ভারতের চাঞ্চল্যকর শিনা বোরা হত্যারহস্য ও এক খুনী মায়ের আদ্যোপান্ত

২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল। মুম্বাই মেট্রো ওয়ানের মুম্বাই শাখায় কর্মরত শিনা বোরা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল। ২৫ বছরের হাসিখুশি এক তরুণী। রাহুল নামের এক তরুণের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ। কিছুদিন আগেই বাগদান সম্পন্ন হয়েছে তাদের। চোখে একসাথে একটা ছোট্ট ঘর বাঁধার স্বপ্ন। হঠাৎ কী এমন হল যে সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে, চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বিদেশে চলে গেল মেয়েটি? প্রশ্নগুলোর উত্তর সহসাই পাওয়া যায়নি। তবে দেরি হলেও একসময় সবাই জানতে পেরেছে শিনা বোরার হারিয়ে যাওয়া আর এর পেছনে থাকা রাঘব-বোয়ালদের কথা।

শিনা বোরা; Source: The Quint

তবে এই গল্পটা যতটা না শিনার, তার চাইতে অনেক বেশি তার মা, সাবেক টেলিভিশন এক্সিকিউটিভ পিটার মুখার্জির স্ত্রী এবং আইএনএক্স মিডিয়ার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ইন্দ্রানী মুখার্জীর। ইন্দ্রানী মুখার্জির প্রথম ঘরের সন্তান ছিল শিনা। ১৯৮৭ সালে মেঘালয়ার শিলংয়ে সিদ্ধার্থ দাস ও পরি বোরার (ইন্দ্রানী মুখার্জীর পূর্ব নাম) ঘরে জন্ম হয় শিনা এবং তার ভাই মিখাইলের। তবে সে সময় লিভ টুগেদার করছিলেন ইন্দ্রানী আর সিদ্ধার্থ।

ইন্দ্রানী আর সিদ্ধার্থের এই সম্পর্ক বেশিদিন টেকেনি। একটা সময় ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের। মা হিসেবে সন্তানদের হয়তো ভালোবাসতেন ইন্দ্রানী! নিজেকে আর নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে তার চাইতেও বেশি ভালোবাসতেন এই নারী। সফলতার শিখরে উঠতে নিজের বাবা-মায়ের ঘর ছেড়ে এগিয়ে যান তিনি। নিজের সাথে সিদ্ধার্থের সম্পর্ক ও সন্তানদের কথা মুখ ফুটে কখনোই কাউকে জানাননি তিনি।

উচ্চাভিলাষী নারী ছিলেন তিনি, উঠতে চেয়েছিলেন সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে। আর সেভাবেই কাজ করতে থাকেন এই নারী। ছেলেমেয়েকে গুয়াহাটিতে নিজের বাবা-মায়ের কাছে রেখে কলকাতা চলে যান ইন্দ্রানী। সেখানে তার পরিচয় হয় সঞ্জীব খান্নার সাথে। বিয়ে করেন তারা। সঞ্জীবের সংসারে একটি মেয়ের জন্ম দেন ইন্দ্রানী। তবে কিছুদিন পর ভেঙে যায় তার এই বিয়েটি। থেমে থাকতে চাননি ইন্দ্রানী এরপরও।

এবার আপনাদেরকে শোনাবো এই পুরো খেলার আরেক বড় ঘুঁটি পিটার মুখার্জীর কথা। পিটার মুখার্জী তখন বেশ নামকরা মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। ২০০২ সালের কথা। রাতের বেলা লাইব্রেরী ক্যাফেতে দেখেন পিটার ইন্দ্রানীকে। সেখানেই ভালোবেসে ফেলেন। তখন তার সাথে ছিল অন্য আরেকজন নারী। সেই নারীকে ছেড়ে ইন্দ্রানীর দিকে সমস্ত মনোযোগ দেন পিটার। খোঁজ নিতে বলেন নিজের কাছের লোকদেরকে ইন্দ্রানীর ব্যাপারে। এরপর আর খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি পিটারকে। একমাসের ভেতরেই ইন্দ্রানীকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন পিটার মুখার্জী। ব্যাপারটা ইন্দ্রাণী মুখার্জীর জন্য ছিল বেশ লোভনীয়। তাই না করার কথা ভাবেননি ইন্দ্রাণী। আর করেনও নি।

