কোনো জনগোষ্ঠীর প্রথা বা সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলা বেশ স্পর্শকাতর ব্যাপার, কেননা আমাদের কাছে যা উত্তম, তা অন্য কারো কাছে কাছে অধম হতে পারে; আবার আমাদের কাছে যা অধম, তা অন্য কারো কাছে উত্তমও হতে পারে। তবুও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এখনো এমন সব কুপ্রথা ও অমানবিক রীতিনীতি চালু আছে যা সর্বজননিন্দীত। আর এমনই এক বর্বর প্রথা চালু আছে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ার কয়েকটি অঞ্চলে, যেখানে ‘মানি ওয়াইফ’ বা অর্থের বিনিময়ে অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়েদের স্ত্রী হিসেবে কিনতে পাওয়া যায়!
বিশেষত দেশটির ক্রস রিভার রাজ্যের অবানলিকু অঞ্চলের বিসিভ গ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। উক্ত সম্প্রদায়ের নাম অনুসারে তাদের গ্রামের নামও বিসিভ দেয়া হয়েছে। প্রাদেশিক রাজধানী ক্যালাবার থেকে সড়কপথে সেখানে যেতে প্রায় আট ঘন্টা সময় লাগে। সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাদের ‘মানি ওয়াইফ’ বা ‘স্ত্রী ক্রয়’ প্রথার কথা প্রকাশিত হলে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে।
অবুধা পর্বতের ছায়াতলে বেড়ে ওঠা এই গ্রামকে বলা হতো ঘুমন্ত গ্রাম। কিন্তু সেখানেই যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে এমন মর্মান্তিক দাসত্ব প্রথা। যেখানে কন্যাদের মাত্র ৫-৬ বছর বয়সে তাদের পিতা-মাতারা বয়জ্যেষ্ঠ কোনো পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। মানবাধিকার কর্মীরা জানিয়েছেন, শুধুমাত্র টাকা-পয়সার লোভে পিতা-মাতারা তাদের সন্তানদেরকে এমন অন্ধকার পথে ঠেলে দিচ্ছেন। যদিও আদিবাসী নেতারা বিষয়টি এখন আর চালু নেই মর্মে দাবি করছেন, কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে, স্বয়ং গোত্রপতিরাই এখনও একাধিক অপ্রাপ্তবয়স্কা স্ত্রী গ্রহণ করে বসে আছেন।
পাঁচ বছর বয়সী মিরাকেলের ‘মানি ম্যারিজ’ সম্পন্ন হয়েছিল কিছুদিন আগে। বিয়ের পর তার উপর স্বামীর পৈশাচিক যৌন নির্যাতন নেমে এসেছিল। কিন্তু তার সৌভাগ্য; স্থানীয় একটি মিশনারি সংস্থার সহায়তায় তিনি তার স্বামীর হাত থেকে মুক্ত হতে পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি একটি মিশনারি সংস্থার সাথে বসবাস করছেন। তিনি বলেন,
আমি নিজেই একজন জ্বলন্ত প্রমাণ যে, এখনো ‘মানি ম্যারেজ’ চালু আছে।
মিরাকেলের বিয়ের ঘটনাটি অনেক বেশি মর্মান্তিক। কেননা তার বড় বোনকেও সেই লোক স্বল্প বয়সে টাকার বিনিময়ে বিয়ে করেছিল। মিরাকেলের বিয়ের পর সেই বোনকে তালাক দিয়ে দেয় তার স্বামী। অর্থাৎ তাকে তার বড় বোনের সাথে ‘পরিবর্তন’ করে মাত্র। এক্ষেত্রে সেই স্বামীর অজুহাত, মিরাকেলের বড় বোন সন্তান উৎপাদনে অক্ষম, তাই মিরাকেলের পিতা-মাতাই তাকে তার বড় বোনের স্বামীর হাতে তুলে দেন।
