১
২০০৫ সাল। ইরাকের নীল আকাশে কালো শকুনের মতোই হানা দিয়েছে মার্কিন বাহিনী, অনেক আগেই পতন হয়েছে সাদ্দাম হোসেনের। আকাশ থেকে নিচের বিশাল বাদামী প্রান্তরের দিকে চোখ ফেরালেই চোখে পড়বে মার্কিন বাহিনীর বিশাল গাড়িবহর। ইরাকে শান্তি আনার মিশনে এসেছে তারা! আপাদমস্তক বুলেটপ্রুফ হেভি আর্মারড গাড়ি থেকে নামল এক সেনা সদস্য, নিজের গায়েও পরা আছে বডি আর্মার; দেহের কয়েকটি জায়গা ছাড়া আর সবকিছুই চাপা পড়েছে তার নিচে। হঠাৎই আকাশ ভেঙে পড়ল যেন তার মাথায়… চারপাশ থেকে ছুটে আসলো সহযোদ্ধারা। স্নাইপারের বুলেটের আঘাতে শিরদাঁড়া ভেঙে পড়ে আছে সৈন্যটি, ‘বাগদাদ স্নাইপার’-এর শেষ শিকার।
২
একজন মার্কিন সৈন্য বাগদাদের এক জনবহুল জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সম্ভবত কোনো বাজার হবে। ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করছে একজন স্পটার, তার সাথে রয়েছে এক স্নাইপার রাইফেলম্যান। অস্ত্রধারী আমেরিকানের পাশে অনেক ইরাকী সাধারণ লোকজন ঘোরাফেরা করায় অস্থির বোধ করছে ক্যামেরা ধরে থাকা ব্যক্তি।
“আশেপাশে প্রচুর লোক। অন্য কোনো জায়গায় খোঁজা শুরু করব?”, প্রশ্ন করল সে।
“না না, আমাকে কিছু সময় দাও”, প্রত্যুত্তরে বললো স্নাইপার রাইফেলধারী।
কিছুক্ষণের বিরতি, তারপর হঠাৎ গুলির শব্দ। অস্ত্রধারী মার্কিন সৈন্য সামনে লুটিয়ে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেল লোকে লোকারণ্য জায়গাটি। শোনা গেল ‘আল্লাহু আকবার’ চিৎকার।
৩
“আমার এই রাইফেলে নয়টি গুলি রয়েছে এবং জর্জ বুশের জন্য আমার কিছু উপহারও রয়েছে। আমি নয়জনকে খুন করতে যাচ্ছি!”
ফুটপাথ ধরে হাঁটছে এক সৈন্য, মুখ থুবড়ে পড়ল সে। হেভি আর্মারড গাড়ি থেকে কিছু একটা বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে একজন, মুখটা গাড়ির ভিতরেই থেকে গেল শেষ নিঃশ্বাস ফেলা পর্যন্ত। গাড়ির উপরে দাঁড়িয়ে বাগদাদের লোকজনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আরেকজন সেনার, সে তখনো জানে না, স্নাইপারের টেলিস্কোপিক সাইটে তাকেই আরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে অন্যকেউ; লুটিয়ে পড়ল সে-ও।
৪
রামাদি, বাগদাদের পশ্চিমাঞ্চলের একটি জায়গার নাম; ইরাকি স্নাইপারদের তৎপরতায় প্রচুর সেনা হারিয়েছে মার্কিন বাহিনী। শেষমেশ বাধ্য হয়েই চার সদস্যের হাই-স্কিলড স্নাইপার দল পাঠানো হলো। তারা যেমন দক্ষ, তেমন অভিজ্ঞ। রাতের অন্ধকারে নাইট ভিশন আর ইনফ্রারেড লেজার দ্বারা সজ্জিত এই চারজনের চোখের সামনে রাতের অন্ধকারে সামান্য নড়াচড়াও মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
ত্রিশ মিনিটের অপেক্ষা, মিশন শেষ করে বাড়ি ফিরে গেল চারজন; তবে লাশ হয়ে, সবার মাথার খুলি ফুটো হয়ে আছে! রাতের রামাদিতে জুবার এসভিডি ড্রাগুনোভের বুলেটের আঘাতে অসাধারণ দক্ষ এক স্নাইপার দলের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই।