২০০২ সালে অনেক গুজবের অবসান ঘটিয়ে ইন্দ্রানী নিজ থেকে ১৬ বছর বেশি বয়সী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব পিটার মুখার্জীর সাথে সংসার শুরু করেন। বিয়ের সময় পিটারের অধীনস্থ হয়ে কাজ করতেন ইন্দ্রানী। বিয়ের পর ইন্দ্রানীর ছোট মেয়ে ভিদেহীর সব দায়িত্ব পিটার নিয়ে নেন। ভিদেহী ছিলো ইন্দ্রানী ও সঞ্জীব খান্নার মেয়ে। বিয়ের সময় খুব একটা জানাজানি করেননি ইন্দ্রাণী বা পিটার কেউই। কম ঘটা করে সম্পন্ন করা এই বিয়ে বেশ ভালো প্রভাব ফেলে ইন্দ্রানী ও পিটার মুখার্জীর ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে। পিটারের সমস্ত কাজের অংশ হয়ে দাঁড়ান ইন্দ্রানী। ২০০০ সাল থেকে ওরলির মারলো বিল্ডিংয়ে ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকতেন পিটার। সেটা কিনে নেন তিনি ২০০২ সালে। নিজেদের ইনাক্স সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিটি, যেখানে কাজ করার জন্য কলকাতা থেকে মুম্বাইয়ে এসেছিলেন ইন্দ্রানী, সেটার হেড হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। একটু একটু করে বেশ সফলতা লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। রিলায়েন্সের সাথে কাজ করতে শুরু করে ইনাক্স, যেটাকে কিনা ইন্দ্রাণী নিজেদের সবচাইতে বড় ক্লায়েন্টের একজন বলে মনে করতেন।

কোম্পানি একটু একটু করে উপরের দিকে নিজের জায়গা করে নেওয়ার ফলাফল স্বরূপ ২০০৫ সালে স্টার টিভিতে কৌন বানেগা ক্রোড়পতির মতন জনপ্রিয় শো আবার চালু করার সুযোগ পান চ্যানেলটির তৎকালীন সিইও পিটার মুখার্জী। ২০০৬ সালে শো’র হোস্ট অমিতাভ বচ্চন অসুস্থ হয়ে পড়লে অবশ্য বন্ধ হয়ে যায় সেই শোটি। ফলে খুব দ্রুত নিজের কাজ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন পিটার, আর শুরু হয় ইনাক্স নিউজ এবং ইনাক্স মিডিয়ার। ২০০৭ সালে ইনাক্সের চিফ স্ট্র্যাটেজি অফিসার এবং চেয়ারম্যান হন পিটার। তাই খুব বেশিদিন ইন্দ্রানীকেও দূরে থাকতে হয়নি ইনাক্স থেকে। কিছুদিন পরেই সিইও হিসেবে ইনাক্সে যোগদান করেন ইন্দ্রানী। সবকিছু এভাবেই চলছিল এই দম্পতির জীবনে। অন্তত বাইরের দুনিয়ায় সবাই সেটাই জানতো। কিন্তু ঘটনার অন্তরালে ঘটে চলছিল অন্য ঘটনা। আর তার আড়ালেও অন্য খেলায় মেতে ছিলেন ইন্দ্রানী।

ইন্দ্রানী এবং পিটার মুখার্জী; Source: Highlights India

২০০৬ সালে মেয়েকে পড়াশোনার জন্য নিজের কাছে নিয়ে আসেন ইন্দ্রানী। ওরলির মারলো হাউজিং সোসাইটিতে শিনাকে রাখেন ইন্দ্রানী। সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি করে দেয় তাকে। সেখান থেকেই ব্যাচেলর অফ আর্টস শেষ করে শিনা। শিনাকে নিজের বোন পরিচয় দিয়ে বাসায় তোলেন ইন্দ্রানী। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। পড়াশোনা শেষ করে ২০০৯ সালে রিলায়েন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে কাজ করে শিনা। যেমনটা আগেও বলা হয়েছে, এর ভেতরে ২০০৭ সালে পিটার মুখার্জী স্টার ইন্ডিয়ার সিইও পদ থেকে সরে আসে আর ইন্দ্রানীর সাথে যুক্ত হয়ে আইএনএক্স মিডিয়া নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এরপর ২০০৯ সালে নতুন এই কোম্পানি বিক্রি করে দেন তারা। ইন্ডি মিডিয়া নেটওয়ার্ক কিনে নেয় পিটার এবং ইন্দ্রানী মুখার্জীর ইনাক্স মিডিয়া এবং নিউজ এক্স।