এরকম আরেক দুর্ভাগা যুবতীর নাম রোজ ইনিয়েতি। যদিও তিনি নয় বছর আগে তার কথিত ‘মানি হাজবেন্ডের’ হাত থেকে উদ্ধার হয়েছিলেন। তিনি বলেন,
আমার বয়স যখন মাত্র ৭ বছর, তখন আমার বাবা মারা যান। এরপর আমার বয়স ১০ বছরে উপনীত হলে আমার মা আমাকে টাকার বিনিময়ে বিয়ে দেন। পরবর্তীতে একটি মিশনারি সংস্থা আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে।
আরেক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসব মেয়েরা বিয়ের পর প্রায় সকল প্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। কেননা তাদের বাজারে পণ্য বেচা-কেনার মতো করে বিনিময় করা হয়; অনেক সময় পুরস্কার হিসেবে আদান-প্রদান করা হয়। এমনই এক ঘটনা ঘটেছে আদিবাসী তরুনী ডরথির জীবনে। ডরথি জানান, পিতা-মাতা ও স্থানীয় লোকজন মিলে তাকে একজন পুরুষের কাছে তুলে দিয়েছিল। সেই লোক তাকে ঘুমানো ব্যতীত আর কোনো কাজে লাগাতো না। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলেন। সেই দুর্বিষহ স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন,
লোকটি বললো, সে আমার সাথে ঘুমাবে। কিন্তু আমি বললাম, সম্ভব নয়। কেননা তার সন্তানরাও আমার থেকে বয়সে বড়। এ কথা বললে সে আরও লোকজন লোক জড়ো করলো এবং আমাকে তার সাথে ঘুমাতে বাধ্য করলো।
ডরথি আরও বলেন,
তিনজন পুরুষ ও একজন নারী আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে সেই লোকটির সাথে শুইয়ে দেয়। আমি সেই রাতেই গর্ভবতী হয়ে পড়ি। তখন আমার বয়স ১২ বছরও অতিক্রম করেনি। এই বয়সে গর্ভবতী হওয়া যেকোনো নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
ডরথি-মিরাকেলের মতো আরও অসংখ্য নারীর জীবনের গল্পটা এমন নির্মম। একই ঘটনা ঘটেছে হ্যাপিনেসের জীবনেও। তার বয়স যখন মাত্র ১৪ বছর, তখন তাকে অর্থের বিনিময়ে পা ফিলিপস নামের একজন পুরুষের সাথে বিয়ে দেয় হয়। কিন্তু বিয়ের পর তার উপরে নেমে আসে অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। তাকে একটি ঘরে বন্দি করে রাখা হয় এবং সেখানে তার ওপর নিয়মিত যৌন নির্যাতন চালানো হয়। হ্যাপিনেস সেই স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন,
লোকটি ছিল বয়সে বৃদ্ধ। তার সন্তান, এমনকি নাতী-নাতনীরাও সন্তান প্রসব করেছে। … আমাকে নিয়মিত পেটাতো। একদিন সে আমাকে হুমকি দিয়ে বললো, সে যদি আমাকে হত্যাও করে ফেলে, তবে কেউ টু শব্দ পর্যন্ত করবে না; কেননা আমি তার কেনা ‘মানি ওয়াইফ’।
হ্যাপিনেস নিজেই জানালেন কীভাবে এই নির্মম স্ত্রী কেনা-বেচা কার্যক্রম সম্পাদিত হয়। যখন কোনো পুরুষের স্ত্রীর প্রয়োজন হয়, তখন তিনি কন্যাদের ঘরে যান এবং সেখান থেকে যাকে পছন্দ হয়ে তাকেই কিনে নিয়ে আসতে পারেন। হ্যাপিনেস বলেন,
তখন পিতা-মাতা তাদের কন্যাদেরকে ক্রেতার সামনে হাজির করেন। ক্রেতা যদি দেখেন যে, কারো বয়স ৬ থেকে ১০ হয়েছে, তবে তাকে ক্রয়ের উপযুক্ত মনে করেন। অর্থাৎ ঐ কন্যার বিয়ের বয়স হয়েছে এবং সে রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সকল প্রকার কাজের উপযুক্ত।
