নবাগত শিশুর অপেক্ষায়। কেট-উইলিয়াম দম্পতি এই নিয়ম ভেঙে চিত্রফলকে প্রকাশের আগেই নিজেদের টুইটার, ফেসবুক পেইজে শিশুর জন্মের সংবাদ প্রকাশ করেছেন। মধ্যযুগ থেকে চলে আসা নিয়ম অনুযায়ী একজন রাজকর্মচারী নগরের সবাইকে চিৎকার করে খবর পড়ে শোনান। তখনকার দিনে শহরের অনেক মানুষ লিখতে পড়তে জানতো না। আজও এই নিয়ম বহাল আছে।

তবে এতসব সত্ত্বেও ৪২ দিনের মাঝে সরকারি খাতায় শিশুদের জন্মের নিবন্ধন করা লাগে আর পাঁচজন সাধারণ নাগরিকের মতোই।

তোপধ্বনি

গ্রিন পার্কের তোপধ্বনি; Source: Forces.net

শিশুর সম্মানে লন্ডন টাওয়ার থেকে ৬২ বার তোপধ্বনি করা হয়। সেখানে রাতের আলোকসজ্জায় নতুন রঙের সংযোজন করে। বাকিংহাম প্যালেসের কাছে অবস্থিত গ্রিন পার্ক থেকে ৪১ বার তোপধনি দেওয়া হয়।

নামের বহর

রাজপরিবারের শিশুদের নাম সাধারণত তিন থেকে চার শব্দের হয়। নাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের পূর্বপুরুষের নাম প্রাধান্য পায়। প্রিন্স উইলিয়ামের পুরো নাম হলো উইলিয়াম আর্থার ফিলিপ লুইস। তার মেয়ে শার্লটের নাম শার্লট এলিজাবেথ ডায়ানা। এতবড় নাম থাকা সত্ত্বেও তাদের কিন্তু ডাকনাম বা ছদ্মনাম নেই। অর্থাৎ পরিবারের স্কুলে যাওয়া সদস্য জর্জের বন্ধুদের তাকে শুধু জর্জ বলে ডাকার অনুমতি নেই। তার জন্যেও বরাদ্দ আছে দাপ্তরিক নাম। একটু কষ্ট করে জর্জকে ডাকতে হবে মাননীয় কেমব্রিজের রাজপুত্র জর্জ নামে। সংক্ষেপে তাকে জর্জ কেমব্রিজ বলেও ডাকা যায়।

ছেলে সন্তানদের অগ্রাধিকার

চলে আসা নিয়মানুযায়ী ছেলে সন্তানেরা সবকিছুতে এমনকি সিংহাসনেও অগ্রাধিকার পেতো। ২০১৩ সালে এর বিলোপ হয়। ফলে লুইয়ের পক্ষে শার্লটকে টপকে সিংহাসন অর্জন সম্ভব হবে না, যদি না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। লুইয়ের জন্মের ফলে প্রিন্স হ্যারিও দাবীদার হিসেবে একধাপ পিছিয়ে গেছেন।

পোষা প্রাণী

রাজশিশুদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভিন্ন পোষা প্রাণী থাকে। আর বেশিরভাগ সময়েই সেগুলো হয় ঘোড়া।

অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ

নকল করে হলেও উপস্থিত থেকে আনন্দ প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক; Source: Popsugar

শিশুদের মন ভালো না থাকুক, অথবা অসুস্থ থাকুক, তাকে উপস্থিত থাকতেই হবে সব রাজকীয় আয়োজনে। শিশুর মতামতের চেয়ে এখানে নিয়মকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।

রাজপরিবারের আয়া

রাজকুমার রাজকুমারীদের আয়া মারিয়া বোরেলো; Source: Pinterest

রাজশিশুর রক্ষক আয়া হতে গেলে আপনাকে শিখতে হবে গাড়ি চালানো। শুধু তা-ই নয়, কোনো ষড়যন্ত্রকারী গাড়ির পিছু নিলে কীভাবে গাড়ি চালাতে হবে সেটাও। সুশিক্ষিত হওয়ার সাথেই আপনাকে হতে হবে কারাতে, তায়কোয়ান্ডোতেও পারদর্শী। উইলিয়াম-কেট দম্পতির শিশুদের বর্তমান আয়ার নাম মারিয়া বোরেলো।

খ্রিস্টীয়করণ অনুষ্ঠান

প্রজন্ম ধরে চলে আসা গাউন; Source: Popsugar

কয়েক সপ্তাহের মাঝে ব্রিটিশ রাজপরিবারের শিশুদের খ্রিস্টীয়করণ করা হয়। দায়িত্বে থাকে ইংল্যান্ডের প্রধান চার্চ। জর্জ ও শার্লটকে খ্রিস্টীয়করণ করেছেন ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি। এই অনুষ্ঠানে মিডিয়াকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অনুষ্ঠান চলাকালে তাদের আগমন নিষিদ্ধ। কিন্তু রাজকুমারী শার্লটের বেলায় এই নিয়ম ভেঙে জনতাকে রাজকুমারীর সাথে সেলফিও তুলতে দেওয়া হয়েছিল। এদিনে শিশুদের পরানো হয় ঐতিহ্যবাহী গাউন। এই গাউন আট প্রজন্ম ধরে পরা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৬২ জন রাজশিশু এই পোশাকে খ্রিস্টান হয়েছেন। অনুষ্ঠানের পর নতুন শিশুর সাথে তোলা পারিবারিক ছবি প্রকাশ করা হয়। খ্রিস্টীয়করণের পর উৎসুক জনতা উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারে।

ধর্মপিতা-মাতা

একজন রাজশিশুর কমপক্ষে ছয়জন ধর্ম পিতা মাতা থাকে। কিন্তু একদম নিজের পরিবারের কেউ ধর্ম পিতা-মাতা হতে পারেন না। যেমন, কেট-উইলিয়ামের ছেলে মেয়েদের ধর্মপিতা হতে পারবেন না প্রিন্স হ্যারি।

এছাড়া প্রত্যেক রাজশিশুকে রাজপরিবারের নিয়মে কথাবলা হাঁটাচলা শিখতে হয়, যেন তারা রাজপরিবারে অবাঞ্ছিত না হয়ে যান। লক্ষ্য করলে দেখা যায় তাদের পোশাকের মিল। তারা নিজেদের পছন্দমাফিক পোশাক পরতে পারে না। পরিবারের আর সবার সাথে মিল রেখে তাদের পোশাক, এমনকি ডায়পার পর্যন্ত বাছাই ও ডিজাইন করা হয়। রাজ পরিবারের প্রত্যেক শিশুকে বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজির পাশাপাশি অন্যান্য ভাষায় পারদর্শী হতে হয়। স্প্যানিশ বা ফরাসী ভাষা দিয়ে তারা শুরু করে। অন্যান্য দেশ ভ্রমণের সময় সেদেশের রাজপ্রতিনিধিদের হৃদয়ে প্রবেশ করাই এসবের উদ্দেশ্য।

ফিচার ইমেজ: El Español

Related Articles

Exit mobile version