পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে অদ্ভুত সব ঘটনা। সেসব ঘটনার কিছু যেমন অবাক করা আর আনন্দদায়ক, তেমনি আবার কিছু ঘটনা রয়েছে বেশ মর্মান্তিক। এমনই কয়েকটি ঘটনা নিয়ে সাজানো আজকের এই আয়োজন।
গিয়ামানা, রোমানিয়া: শিল্পকারখানার বর্জ্যে তলিয়ে যাওয়া এক শহর
রোমানিয়ার একটি ছোট শহর গিয়ামানা। শহরের কাছেই ছিল মোহনীয় এক বিশাল লেক। চারদিকে সবুজের সমারোহ। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন রোমানিয়ার কমিউনিস্ট সরকার তামা উৎপাদনের জন্য এখানে একটি কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষ্যে পুরো শহর সরকার অধিগ্রহণ করে। এলাকা খালি করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পরিবার প্রতি ১,৫০০ ইউরো করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়।
সেসময় ঐ শহরে বসবাসকারী ৩০০ পরিবার সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যায়। যদিও কয়েকটি পরিবার সেখানে থেকে গিয়েছিল। কারখানার কাজ শুরু হলে তারা লেকের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছেড়ে আরও উঁচুতে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে।
কয়েক বছরের মধ্যেই কারখানাটি পুরোদমে তামা উৎপাদন শুরু করে। এর বেশ কিছুদিন পরেই দেখা যেতে লাগলো, কারখানার বর্জ্যে শহরের চারপাশ এবং শহরের দৃষ্টিনন্দন লেকটি ভরে গেছে।
লেকের বর্জ্যে তলিয়ে যেতে লাগে পুরো শহরটি। স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, প্রতি বছর ১১,০০০ টন তামা উৎপাদিত হয়, যার কারণে ৩ মিটার করে বাড়ছে বর্জ্যে ঢাকা লেকটি। আর এভাবে ৪ দশকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে ছোট শহরটি।
দ্য পারথেনন অফ বুকস, জার্মানি: নিষিদ্ধ বই দিয়ে তৈরি এক স্থাপত্য
গ্রিসের ঐতিহ্যবাহী মন্দির পারথেনন সম্পর্কে আমরা সকলেই কম-বেশি জানি। অপূর্ব সেই স্থাপনাটি মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। সেই পারথেনন স্থাপত্যের অনুকরণে জার্মানির ‘ইউনিভার্সিটি টাউন’ নামে খ্যাত ক্যাসেলে নির্মাণ করা হয় ‘দ্য পারথেনন অফ বুকস’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হওয়া প্রায় ১ লাখ বই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই স্থাপত্যটি।
এই স্থাপত্যটি যে স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে ১৯৩৩ সালে নাৎসি বাহিনী প্রচুর পরিমাণে বই পুড়িয়েছিল। সেই বইগুলোর লেখকদের বেশিরভাগই ছিলেন ইহুদি, নয়তো কম্যুনিজমে বিশ্বাসী।
আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সমসাময়িক চিত্রশিল্পী ৭৪ বছরের মার্তা মিনুজিন এই স্থাপত্যটির নকশা তৈরি করেন। নিষিদ্ধ বইয়ের এই স্থাপত্যটির আয়তন আর গ্রিসের দেবী অ্যাথেনার উদ্দেশ্যে নির্মিত মন্দির পারথেননের আয়তন হুবহু একই। অর্থাৎ, লম্বায় ৭০ মিটার, চওড়ায় ৩১ মিটার ও উচ্চতায় ১০ মিটার।
‘দ্য পারথেনন অফ বুকস’ স্থাপত্যটি নির্মাণে ক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ জন শিক্ষার্থী দিন-রাত পরিশ্রম করে প্রায় ৭০,০০০ নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকা তৈরি করেন, যার থেকে বেছে নেয়া হয় ১৭০টি শিরোনাম।
২০১৭ সালের জার্মানির ইউনিভার্সিটি টাউনে আয়োজিত ‘ডকুমেন্টা’ নামে কনটেম্পোরারি আর্ট শোতে এই স্থাপত্যটি প্রদর্শিত হয়, যা আগত দর্শকদের নজর কেড়ে নেয়। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর এই কনটেম্পোরারি আর্ট শোটি জার্মানির এই স্থানে আয়োজিত হয়ে থাকে।
এ ধরনের স্থাপত্য নির্মাণের কারণ সম্পর্কে শিল্পী মার্তা মিনুজিন জানান, তিনি সবধরনের সেন্সরশিপের বিপক্ষে। তার এই স্থাপত্য নির্মাণের মধ্য দিয়ে সব রকম ‘সেন্সরশিপ’ তুলে নেওয়ার আর্জি জানান শিল্পী।
শহর সানমেক্সিয়া, চিন: মাটির তলায় আস্ত এক গ্রাম
চিনের হেনান প্রদেশের কাছে সানমেক্সিয়া শহরের কাছেই অবস্থিত এক রহস্যময় গ্রাম। গ্রামটির সব বাড়িই রয়েছে মাটির তলায়। প্রায় ২০০ বছর ধরে ঐ গ্রামের বাসিন্দারা ঐভাবেই বাড়ি তৈরি করে বসবাস করে আসছে। অনুমান করা হয়ে থাকে, কিঙ এবং মিঙ রাজত্বকালে এ ধরনের বাড়িঘরে বসবাস করার চল শুরু হয়।
সাধারণত এসব এলাকায় শীতকালের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকে এবং গরমে তা ২০ ডিগ্রির উপরে উঠে যায়। এই গুহা বাড়িগুলো গরমকালের শীতল রাখতে এবং শীতকালে উষ্ণ রাখতে সহায়তা করে। স্থানীয়দের অভিমত, বাড়িগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধী এবং শব্দরোধী। প্রত্যেক বাড়িতে আলাদা বাথরুম, ড্রয়িংরুম ও বেডরুমের ব্যবস্থা রয়েছে। রান্নাঘর এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে উনুনের তাপ বাইরে বের হয়ে যেতে পারে।