পাস্টর আকোনাম রিচার্ড একজন শিশু অধিকার কর্মী। তিনি অনেক দিন যাবত বিসিভ আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিক্রিত কন্যাদের উদ্ধার কাজের সাথে যুক্ত আছেন। তিনি উল্লেখ করেন, দীর্ঘদিনের প্রথা অনুসারে ‘মানি ম্যারেজ’ বিসিভ পুরুষদের আত্মমর্যাদার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এতে পুরুষদের ক্ষমতা সর্বময় ও সর্বাত্মক। ক্রয়ের পর একজন মেয়ের সাথে তারা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। তিনি বলেন,
এটি বিসিভদের দীর্ঘদিনের প্রথা। এর মধ্য দিয়ে একজন ক্রেতা উক্ত কন্যা সন্তানের মালিকে পরিণত হন। একজন পুরুষ চাইলে তার নিজ কন্যাকে অপর পুরুষের কাছে সহজেই বিক্রি করে দিতে পারেন। এতে তাকে কারো কাছ থেকে কোনো ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না।
অর্থাৎ মানি ওয়াইফগণ পুরুষদের ‘পরম সম্পত্তিতে’ পরিণত হন। তাদেরকে কখনো স্কুলে যেতে দেয়া হয় না। তাদের প্রধান কাজ কথিত স্বামীর প্রশ্নাতীত আনুগত্য প্রকাশ করা। আকোনাম রিচার্ড বলেন,
অনেক স্বামী স্ত্রীদেরকে শিশুশ্রমে নিযুক্ত করেন। কেউ কেউ আবার তাদেরকে মাদক ও অন্যান্য অন্ধকার পথে হাঁটতে বাধ্য করেন। অনেক সময় তাদেরকে ‘পাইমড’ (মাদক বহনকারী) হিসেবে ব্যবহার করেন। এবং প্রায়শই তারা মাদক ব্যবসায়ীদের মনোরঞ্জনের বস্তুতে পরিণত হন। যদি তারা সেখান থেকে গর্ভবতী হয়েও ঘরে ফেরেন, তবুও স্বামীর জন্য তা গর্বের ব্যাপার; কেননা তাদের যেকোনো মূল্যে টাকা দরকার।
কিন্তু বিসিভ সম্প্রদায়ের গোত্রপ্রধানগণ এ অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেন। তাদের দাবি, নব্বই দশকের শুরুর দিকে এ প্রথা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনোমাটোপি সানডে ইচাইল নামের এক গোত্রপ্রধান বলেন,
এখন আর এই প্রথার কোনো অস্তিত্ব নেই। একসময় এটি প্রচলিত ছিল, কিন্তু ‘৯০ সালের দিকে তা বন্ধ হয়ে গেছে। আর বিষয়টি এমন নয় যে, কোনো পুরুষের ইচ্ছা হলো, আর সে এসে বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে শুরু করলো। বরং বিষয়টি ছিল এমন- যদি কারো স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে, তবে সে আরেকটি বিয়ে করতে পারতো। আর অর্থের বিষয়টি ছিল ঋণ দেয়া-নেয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন। উপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে যে, সেখানে এখনো টাকার বিনিময়ে বিয়ের প্রথা চালু আছে। আকোনাম রিচার্ড জানান, কিছুদিন আগেও তারা একাধিক মেয়েকে উদ্ধার করেছেন। তবে গণমাধ্যমের কল্যাণে ও মিশনারিদের তৎপরতায় বিসিভ আদিবাসীদের মধ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এই নির্মম প্রথা বন্ধ হবে বলে আশা করাই যায়।