২ অক্টোবর এআইবির ইউটিউব চ্যানেলে এসেছিলো নতুন প্রোমো। হটস্টারে আসতে চলেছে ‘অন এয়ার উইথ এআইবি’র তৃতীয় মৌসুম। অথচ ৮ দিনের মাথায় হটস্টার তাদের অনলাইন স্ট্রিমিংয়ে এআইবির পর্বসমূহ বন্ধের ঘোষণা দিলো। ‘ছুটি’তে পাঠানো হয়েছে কমেডিয়ান গুরসিমরান খাম্বাকে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠাতা-কমেডিয়ান তন্ময় ভাটও অনির্দিষ্টকালের জন্য এআইবি থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। তবে কি শেষ হতে চললো তর্কযোগ্যভাবে উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় বা সেরা কমেডি গ্রুপের বর্ণময় যাত্রা?
এক হ্যাশট্যাগ ‘#metoo’ আন্দোলনেই জেরবার অল ইন্ডিয়া বাকচোদ বা এআইবি। সামাজিক মাধ্যমের এই হ্যাশট্যাগ আন্দোলন হলিউডের কল্যাণে বিশ্বজুড়ে আগেই জনপ্রিয় হলেও ভারতে যেন ঝাপটা এসে লাগলো খুব সম্প্রতি। অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত কর্তৃক বলিউড তারকা নানা পাটেকর ও অন্নু কাপুরের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগেই যেন ভারতে নতুন করে দানা বাঁধে এ আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। টুইটার, ফেসবুকে একের পর এক নারী সরব হওয়ায় উঠে আসছে একের পর এক অভিযুক্তের নাম। সেই ধারায় বিতর্কের কালি এবার লাগলো এআইবির গায়ে।
এআইবির অনেকগুলো ভিডিওতে ইতোপূর্বে অভিনয় করতে দেখা গেছে কৌতুকাভিনেতা উৎসব চক্রবর্তীকে। ৪ অক্টোবর আকস্মিকভাবে টুইটারে ভাইরাল হতে থাকে তার বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির বেশ কিছু অভিযোগ। একই দিন ২৬ টুইটের এক থ্রেডে উৎসব অভিযোগসমূহ স্বীকার করে নেন। ঐদিনই এক বিবৃতি দিয়ে এআইবি তাদের চ্যানেল থেকে উৎসব অভিনীত সব ভিডিও সরিয়ে নেবার ঘোষণাও দেয়। কিন্তু তাতেও পিছু ছাড়েনি বিতর্ক।
চাউর হয়, নিয়োগের সময়ই উৎসবের কাজ সম্পর্কে ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল ছিলো এআইবি, কিন্তু জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তারা। একদিন বাদে, অর্থাৎ ৫ অক্টোবর এই অভিযোগের ব্যাপারে এআইবির পক্ষ থেকে আসে আনুষ্ঠানিক জবাবদিহিতা, যাতে প্রকারান্তে মেনে নেওয়া হয় অভিযোগ। বিবৃতিতে বলা হয়, উৎসবকে নিয়ে কাজ শুরুর পরই তন্ময়ের কানে অভিযোগ আসে, এক নারীর কাছে বিনা উসকানিতে নিজের অশ্লীল ছবি পাঠিয়েছেন উৎসব। তবে অভিযোগকারী আইনী ব্যবস্থা নিতে ইচ্ছুক ছিলেন না বিধায় তন্ময় ভাট একে ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ জ্ঞান করে বেশি দূর আর তলিয়ে দেখেননি।
উল্লেখ্য, প্রায় দেড় বছর আগেই এআইবির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে উৎসবের। কিন্তু অভিযোগ ছিলো আরো পুরনো। তন্ময় ভাট সেসব জেনেও ত্বরিত ব্যবস্থা না নিয়ে বেশ কিছুদিন উৎসবকে নিয়ে কাজ করা অব্যহত রাখেন। এমনকি ব্যক্তিগতভাবে নানা জায়গায় উৎসবের পক্ষে সাফাইও গান। একেই এআইবি তাদের ‘সবচেয়ে বড় ভুল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তাদের উপলব্ধি, “আমরা আরেকটু শক্ত হতে পারতাম”। ব্যক্তিগত বিবৃতিতেও সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন তন্ময় ভাট।