তাকে কখনো চোখে দেখা যায়নি। শুধুমাত্র শোনা গেছে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে- ইরাকের মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে আরও অনেক আমেরিকান সৈন্য, কেউ আহত, অনেকেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ফেলেছে। শত্রুর শেষ দেখার জন্য সে আর একই জায়গায় থাকে না, আহত সৈন্যকে সরিয়ে দিতে দ্বিতীয় গুলি করে না। তাকে মেরে ফেলার জন্য আমেরিকান স্নাইপারদেরকে সে কোনো সুযোগই দেয় না- মাত্র একটি গুলিই তার রাইফেলের ব্যারেল থেকে বের হয় এবং তারপর ভোজবাজির মতোই গায়েব হয়ে যায়! তার অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে রেখে দেওয়া হয় ছোট এক টুকরো কাগজ; তাতে লেখা থাকে- “রক্ত দিয়ে যা নেওয়া হয়েছে তা কখনোই ফেরত দেওয়া যায় না -রক্ত ছাড়া…।”
‘জুবা’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া এই মার্কসম্যানকে কোনো মার্কিন সৈন্য দেখেনি, কী তার পরিচয়, তার আসল নাম কিংবা তার জাতীয়তা সম্পর্কেও বিন্দুমাত্র ধারণা নেই কারও। ‘বাগদাদ স্নাইপার’ এর আসল পরিচয় জানা না থাকলেও তার দক্ষতা সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই ধারণা রয়েছে আমেরিকানদের। কারণ মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানেই একই ব্যাটালিয়নের আটজনকে প্রাণ দিতে হয়েছে তার হাতে। নামটাও দেওয়া হয়েছে তার ‘জুবা’, যার মানে হচ্ছে ‘আফ্রিকার যম নৃত্য’। যমের হাত থেকে যেমন রেহাই পাওয়া যায় না, ঠিক সেরকমভাবেই ‘জুবা’র হাত থেকেও নিস্তার পাওয়া কঠিন।
জুবা- বাস্তব না কিংবদন্তী?
“সে অবশ্যই বাস্তব, সে প্রচুর লোককে হত্যা করেছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও সে আমাকে খুন করতে পারবে। আমি হাঁটলেও কিংবা দৌড়ালেও পারবে, এমনকি আমি যদি গাড়িতেও বসে থাকি তবুও!”
এভাবেই মন্তব্য করেছিল মার্কিনীদের হয়ে দুই বছর ধরে কাজ ‘ববি’ ছদ্মনামধারী এক ইরাকি গুপ্তচর।
২০০৫ সালে মার্কিন সৈন্যদের উপর তাণ্ডব চালানোর পর ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় ৫ আগস্ট তারিখের এক রিপোর্টে প্রথম উল্লেখ করা হয় ‘বাগদাদ স্নাইপার’ এর কথা। তারপর একই সালের নভেম্বর মাসে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হয় বুশের উদ্দেশ্যে উপহার দেওয়া সেই বিখ্যাত ভিডিও, যাতে ৯ জন মার্কিন সৈন্যকে হত্যা করার ফুটেজ দেখানো হয়। যদিও সবগুলো ফুটেজ একই ব্যক্তির কিনা, তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
প্রথম ভিডিও ইন্টারনেটে প্রকাশিত হওয়ার বেশ কয়েকদিন পর দক্ষিণ বাগদাদের লোকজনের কাছে সিডি আকারে দ্বিতীয় ভিডিও ছেড়ে দেয় ‘ইসলামিক আর্মি অফ ইরাক’। ভিডিওটিতে দেখা যায় জুবা দেয়ালে ট্যালিতে ৩৭ নম্বর সংখ্যাটি যোগ করছে, তারপর সেটি ডায়েরিতে নোট করে নিচ্ছে। ভিডিওটিতে আরও দেখানো হয়, বেশ কয়েকজন স্নাইপার ট্রেনিংয়ে ব্যস্ত এবং তারা শীঘ্রই মার্কিন সেনাদের উপর বড় ধরনের আঘাত করতে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় ভিডিও প্রকাশ হওয়ার বেশ কয়েক মাস কেটে যাওয়ার পর নতুন কোনো খবর না পাওয়ায় অনেকেই ধারণা করে বসে যে, জুবা নিছকই ছিল কোনো মস্তিষ্কপ্রসূত ঘটনা কিংবা কোনো প্রোপাগান্ডা। এরই মধ্যে মার্কিন সেনারা দু’বার দাবি করে বসে যে, তারা জুবাকে ধরে ফেলেছে এবং তাদের বুলেটের আঘাতে সে মারাও গিয়েছে। ফুটেজে যাকে দেখানো হয়, তার সাথে ভিডিওর জুবার চেহারার বেশ ভালোই মিল রয়েছে। কিন্তু সে কি আসলেই জুবা?