ওদিকে শিনার জীবনটাও থেমে ছিলো না। ২০১১ সালের জুনে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার হিসেবে মুম্বাই মেট্রো ওয়ানে যোগ দেয় সে। মায়ের সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখা যায় শিনাকে। পরবর্তীতে প্রকাশ পায় সেসবের ছবিও। তবে সেখানে মা নয়, ইন্দ্রানীকে নিজের বোন হিসেবেই মেনে নিয়েছিল শিনা আর সবার কাছে ইন্দ্রানী প্রকাশও করেছিল সেটাই। কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটায় ঝামেলা তৈরি হয় যখন সৎ বাবা পিটার মুখার্জীর ছেলে রাহুলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায় শিনা। রাহুল পিটারের আগের ঘরের দুই সন্তানের ভেতরে ছোট ছেলে। বাবার সাথে মুম্বাইয়ের থাকা হত রাহুলের। সেখান থেকেই ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় শিনা ও রাহুলের। একে অন্যকে অনেক বেশীই ভালোবেসে ফেলে তারা। মায়ের বোন হওয়া সত্ত্বেও শিনাকে মনে ধরে যায় রাহুলের। কথাটা প্রকাশ করে রাহুল। বাঁধা দেয়নি শিনাও। পরবর্তীতে ভালোবাসা থেকেই রাহুলের কাছে সৎ হতে চায় শিনা। জানিয়ে দেয় সত্যি ঘটনা। ইন্দ্রাণী যে আদতে শিনার বোন নয়, মা, সেটা রাহুলকে বলে শিনা। আর রাহুলও সেটা জানিয়ে দেয় তার বাবাকে। এর পেছনে অবশ্য শিনার সাথে জীবন কাটানোর উদ্দেশ্যটাই মুখ্য ছিল। ইন্দ্রানীকে ছোট করা নয়। কিন্তু তাদের এই সম্পর্ককে মেনে নিতে কষ্ট হয় ইন্দ্রানীর। মেয়েকে সরাসরি না করে দেন তিনি এই সম্পর্কে জড়াতে। অবশ্য শিনা খুব একটা আমলে নেয়নি মায়ের কথার। বারবার বলার পরেও রাহুলের সাথে সম্পর্ক ছেদ করেনি শিনা। একটা সময় কথায় কাজ হচ্ছে না দেখে খুব রেগে যান ইন্দ্রানী। একদিন সামলাতে না পেরে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন মেয়েকে। আর এই কাজ নিয়মিত করতে থাকেন তিনি। বাধ্য হয়ে পরবর্তীতে শিনা ইন্দ্রানীর কাছে ই-মেইল করে নিজের মনের কথা জানিয়ে। মেইলে সে লেখে-

“আমি রাহুলের সাথে খুব সুখী আর নিরাপদ আছি… আমাকে যারা ভালোবাসে তাদের জন্য বা আমার বাবা-মায়ের জন্য এটাই কি যথেষ্ট না?… তুমি জীবনে যা করে আনন্দ পেয়েছ সেটাই করেছ… আমারও সেই খুশিটা প্রাপ্য। তাতে তুমি কেন কষ্ট পাচ্ছ? আমি তোমার মেয়ে। তোমার কিছু ব্যাপার আমার ভেতরেও আছে… আমি আমার রাস্তা বেছে নেব আর ভালোই থাকবো। “

ইন্দ্রানী মুখার্জী; Source: The Week

ইন্দ্রানী অবশ্য এতে থেমে যান নি। ক্রমাগত চেষ্টা করে গিয়েছেন মেয়ে আর রাহুলকে আটকানোর। পিটার মুখার্জী আর রাহুলের কাছে শিনার আসল পরিচয় প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিলো। তারা জেনে গিয়েছিলো শিনা ইন্দ্রানীর মেয়ে। আর কোনো পথ না পেয়ে রাহুল নিজেই বাবাকে জানায় শিনার আসল পরিচয়। তবে প্রথমে সেটা একেবারেই বিশ্বাস করতে চান নি পিটার মুখার্জি। অবশ্য পিটার অনেকটা নিমরাজী ছিলেন এই বিয়েতে। একটা সময় ইন্দ্রানীর চাইতে রাহুল আর শিনা হয়ে পড়েছিলো পিটারের বেশি ঘনিষ্ট। ইন্দ্রানী ভয় পাচ্ছিলেন পিটার তার সব সম্পত্তি শিনা আর রাহুলের নামে লিখে দেবে। শিনার সাথে খুব একটা সময় কাটান নি ইন্দ্রানী। এমনকি প্রথম ঘরের সন্তান হিসেবে শিনা যে তার কাছে খানিকটা অপছন্দের একজন ছিল, নিতান্ত বাধ্য হয়েই যে শিনার দায়িত্ব তাকে নিতে হয়েছিল, সেটা প্রকাশ পেত ইন্দ্রানীর সমস্ত কর্মকান্ডেই।

