![](https://assets.roar.media/assets/Z1BFxsPgDDPCdGFP_Irrfan-Khan-marriage-Sutapa-Sikdar.jpg?w=1200)
গোটা পৃথিবীতেই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী অভিনশিল্পীদের একজন ছিলেন তিনি, মাত্র ৫৩ বছর বয়সে বিদায় নিয়েছেন অজস্র মানুষকে বেদনায় নিথর করে দিয়ে। তার বিদায়ের আঘাত আর অপরিসীম শোক বুকে নিয়েই ইরফান খানের জীবনসঙ্গী সুতপা সিকদার লিখেছেন একটি নোট। ইরফান খানের টুইটার হ্যান্ডেল থেকে প্রকাশিত সেই চিঠির তর্জমা করা হলো পাঠকদের জন্য।
‘‘কীভাবে আমি এটাকে একটা পারিবারিক বিবৃতি বলতে পারি, যখন সারা পৃথিবী ইরফানের মৃত্যুটাকে ব্যক্তিগত শোক হিসেবে নিচ্ছে? কীভাবে আমি নিঃসঙ্গ বোধ করা শুরু করতে পারি, যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ এই মুহূর্তে আমাদের সাথে কাঁদছে? আমি সবাইকে এই ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে চাই, এটা হারিয়ে ফেলা নয়, এটা অর্জন। সে আমাদেরকে যা কিছু শিখিয়ে গেছে, সেটাই হলো এই অর্জন; আর এখন আমরা শেষপর্যন্ত এই শিক্ষাগুলো প্রয়োগ করতে পারবো এবং পারবো এগুলোকে বিকশিত করতে। তবুও, মানুষ ইতোমধ্যেই ওর ব্যাপারে যা জেনে যায়নি, আমি শুধু সেই শূন্যতাটুকু পূরণ করতে চাই।
![](https://assets.roar.media/assets/f5Uw1eVrKt6ZooNa_Screenshot_160.png)
যা ঘটেছে তা আমাদের জন্য অবিশ্বাস্য হলেও আমি ইরফানের ভাষাতেই বলতে চাই, “ব্যাপারটা জাদুকরি”, সে এখানে থাকুক বা না থাকুক, আর সে ঠিক এমনটাই ভালোবাসতো; সে কখনোই একমাত্রিক বাস্তবতা পছন্দ করত না। তার বিরুদ্ধে ঝাল ঝাড়ার স্রেফ একটাই কারণ আছে আমার: সে আমাকে সারাজীবনের জন্য অকেজো করে দিয়ে গেছে। পারফেকশনের প্রতি তার যে টান ছিল, সেটা আমাকে আর কোনোকিছুকেই মামুলী রূপে দেখে স্বস্তিবোধ করতে দেয় না। সে সবকিছুতেই একটা ছন্দ দেখতে পেতো, এমনকি বেসুরো শব্দ আর বিশৃঙ্খলাতেও, তাই আমি সেই ছন্দের সঙ্গীতে গাইতে ও নাচতে শিখে গেছি, তা আমার গলাটা যতোই বেসুরো হোক না কেন, আর আমার নাচের দক্ষতাটা যতই ছন্নছাড়া হোক না কেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের জীবনটা ছিল অভিনয়ের একটা মাস্টারক্লাস, তাই যখন ‘অনাহুত অতিথিদের’ আগমনটা ঘটল, ততদিনে আমি সেই বেসুরো শব্দেও একটা ছন্দ খুঁজে পেতে শিখে গেছি। ডাক্তারি রিপোর্টগুলো আমার কাছে ছিল চিত্রনাট্যের মতো, যা আমি নিখুঁত করে তুলতে চাইতাম, কারণ আমি চাইতাম সে যেন তার পারফরম্যান্সের জন্য একদম সূক্ষ্ম বিষয়টুকুও সেখানে খুঁজে পায়।
এই পথচলায় কিছু দুর্দান্ত মানুষের দেখা পেয়েছি আমি, আর তালিকাটা অন্তহীন, কিন্তু এর মধ্যেও এমন কয়েকজন আছেন আমি যাদের নাম নিতে চাই, আমাদের অনকোলজিস্ট ডা. নিতেশ রোহতগি (ম্যাক্স হসপিটাল সাকেত), যিনি সবার আগে আমাদের হাতটা ধরেছিলেন, ডা. ড্যান ক্রেল (যুক্তরাজ্য), ডা. শিদরভি (যুক্তরাজ্য), আমার হৃৎস্পন্দন ও অন্ধকারে আমার লণ্ঠন ড. সেবন্তী লিমায়ে (কোকিলাবেন হাসপাতাল)। এই সফরটা কতটা অসাধারণ, সুন্দর, দুর্বার, যন্ত্রণাদায়ক, আর উত্তেজনাকর ছিল সেটা ব্যাখ্যা করা কঠিন। আমি এই আড়াই বছরকে একটা বিরতি হিসেবে নিয়েছি; যার নিজস্ব সূচনা, প্রবহমানতা আর দৃশ্যকাব্যের চরম সীমায় পৌঁছে যাওয়া আছে; ইরফান ছিল যেখানে অর্কেস্ট্রা নির্দেশকের চরিত্রে; যেই সময়টা ছিল আমাদের বন্ধুত্বের পঁয়ত্রিশ বছরের চেয়ে আলাদা; আমাদেরটা তো বিয়ে ছিল না, ছিল মিলন।
![](https://assets.roar.media/assets/b7QmdQOd5WNOTr74_Screenshot_159.png)
আমি আমার ছোট্টো পরিবারটিকে দেখতে পাই, একটি নৌকায়, যা বাইছে আমার দুই ছেলে বাবিল আর আয়ান, ইরফান দিকনির্দেশনা দিচ্ছে তাদেরকে, ওখান থেকে না, এখান থেকে মোড় নাও, কিন্তু জীবন যেহেতু কোনো সিনেমা নয়, এবং এখানে রিটেকের কোনো কাহিনী নেই, তাই আমি আন্তরিকভাবে চাই, আমার ছেলেরা তাদের বাবার দিকনির্দেশনা মাথায় রেখে নিরাপদে নৌকা বাইবে, এবং ঝড়ের ভেতর দিয়েই তীরে পৌঁছবে। আমি আমার ছেলে দুটোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যদি সম্ভব হয়, তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তাদের বাবার দেয়া এমন একটি শিক্ষা সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে।
বাবিল: অনিশ্চয়তার নৃত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে এবং এই মহাবিশ্বের ওপর তোমার আস্থা রাখতে শেখো।
আয়ান: তোমার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখো, এটা যেন তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।
একটা বিজয়ী হওয়া পথচলা শেষে বিশ্রাম নেবে বলে আপনারা তাকে যেখানে দাফন করেছেন, সেই জায়গায়, তার প্রিয় রাতের রানী হাসনুহানা ফুলের গাছটা যখন রোপণ করবো আমরা, তখন চোখ থেকে ঝরে পড়বে অশ্রুধারা। একটু সময় লাগলেও একসময় তাতে ফুল ফুটবে। সেই ফুলের ঘ্রাণ সেসব আত্মাকে স্পর্শ করবে, যাদেরকে ভক্ত বলবো না আমি, আসছে দিনগুলোতে যাদের জানবো পরিবার বলে।’’