ওদিকে অব্যবহিত পরেই সহ-প্রতিষ্ঠাতা গুরসিমরান খাম্বার বিরুদ্ধেও আসে অভিযোগ। টুইটারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারীর বরাত দিয়ে এক সাংবাদিক লেখেন, ২০১৫ সালের শেষ দিকে সেই নারীর সাথে জোরপূর্বক ঘনিষ্ঠ হতেন গুরসিমরান। উল্লেখ্য, তখন তারা কেবলই বন্ধু ছিলেন এবং সেই নারীও অন্য একটি প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন। বাধ্য হয়ে মেয়েটিই গুরসিমরানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
গুরসিমরান অবশ্য অভিযোগকারী নারীর সাথে তার বন্ধুত্বের কথা এবং একটা সময় দুর্বল হয়ে পড়ার কথা স্বীকার করেছেন। এমনকি মেয়েটি অন্য সম্পর্কে যাবার পর ক্রোধান্বিত হয়ে তার সাথে বাজে ব্যবহার করেছেন বলেও জানান গুরসিমরান। তবে তার সম্মতির তোয়াক্কা না করে ঘনিষ্ঠ হয়েছেন, এমন অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। তার মতে, “সম্মতির বাইরে কিছুই হয়নি”। উল্টো গুরসিমরানের দাবি, বর্তমান স্ত্রীর সাথে সম্পর্কে যাবার সময় ঐ মেয়েটিই বরং তার সাথে আবার যোগাযোগ শুরু করতে চেয়েছিলো।
গুরসিমরান অভিযোগ স্বীকার না করলেও এআইবির পক্ষ থেকে ৮ অক্টোবর আসে এক বিবৃতি। সেখানে জানানো হয়, ছুটিতে পাঠানো হয়েছে গুরসিমরানকে এবং অভিযোগের ব্যাপারে স্বচ্ছতা না আসা অবধি বলবত থাকছে এ সিদ্ধান্ত! অন্যদিকে একই দিনে এআইবির তরফ থেকে জানানো হয়, পরবর্তী নোটিশ না আসা পর্যন্ত তন্ময় ভাট নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন এআইবি থেকে। সুতরাং এআইবির দৈনন্দিন কার্যক্রমে অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদের প্রধান নির্বাহীই থাকবেন অনুপস্থিত।
নিজেদের বিখ্যাত ‘অনেস্ট’ সিরিজের নানা পর্বে বিভিন্ন স্টেরিওটাইপিং নিয়ে কটাক্ষ করবার ফাঁকে সমাজের নানা পুরুষতান্ত্রিক ও নারীবিদ্বেষী আচরণকে একহাত নিয়েছিলো এআইবি। বানিয়েছে ‘ভ্যাজাইনা সং’ নামে এক প্যারোডি গান, যেখানে নারী চরিত্র ও দেহকে ‘শোপিস/আইটেম’ ভাবার বলিউডি প্রবণতা নিয়ে বেদম উপহাস করেছে তারা। এখানে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন বলিউডেরই আরেক ‘ঠোঁটকাটা’ অভিনেত্রী কঙ্গনা রনৌত। এর বাইরেও নানা বক্তব্যে, স্ট্যান্ড-আপ কমেডিতে এ গ্রুপের সদস্যরা নিজেদের বেশ একটা ‘নারীবাদ সমর্থক’ পরিচয় দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। অথচ এই এআইবিই কি না আজ যুঝছে যৌন কেলেঙ্কারিতে!
উপর্যুক্ত বিবরণে ইতোমধ্যে পাঠক বুঝেই গেছেন, এআইবির বর্তমান দুর্গতি ডেকে আনবার মূল নায়ক কে। এই উৎসব চক্রবর্তীই বা কী এমন করেছিলেন? কী এমন ঘটলো, যাতে হুট করে সব জারিজুরি ফাঁস হলো? জানতে হলে একটু পেছন ফিরতে হবে।
ঘটনার শুরুটা এক মাস আগে। ৬ সেপ্টেম্বর সিডনি থেকে ছেড়ে যায় অস্ট্রেলীয় ‘রয়েল ক্যারিবিয়ান ক্রুজ’ কোম্পানির প্রমোদতরী ‘ভয়েজার অব দ্য সীজ’। সেখানে উঠেছিলেন ভারতীয় গুটখা (তামাকজাত চর্ব্য) প্রস্তুতকারক ব্র্যান্ড ‘কমলা পসন্দ’ এর প্রায় ১,৩০০ ভারতীয় পুরুষ কর্মী। স্বল্পবসনা নর্তকী ও পানাহার সামগ্রী নিয়ে গোটা জাহাজের দখলটাই যেন নিয়ে ফেলেছিলেন তারা। জাহাজের অন্য যাত্রীরা রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন তাদের বাড়াবাড়িতে। অনেকে আবার শারীরিক নিগ্রহেরও শিকার হয়েছিলেন। সব মিলিয়ে এ ঘটনায় জাহাজ কর্তৃপক্ষ কেবল বিব্রতই ছিলো না, বরং যাত্রীদের চুকিয়েছে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ।
দেশে বসে সচেতন ভারতীয়রাও কম বিব্রত হননি এ ঘটনায়। উৎসব চক্রবর্তীও হয়েছিলেন। সেটিই কাল হয়েছে তার। উক্ত ঘটনার সংবাদ সম্বলিত একটি লিংক টুইটারে সমালোচনামূলক ক্যাপশনে পোস্ট করেছিলেন তিনি। ব্যস, সেখানেই ঘটে যায় তুলকালাম।