শিনা বড় মেয়ে হলেও ইন্দ্রানীর টান বেশি ছিল সঞ্জীব খান্নার ঘরে জন্ম নেওয়া তার দ্বিতীয় মেয়ের প্রতি। ভিদেহীকে সম্পত্তির খানিকটা দিতে রাজী ছিলেন ইন্দ্রানী। তাতেও একটু খুঁতখুঁতানি যে ইন্দ্রাণী মুখার্জীর ভেতরে ছিলো না তা না। তবে আর যা-ই হোক, নিজের মেয়ের জন্য হাত থেকে পিটারের সম্পত্তি যেতে দিতে রাজী ছিলেন না তিনি। তাই শিনাকে রাহুলের সাথে মিশতে নিষেধ করেন তিনি। একটা সময় পানি গড়ায় পিটার পর্যন্তও। এতদিন পিটার ব্যাপারটা রাহুলের মাধ্যমে জানতেন। এবার পিটারকে পুরো ব্যাপার আর সেটা নিয়ে ইন্দ্রানীর যে কর্মকান্ড সেসব জানায় শিনা। পিটারকে এসএমএস করে শিনা-

“আমার সাথে ইন্দ্রানী মুখার্জীর সমস্যাটা একেবারেই ব্যক্তিগত। আপনি যেটা করতে পারতেন সেটা হচ্ছে আপনি ইন্দ্রানী মুখার্জীকে বোঝাতে পারতেন যে আমাকে বা রাহুলকে বাজে কথা বলে কোন লাভ হবে না। “

শিনার ডায়রিতে সে লিখে গিয়েছিল মা ইন্দ্রানীকে উদ্দেশ্য করে; Source: India Samvad

তবে কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি। প্রতিনিয়ত তিক্ততা বেড়েই চলেছিল কেবল। এর ভেতরে অবশ্য পিটার ইন্দ্রানীকে কিছুই বলেননি জোরও করেননি। তিনি চেয়েছিলেন, কোনো ঝামেলা না হোক, চেয়েছিলেন শিনা আর রাহুল একে অন্যের সাথে ভালো থাকতে চাইলে সেটাই থাকুক। তবে তাই বলে ইন্দ্রানীকে এসব ব্যাপারে কোনো চাপ দেন নি পিটার মুখার্জী। ইন্দ্রাণীকে ভালোবাসতেন তিনি। তাকে বিশ্বাস করতেন। তাই ভেবেছিলেন, আর যেটাই হোক, ইন্দ্রানী দিনশেষে ছেলে মেয়ের ভালোটাই হয়তো দেখবে। ভুলেও তার সম্পত্তির উপরে ইন্দ্রাণীর কোনোরকম লোভ আছে তা ভাবতে পারেননি পিটার মুখার্জী। ছেলে বা স্ত্রীর কারো ভেতরেই সমস্যা চাচ্ছিলেন না তিনি। তাই পরামর্শ দেন তিনি বাগদানের। রাহুলের সাথে বাগদানের কথা ঘোষণা করে শিনা। আর সাথে সাথে তেলে-বেগুণে জ্বলে ওঠেন ইন্দ্রানী। শিনার সাথে ইন্দ্রানীর সম্পর্ক খুব বাজে মোড় নেয়। মরিয়া হয়ে ওঠেন ইন্দ্রানী। যেকোনো উপায়েই শিনার হাত থেকে সম্পত্তি নিজের করে নেওয়ার চেষ্টা কাজ করে ইন্দ্রানীর ভেতরে। পুরো ব্যাপারটা যখন ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে উঠছে, তখন হুট করেই একদিন উধাও হয়ে যায় শিনা বোরা।