২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাস, নয়টি আলাদা ভাষায় ইন্টারনেটে মুক্তি পায় জুবার তৃতীয় ভিডিও এবং এবারের ভিডিওর কোয়ালিটি আগের দুটোর তুলনায় অনেক ভালো। জুবার কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে আরও দ্রুত, পুরো বিশ্বের মানুষের কাছেই ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। মধ্যপ্রাচ্যে তাকে নিয়ে বের করা হয় কমিক্স, ভিডিও গেম, শর্ট ফিল্ম।
২০০৮ সালে জুবার চতুর্থ ভিডিও বের হওয়ার পর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ২০১৩-১৪ সালের দিকে আইএস দাবি করে বসে তারা জুবাকে হত্যা করেছে, যদিও তার সঠিক কোনো প্রমাণ মেলেনি। জুবা কি আসলেই একজন ব্যক্তি, নাকি অনেকের সংমিশ্রণে তৈরি কোনো পরিচয়, নাকি স্রেফ প্রোপাগান্ডার অংশ- তা সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত নন।
জুবার বাস্তবতা সম্পর্কেও অনেকে যেমন নিশ্চিতভাবে বলেছেন, ঠিক তেমনিভাবে এর বিপরীত বক্তব্যের সংখ্যাও কম নয়। Stars & Stripes এর এক সাক্ষাৎকারে রেজিমেন্ট কমান্ডার ক্যাপ্টেন ব্রেন্ডান হবস তো দাবিই করে বসেছেন, জুবা আমেরিকানরাই তৈরি করেছে এবং তা গুজব বৈ অন্য কিছু নয়।
তবে গুজব হোক আর বাস্তবই হোক, ইউনাইটেড স্টেটস আর্মির অবসরপ্রাপ্ত স্নাইপার প্রশিক্ষক মেজর জন প্লাস্টারের ‘The Ultimate Sniper’ বই থেকে স্নাইপার যোদ্ধা হওয়ার খুঁটিনাটি কৌশল জেনে নেওয়া জুবার দক্ষতা সম্পর্কে কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
এই গ্রিন বেরেট স্নাইপার প্রশিক্ষক নিজেই মন্তব্য করেছেন,
“রাইফেল নিয়ে কী করতে হয়, তা সম্পর্কে তার ধারণা খুব ভালোরকমই রয়েছে এবং প্রতিটি বুলেট ছোঁড়ার আগে তার বিচারশক্তি এবং শৃঙ্খলাও চমৎকার। বিচক্ষণতার সাথে সে তার পালিয়ে যাওয়ার রাস্তাও আগেই তৈরি করে রাখে।”
জুবা সম্পর্কে ইউএস স্নাইপার স্পেশালিস্ট ট্রাভিস বারেসেরও বক্তব্য একইরকম,
“সে এক কথায় অসাধারণ। যখনই আমরা রাস্তায় নামি, তখন আমার মনে হয় জুবার নাম সবার চিন্তার পিছনেই ঘুরপাক খেতে থাকে। সে আমাদের জন্য বেশ বড় ধরনের হুমকি।”
“আমার মনে হয় প্রতিপক্ষের স্নাইপারকে শেষ করে দেওয়া আমাদের স্নাইপারদেরই দায়িত্ব এবং হয়তো তাকে খতম করতে আমাদের দলের সব স্নাইপারকে প্রয়োজন হবে!”
শেষ করা যাক অ্যালেক্স হরটন নামক এক মার্কিন সৈন্যের বক্তব্য দিয়েই।
“আমেরিকান সৈন্যদের কাছে জুবা স্রেফ একজন আতঙ্ক। কিন্তু বিদ্রোহীদের কাছে? নায়কের চেয়ে একবিন্দু কম হবে না।”
ফিচার ইমেজ- Wallpaper Safari