মিশরের কথা বললেই চোখের সামনে সবার আগে ভেসে ওঠে দুটি দৃশ্য। পাহাড়ের মত উচুঁ তিনকোণা সব পিরামিড আর স্ফিংস। পিরামিডের গঠনে হয়তো শৈল্পিক ধাচটা কম, পেল্লায় সব পাথরে বানানো এই বস্তুর রস আস্বাদন করার সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না, কিন্তু স্ফিংস এর বেলায় এর শৈল্পিক মূল্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ৭৩ মিটার লম্বা, ২০ মিটার উচু, মানুষের মাথা আর সিংহের দেহওয়ালা পূর্বমুখী এই সুবিশাল ভাস্কর্য লক্ষ লক্ষ লোককে টেনে নিয়ে যায় মিশরের গিজা উপত্যকাতে।
এতদিন পর্যন্ত আমরা জেনে এসেছি মিশরের এই অতিকায় স্ফিংস একটাই আছে। কিন্তু সম্প্রতি দুই ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এক অদ্ভুত দাবি তুলেছেন। কী বলছেন তারা? স্ফিংস নাকি আরেকটা আছে, এমনই অতিকায়, এমনই সুবিপুল এবং সেটা নাকি গিজা উপত্যকার বর্তমান স্ফিংসের আশেপাশেই কোথাও বালু চাপা পড়ে আছে। বলাবাহুল্য, গোটা বিশ্বে সাড়া পড়ে যাওয়ার মতো দাবিই তুলেছেন তারা।
এই দুই ব্রিটিশ ঐতিহাসিক, যাদের নাম যথাক্রমে গ্যারি ক্যানন আর ম্যালকম হুটোন, তাদের দ্বিতীয় স্ফিংস এর অস্তিত্বের সাপেক্ষে বেশ কিছু তত্ত্ব পেশ করেছেন। প্রথমটা হল, প্রাচীন মিশর এবং গ্রীসের বহু ভবন, দুর্গ এবং সমাধিস্থলে স্ফিংস এর ছোটখাট ভাস্কর্য আর চিত্র পাওয়া গিয়েছে। এসব ভাস্কর্য বা চিত্রতে স্ফিংস সবসময়ই জোড়ায় জোড়ায় ছিল। কাজেই মিশরীয়রা স্রেফ একটা জবরদস্ত স্ফিংস বানিয়েই ক্ষান্ত হবে এটা তারা মানতে নারাজ। বিশেষত যেখানে প্রাচীন মিশরীয়রা হাজার হাজার বছর ধরে একের পর এক বিরাটকায় সব পিরামিড বানিয়ে গিয়েছে, সেখানে দুটি স্ফিংস বানাতে তাদের বিশেষ আপত্তি থাকার কথা না।
দ্বিতীয় যুক্তিটি আরো মোক্ষম। গবেষকেরা তুলে ধরেছেন স্ফিংস এর সাথে জড়িত প্রাচীন মিশরীয় লোকগাথা। মিশরীয় পূরাণের মতে, স্ফিংস প্রকৃতি ও জীবনের দ্বৈতসত্ত্বাকে উপস্থাপন করে। পুরুষ ও নারী, চাঁদ ও সূর্য; এমন সব দ্বৈতসত্তাকে স্ফিংস এর মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। এজন্য সব সময় স্ফিংস বানানো/আকাঁ/খোদাই করা হয়েছে জোড়ায় জোড়ায়। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো, প্রতিদিন সূর্য দিন শেষে বিশ্রাম করতে যায় আর চাঁদ রাত শেষে বিশ্রাম করতে যায় এবং চাঁদ ও সূর্যকে দুটি আলাদা আলাদা স্ফিংস সর্বদা পাহারা দিয়ে রাখে। কাজেই সেই হিসেবে দুটি স্ফিংস থাকার কথা।
ব্রিটিশ এই দুই গবেষক তাদের গবেষণায় মূল পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করছেন প্রাচীন মিশর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যাসাম এল শাম্মা এর লেখা বই Quest for the Truth: Discovering The Second Sphinx-কে। ২০১১ সালে প্রকাশিত এই বইয়ে লেখক দাবি করেছেন, সূর্য পূজা করতো এমন প্রাচীন জাতিদের মধ্যে মিশরীয়রা একটি এবং তাদের বানানো স্ফিংস অবশ্যই জোড়ায় জোড়ায় থাকবে। হয় এই দুটিকে মুখোমুখি বানানো হবে কিংবা তারা পরস্পরের দিকে পিঠ ফিরিয়ে আছে, এই অবস্থানে বানানো হবে।
তা কেবল দাবির স্বপক্ষে যুক্তি দেখালেই তো হবে না। প্রমাণও যে চাই। গ্যারি ক্যানন প্রমাণ হিসেবে দেখাচ্ছেন বিমান থেকে তোলা কিছু ছবিকে। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে বর্তমান স্ফিংসের পাশেই বিরাট এক বালুর স্তুপ, আকারে আকৃতিতে বর্তমান স্ফিংসের মতোই, উচ্চতায় খানিকটা বেশিই লম্বা। তার দাবি হল, এই বালির স্তুপের নীচেই চাপা পড়ে আছে দ্বিতীয় স্ফিংস।