২০১১ সালের ১লা ডিসেম্বর বন্ধ হয়ে যায় শিনার ফেসবুক একাউন্ট। এরপর একটু একটু করে তার মেইল আইডি, ফোন- সবকিছুই বন্ধ হয়ে যায়। রাহুলের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় শিনা। তবে শিনার এমন হারিয়ে যাওয়ার গল্পটাকে ইন্দ্রানী মুখার্জী সবার সামনে উপস্থাপন করেন একেবারেই অন্যরকমভাবে। সবাইকে জানান তিনি, শিনা তার পড়াশোনার কাজে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছে। তবে ইন্দ্রানীর কথা সবাই মেনে নিলেও মানতে চায় নি দুজন- রাহুল আর শিনার ভাই মিখাইল বোরা। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষবার দেখা হয় মিখাইলের শিনার সাথে। এরপর থেকে মিখাইলের সাথেও আর কখনো দেখা হয়নি শিনার। মিখাইলকেও আর সবার মতন শিনার বিদেশে যাওয়ার গল্প শোনান ইন্দ্রানী। সেখানে যে শিনা ভালো আছে, শিনার বিয়ের কথাবার্তা চলছে, সে কাজ করছে- এসব কথা ইন্দ্রানী জানান ছেলেকে। পিটারকে শিনার যুক্তরাষ্ট্রে থাকার ছবিও দেখান তিনি। শিনা সেখানে হোলি খেলছে, নানারকম উৎসব পালন করছে- এমন কিছু ছবি দেখান ইন্দ্রানী। ফলে পিটার তো বটেই, অন্য কারো কোনোরকম সন্দেহই জাগেনি শিনার ব্যাপারে।

এর ভেতরে রাহুল চেষ্টা চালায় শিনার সাথে দেখা করার। শিনার হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার পর এখানে সেখানে খোঁজ শুরু করে রাহুল নিজের বাগদত্তার জন্যে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পিটার আর ইন্দ্রানী দুজনেই রাহুলকে বোঝাচ্ছিলেন শিনাকে ভুলে যেতে। শিনা অন্য কারো জন্য রাহুলকে ছেড়ে গিয়েছে এমনটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন তারা। একটা সময় হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় রাহুল।

শিনা ও রাহুল; Source: zeenews.india.com

এবার যে ঘটনার কথাটি বলা হবে সেটা এই সবকিছুর থেকে একেবারেই আলাদা। অন্তত, পুলিশ কিংবা কারো কাছে একবারের জন্যেও মনে হয়নি যে শিনার উধাও হয়ে যাওয়া আর কোথাও কোনো একটা পোড়া লাশ পাওয়ার ভেতরে কোনোরকম সম্পর্ক থাকতে পারে। ২০১২ সালে রায়গড় জেলায় একটি পোড়া লাশ পাওয়া যায়। সেখানে কেবল লাশের কিছু হাড় পড়ে ছিলো। আশেপাশের মানুষেরা বাজে গন্ধ পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। আর তারপর পুলিশের হাতেই সৎকার হয় লাশের। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, সেসময় লাশের কোনো তথ্যই রাখা হয়নি পুলিশের খাতায়। সত্যিটা হয়তো এভাবেই চাপা পড়ে থাকতো। তবে চার বছর পর পুরনো শিনা বোরাকে নিয়ে কথা ওঠে তখন যখন অস্ত্র সহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে শ্যামভার পিন্টুরাম রায়।

ইন্দ্রানী মুখার্জী (বামে), সঞ্জীব খান্না (মাঝখানে) এবং পিটার মুখার্জী (ডানে); Source: DNA India

অবৈধ অস্ত্র রাখার জন্য পুলিশ অফিসার গনেশ দাল্ভি শ্যামকে আটক করে। থানায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। অস্ত্রের ব্যাপারে সত্যি বলানোর জন্য বেশ পিটুনি খায় গাড়িচালক শ্যাম। মার খেয়ে সব সত্যি বলে দেয় সে। আর সেই সাথে বলে দেয় অনেকদিন আগে একটি খুনের ঘটনায় তার জড়িয়ে থাকার কথাও।  অবশেষে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলায় পুলিশ। খোঁজ মেলে সেই পোড়া লাশের মালিক, চার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া শিনা বোরার।