জনৈক নারী টুইটার্যাটি (টুইটার ব্যবহারকারী) উৎসবকে রিটুইট যা বলেন, তার ভাবার্থ দাঁড়ায় এমন:
তারা অন্তত তোমার মতো না চাওয়া সত্ত্বেও মেয়েদেরকে পুরুষাঙ্গের ছবি দেয়নি, কিংবা ক্যারিয়ার ধ্বংস হওয়ার ভয়ে সেসব ফাঁস না করতে কেঁদেকেটে অনুরোধও করেনি।
এর পর টুইটারপাড়ায় সাড়া পড়ে যায়। মহিমা কুকরেজা নামের ঐ টুইটার্যাটির থ্রেডে ও ইনবক্সে অনেকেই উৎসবের বিরুদ্ধে যৌন অভব্যতার অভিযোগ আনেন। এর মধ্যে একটি অভিযোগ ছিলো অপ্রাপ্তবয়স্ক একজনের কাছে নগ্ন ছবি চাওয়া।
টুইটারেই গত ৪ অক্টোবর খুচরো খুচরো সব অভিযোগের ব্যাপারেই মুখ খুলেছেন উৎসব। সবগুলো ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেছেন তিনি। অনেকের কাছে নগ্ন ছবি চাওয়ার ব্যাপারে স্বীকারোক্তি দিলেও অপ্রাপ্তবয়স্ক কারো কাছে তিনি এমন কিছু বলেননি বলে দাবি তার।
দায় স্বীকারের সেই টুইটগুলোতে উৎসব বলেন, তিনি শুধুই মাথায় যা এসেছে, তা-ই দুম করে বলে দিয়েছেন; মোবাইলের অন্য পাশের জন কী ভাবছেন, তার তোয়াক্কা করেননি। স্ন্যাপচ্যাটে কতিপয় মেয়েবন্ধু কর্তৃক নগ্নছবি পেতে পেতে তিনি নাকি একে বিকৃতরুচি চরিতার্থের অব্যর্থ জায়গাই ভেবে বসেছিলেন! নিজের ভুলোমনও নাকি যার-তার সাথে যৌনালাপ করতে চাওয়ার স্বভাবের জন্য দায়ী।
দোষ স্বীকার করেও ওদিকে যেন পার পাচ্ছেন না উৎসব। দায় স্বীকারের পাদটীকা হিসেবে বারবার নিজের অসুস্থতা ও চিকিৎসার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন তিনি। অনেকের মতে, এসবের দ্বারা উৎসব সহানুভূতি পাবার বৃথা চেষ্টা করছে । উৎসবের বর্তমান টুইটার আইডিটির পূর্বনাম ছিলো ‘স্যাটান ভগত’। এখানে জনপ্রিয় একজন ভারতীয় লেখককে নিয়ে খিল্লি করতেন তিনি। সেই সঙ্গে মজা করতেন দুর্বল ভাষার লোকেদের নিয়েও। উৎসবের মতে, এসব করেই একটি অংশের চক্ষুশূল হয়েছিলেন তিনি, যারা তার আজকের দুরাবস্থার ফায়দা লুটছে। দায় স্বীকারের টুইটে এসব বলে অভিযোগসমূহের ভিত্তিকে হালকা করতে চাইছেন উৎসব, এমনটাই মত টুইটার্যাটি নিন্দুকদের।
এক বিতর্কেই টালমাটাল হয়ে গেছে ভারতের তুমুল জনপ্রিয় কমেডিয়ান কপিল শর্মার জীবন। মদ্যপ হয়ে বিমানে মৌখিক ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিলেন নিজেরই সহকর্মী সুনীল গ্রোভারকে। বর্তমানে পূর্বের রমরমা তো নেই-ই কপিলের, বরং নিভৃতে ভুগছেন নানা শারীরিক জটিলতায়। ফিরে আসবার উদাহরণও আছে। এ বছরের জানুয়ারিতে জাপানের সুইসাইড ফরেস্টের একটি ভ্লগে হাসিমুখে একটি মৃতদেহ দেখিয়ে ও কৌতুক করে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন ইউটিউব সুপারস্টার-কমেডিয়ান লোগান পল। প্রায় কেঁদেকেটেই ভক্তদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন তিনি। ভাবা হয়েছিলো, এমন কীর্তির পর আর দাঁড়াতেই পারবেন না তিনি। কিন্তু তিনি পেরেছেন।
এআইবি ফিরতে পারবে কি না তা সময়ই বলে দেবে। তবে নিকট অতীতে ‘#metoo’ এর কাঠগড়ায় স্থান পাওয়া নামীদামীদের পরিণতি সুখকর নয়। তাই ভয়টা থেকেই যাচ্ছে। এআইবির মূল দুই সদস্যই এখন নেই সংগঠনে। এআইবির বক্তব্যও এ প্রসঙ্গে ভক্তদের উদ্দেশ্যে বাজিয়েছে করুণ বিউগল-
“আমরা সত্যিই জানি না এসবের ভবিষ্যত পরিণতি কী হবে কিংবা আদৌ এআইবি এক থাকবে কি না”।
ফিচার ইমেজ: telegraphindia.com