গবেষকদের দাবি, বর্তমান স্ফিংসের বয়স কম করে হলেও ১২,০০০ বছর। এই দাবিটিও নতুন, কেননা সাধারণত বিজ্ঞানী মহলে এটাই স্বীকৃত যে স্ফিংস এর নির্মাণকাল খ্রিস্টের জন্মের ২,৫০০ থেকে ২,৭০০ বছর আগে। অর্থাৎ মোটামুটি ৪,৬০০ বছর আগে স্ফিংস বানানো হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু গবেষকদের একজন ক্যানন দাবি করছেন অন্যরকম। ব্রিটিশ এক্সপ্রেস নিউজকে দেওয়া সাক্ষাতকারের ভাষ্যমতে, স্ফিংস যখন বানানো হয়েছিলো তখন মিশরের ঐ এলাকাতে কোন বালু ছিল না। বালু থাকলে সেখানে পাথর খুড়ে অমন দশাই ভাস্কর্য বানানো সম্ভব হত না। কাজেই স্ফিংস যখন বানানো হয়েছিলো তখন গোটা জায়গাটা ছিল পাথুরে পাহাড়ী অঞ্চল আর সেই সময়টাই হল বার হাজার বছর আগে। পিরামিডও নাকি ঐ সময়েই বানানো হয়েছিলো।
এর অর্থটা বুঝতে পারছেন তো? এর অর্থ হলো ব্রিটিশ এই দুই গবেষক দাবি করছেন পিরামিড বা স্ফিংস, কোনোটাই প্রাচীন মিশরীয়দের কীর্তি নয়। বরং মিশরীয়রা আসার আগে এই ভূমিতে যেসব প্রাচীন জাতি বাস করতো, তারাই বানিয়েছিল এর বিস্ময়কর সব নিদর্শন। নুবিয়ান নামে পরিচিত এই সব প্রাচীন অধিবাসীদের ব্যাপারে অবশ্য অন্যান্য গবেষকেরাও বেশ মাথা ঘামিয়েছেন। বলা হয়, মিশরের দক্ষিণের দিকে ছিল প্রাচীন নুবিয়া অঞ্চল, সেখান থেকেই আগমন ঘটেছে এই জাতির মানুষদের।
তো কোথায় গেল সেসব প্রাচীন জাতি? এর উত্তরও দিয়েছেন গবেষকদ্বয়। প্রায় ১০ হাজার বছর পূর্বে গোটা পৃথিবীতে দেখা দেয় এক ভয়ানক হিমযুগ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ কয়েকবার হিমযুগ দেখা দিয়েছিলো, এর ফলে সবুজ শ্যামল এলাকা ঢেকে গিয়েছিলো শীতল বরফের চাদরে, আবার কোথাও বরফ গলে উন্মুক্ত হয়েছিল বিরাট বিরান প্রান্তর, আবার কোথাও সাগর তার জায়গা থেকে সরে গিয়ে রেখে গিয়েছিলো ধবধবে বিরাট লোনা জমি। এমনই সব হিমযুগের সর্বশেষটি মিশরের প্রাচীন বাসিন্দাদের বিলুপ্ত করে দিয়েছিলো বলে ধারণা করছেন এই গবেষকেরা। গ্যারি ক্যানন যুক্তি দেখাচ্ছেন এই যে, বর্তমান স্ফিংস যে পিরামিডের সামনে আছে, সেই খাফরেন পিরামিড স্ফিংসের তুলনায় প্রায় ৬০ মিটার উচু ভূমিতে বানানো। গ্যারির বক্তব্য হল, স্ফিংস এই পিরামিড নয়, বরং এর বহু আগের কোনো সভ্যতা/নগরীর প্রহরী হিসেবে বানানো হয়েছে আর সেই প্রাচীন সভ্যতা চাপা পড়ে আছে পিরামিডের নিচে।
এত কিছু পড়ার পরে যদি পাঠক-পাঠিকারা ‘এই দ্বিতীয় স্ফিংস মিললো বলে’ ভেবে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করেন, তবে জেনে রাখুন, হতাশ হওয়ার মতো বক্তব্যও আছে। মূলধারার কোনো গবেষকই দ্বিতীয় স্ফিংস এর অস্তিত্বের ব্যাপারে বিশ্বাস করেন না। এদিকে যার বই পড়ে ব্রিটিশ গবেষকদ্বয় এমন বেদম খাটছেন সেই ব্যাশাম এল শাম্মাও আপনাকে হতাশ করবেন। লেখকের দাবি হল, দ্বিতীয় স্ফিংস একটা ছিল বটে, কিন্তু হাজার বছরের যুদ্ধ আর ক্ষয়ের ধাক্কায় সেটার এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। কাজেই অনর্থক বালু খুড়ে কোনো লাভ হবে না। মিশরীয় লেখকের দাবি সত্য হয়ে থাকলে বুঝতে হবে, স্ফিংসের নিঃসঙ্গতা আর ঘোচার নয়। অনাদিকাল ধরে ধু ধু মরুভূমিতে একাকী বসে থাকাই তার নিয়তি। আর যদি গ্যারির দাবি সত্য বলে প্রমাণিত হয়? বর্তমান বিশ্বের সবথেকে শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার নিয়ে কী পরিমাণ আলোড়ন হবে তা কল্পনা করাও কঠিন।