২০১৫ সালের ২৬ আগস্ট সবার কাছে শিনা যে ইন্দ্রানীর বোন নয়, মেয়ে এই সত্যিটা প্রকাশ করে শিনার ভাই মিখাইল। পুলিশকে আর খুব বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি। শ্যাম নিজেই শিনাকে কোথায় হত্যা করা হয়েছে, সাথে কারা ছিলো আর কোথায় তাকে পোড়ানো হয়েছে সেসব দেখিয়ে দেয়। শ্যাম ইন্দ্রানী আর তার সাবেক স্বামী সঞ্জীব খান্নার নাম জানায় পুলিশকে। তাদের পরিকল্পনা অনুসারেই এমনটা হয়েছে বলে জানায় সে। খুনের আগে ইন্দ্রানী জায়গা খোঁজা শুরু করে। শেষমেশ লাশ ফেলার জন্য একটি পছন্দসই জায়গা খুঁজে পায় সে। ২০১২ সালে নিজের স্বামী সঞ্জীব খান্নাকে মুম্বাইয়ে ডেকে নেয় ইন্দ্রানী। সাবেক স্বামী হওয়া সত্ত্বেও সঞ্জীবের বরাবর টান ছিলো ইন্দ্রানীর প্রতি। সেই সাথে শিনা না থাকলে নিজের মেয়ে ভিদেহীর রাস্তা পরিষ্কার হয় ভেবে ইন্দ্রানীর ডাকে ছুটে আসে সঞ্জীব।

২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল সঞ্জীব খান্না ওরলির হোটেল হিলটপে চেক ইন করেন। শিনাকে মারার জন্য আলাদাভাবে একটি ওপেল কোর্সা ভাড়া করেন ইন্দ্রানী। ঐদিন শিনাকে দেখা করতে বলেন ইন্দ্রানী। নিজেদের ভেতরে থাকা সব ধরনের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলার জন্য দেখা করতে চান তিনি। প্রথমে রাজী না হলেও একটা সময় মায়ের সাথে দেখা করতে রাজী হয়ে যায় শিনা। ২৪ তারিখ বিকেলে দেখা হয় মা-মেয়ের। শিনার সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগে নিজের প্রাক্তন স্বামীর সাথে হোটেলে দেখা করতে যান ইন্দ্রানী। এর এক ঘন্টা পরের কথা। রাহুল শিনাকে বান্দ্রার লিংকিং রোডের ন্যাশনাল কলেজের সামনে নামিয়ে দেয়। ইন্দ্রানী, সঞ্জীব আর শ্যাম গাড়িতে করে তখন দেখা করতে আসে শিনার সাথে। গাড়িতে ইন্দ্রানী সামনের সিটে শ্যামের সাথে বসেছিলেন। পেছনে শিনা আর সঞ্জীব বসেছিলো। বান্দ্রার একটু নির্জন রাস্তায় গাড়ি চলে গেলে সঞ্জীব খান্না গলা টিপে শিনাকে মেরে ফেলে।

তবে গল্পটা এখানেই শেষ হয়নি। শিনার লাশ নিয়ে ওরলির বাড়িতে আসে ইন্দ্রানী। সেখানে শিনার দেহ এক ব্যাগে ভোরে ফেলেন তিনি। তারপর ব্যাগটাকে গাড়ির পেছনের ট্রাংকে রেখে দেন। এই ঘটনার পর সঞ্জীব নিজের হোটেলে ফিরে যায়। ইন্দ্রানী বাসাতেই থাকেন আর শ্যাম লাশের সাথে পুরোটা রাত গাড়িতে কাতায়। ২৫ এপ্রিল খুব ভোরবেলায় রায়গড়ের পেন টেহসিলে অবস্থিত গাগোড় গ্রামে চলে যায় তারা তিনজন। রাস্তায় পুলিশ বা অন্য কারো যাতে করে কোনো সন্দেহ না হয় সেজন্য শিনাকে সানগ্লাস পরিয়ে মাঝের সিটে বসায় তারা। শিনার একপাশে বসে সঞ্জীব আর অন্য পাশে ছিল ইন্দ্রানী। নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে যাওয়ার পর শিনা যে ব্যাগে আছে সেটাকে পেট্রোল দিয়ে ভরে ফেলে ইন্দ্রানী। এরপর আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় ব্যাগে। সেই আগুন জ্বলতে থাকে যতক্ষণ না শিনার শরীরের চিহ্ন মুছে যায়। আগুন থেমে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ইন্দ্রানী, সঞ্জীব আর শ্যাম। মুম্বাই ফিরে আসে তারা। পরদিন কলকাতার দিকে রওনা দেয় সঞ্জীব খান্না।