প্রত্যেক বাড়ির সাথে অত্যাধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা রয়েছে। গৃহপালিত পশুদের জন্য বাড়িগুলোতে আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। এভাবে মাটির নিচে প্রায় দশ হাজারের ওপর ঘর রয়েছে, যাতে বাস করে প্রায় তিন হাজারেরও অধিক মানুষ। এ ধরনের মাটির নিচের ঘরগুলোকে স্থানীয়রা বলে থাকেন ‘ইয়ায়োডং’। বাড়িগুলোর উচ্চতা প্রায় ৭ মিটার।
চারকোনা এই গুহা বাড়িগুলোতে বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে, যেখানে বর্তমান সময়ের সবরকম আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জানা যায়, ঐ গ্রামের বাসিন্দাদের বেশ কয়েক প্রজন্ম এভাবেই সেখানে বসবাস করে আসছে। ধারণা করা হয়, প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকে চীনের পার্বত্য এলাকাগুলোতে এ ধরনের গুহা বাড়ি নির্মাণ করা হতো। বাড়িগুলোর উপরের আশেপাশের জায়গাগুলো চাষের কাজে ব্যবহার করা হতো।
বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসন পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্যএই বাড়িগুলো সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পর্যটকদের জন্য এখানে থাকার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। মাসে ২১ ইউরো ভাড়ায় পাওয়া যায় ঘরগুলো। আর কেউ যদি বাড়িগুলো কিনতে চান, তার জন্য গুনতে হবে ৩২,০০০ ইউরো।
মরক্কোর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল: ছাগল গাছে চড়ে বেড়ায় যেখানে
আফ্রিকার একটি দেশ মরক্কো। এর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঘটে চলেছে এক আশ্চর্য ঘটনা। এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা গৃহপালিত পশু হিসেবে ছাগল পালন করে থাকে। সাধারণত এসব গৃহপালিত ছাগল মাঠে-ময়দানে জন্মানো ঘাস, লতাপাতা খেতেই অভ্যস্ত। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে এই অঞ্চলের মাঠে-ময়দানে কোথাও ঘাসের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এ সময়টায় খাবারের জন্য তাদেরকে সাহায্য নিতে হয় আরগান নামের এক বৃক্ষের।
মরক্কোর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক বিশাল উপত্যকা জুড়ে এই আরগান নামের বন্য গাছটি জন্মাতে দেখা যায়। সারা গায়ে কাঁটাযুক্ত এই গাছের রসালো ও সুস্বাদু ফল পশু-পাখির প্রিয় খাদ্য। সে কারণে গৃহপালিত ছাগলগুলো এই গাছের পাতা ও ফল খাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, এ গাছের পাতা ও ফল খাওয়ার জন্য তাদেরকে চড়তে হয় গাছে।
কিন্তু এসব ছাগলের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হলো এই গাছে চড়া? স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, মরক্কোর এই অঞ্চলের ছাগলগুলো গাছে চড়ার বিদ্যাটি শিখতে পেরেছে স্থানীয় শিশুদের গাছে চড়া দেখে। এক্ষেত্রে তাদের মালিকেরাও তাদের শিখতে সাহায্য করেছে।
আরগান গাছের গায়ে বেশ কাঁটা রয়েছে। ছাগলের পাল খুব সহজেই পায়ের ধারালো খুর ব্যবহার করে গাছে উঠে যেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এভাবে তারা হালকা মগডালে পর্যন্ত উঠে পড়ে। একই পদ্ধতি ব্যবহার করে গাছ থেকে নিরাপদে নেমেও আসে।
শরৎকালে এখানকার মাঠে-ময়দানে পশুদের খাবারের অভাব দেখা দেয়, তখন ছাগলগুলো দিনের অধিকাংশ সময় গাছে চড়েই অতিবাহিত করে। আর প্রকৃতিবিদরা এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন অনেক উপকারিতা। আরগান গাছে যে ফল হয়, তার বীজ প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা ও পুরু। ফল খাওয়ার সময় এত বড় বীজ ছাগলের পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয় না। ছাগল যখন জাবর কাটে, তখন বড় বীজগুলো তারা ফেলে দেয়।
আবার অনেক সময় ছাগলগুলো মূল গাছ থেকে অনেক দূরেও বীজ ফেলে দেয়। এর মধ্য দিয়ে আরগান গাছের বংশবৃদ্ধি দ্রুত ঘটতে থাকে। কাজেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেই হোক, গাছের বংশবৃদ্ধিতে ছাগলের ভূমিকা রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। স্থানীয়রা এই বীজ সংগ্রহ করে এবং তার থেকে তেল উৎপাদন করে। আরগান ফলের বীজ থেকে উৎপাদিত তেল বিদেশের বাজারে রপ্তানিও করা হয় ।
ফিচার ইমেজ: designboom.com