থানার পথে ইন্দ্রানী মুখার্জী; Source: Scroll.in

২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট ইন্দ্রানী মুখার্জীকে শিনা বোরা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বেশ কিছু চার্জ আসে ইন্দ্রানীর উপরে। ৩০২ (হত্যা), ২০১ (গুম) এবং ৩১ (সন্ত্রাসী কার্যক্রম) ইত্যাদির অভিযোগে পুলিশ কাস্টডিতে নেওয়া হয় তাকে। তবে সবার আগ্রহের কেন্দ্র ছিলো শ্যাম আর ইন্দ্রানী বাদে গাড়িতে থাকা তৃতীয় ব্যাক্তিটি। কে ছিল সে? তখনও পর্যন্ত উত্তরটা ঘোলাটে ছিলো। অনেকে এই হত্যাকে অনার কিলিং বলে মনে করছিলো। রাহুলের সাথে শিনার যাতে বিয়ে না হয় সে কারণেই এমন করেছে ইন্দ্রানী এমনটাই ভাবা হচ্ছিলো। পিটারের সব সম্পত্তি আত্মসাৎ করাকেও এই খুনের অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করছিলেন অনেকে। বিশেষ করে নিজের বড় সন্তান শিনার চাইতে ভিদেহীর প্রতি টান বেশি ছিলো ইন্দ্রানীর। ২০০৫-০৮ সালের এক হিসেব মতে, নিজের টাকার বেশিরভাগ ইন্দ্রানী শিনাকে নয়, দিয়েছিলেন ভিদেহীকে। আর তাই শিনা রাহুলকে বিয়ে করে পিতা মুখার্জীর পুরো সম্পত্তি পাবে সেটা মোটেই মেনে নিতে পারছিলেন না ইন্দ্রানী। তবে কেউ কেউ আবার তৃতীয় ব্যক্তির স্থানে পিটার মুখার্জীকে বসিয়ে ভাবছিলেন, টাকার জন্য শিনাকে খুন করতে ইন্দ্রানীকে সাহায্য করেছিল পিটার।

আইএনএক্স বিক্রির সময় যে টাকা পেয়েছিলেন ইন্দ্রানী ও পিটার, সেগুলো ঝামেলার ভয়ে আত্মীয়-স্বজনের ব্যাংকে ট্রান্সফার করে দেয় তারা। আর এই আত্মীয়দের ভেতরে একজন ছিলো শিনা। মনে করা হচ্ছিলো, এই টাকা নিয়ে ঝামেলা হওয়ার কারণেই ইন্দ্রানী আর পিটার মিলে শিনাকে হত্যা করে। অবশ্য এই সময় বারবার নিজের বাবাকে নির্দোষ বলে দাবি করে রাহুল। রাহুল যে সত্যি বলছে সেটা সিবিআই আর পুলিশের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যখন ২০১৫ সালের ২৬ আগস্ট কলকাতা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সঞ্জীব খান্নাকে। সঞ্জীবের উপরে ছিলও সেকশন ৩৬৪ (কিডন্যাপিং), ৩০২ (হত্যা), ১২০-বি (ষড়যন্ত্র) এবং ২০১ (গুম) এর অভিযোগে। সঞ্জীব নিজের সব অপরাধ স্বীকার করে নেয়। তবে এর ভেতরে ২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে শিনা বোরার নামে টাকা ট্রান্সফার এবং এই হত্যার সাথে যুক্ত থাকার সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয় পিটার মুখার্জিকে।

বর্তমানে ইন্দ্রানী মুখার্জী; Source: Times of India

শিনা বোরা মার্ডার কেসে স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে লড়েন কাভিতা পাতিল এবং ভারাত বাদামি। বাদামি জানান, কেবল শিনাকেই না, তার ভাই মিখাইলকেও মেরে ফেলার পরিকল্পনা ছিলো ইন্দ্রানীর। তবে সেটা সম্ভব হয়নি। মিখাইল সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ইন্দ্রানীর হাত থেকে। ইন্দ্রানী এখনও কারাগারে আছেন।

ফিচার ইমেজ- The Quint

Related Articles

Exit mobile version