বিল গেটস, স্টিভ জবস, মার্ক জাকারবার্গ সহ বিশ্বের আরো অনেক ধনী পুরুষের ভাগ্যোন্নয়নের গল্প আমাদের সবার কম-বেশি জানা। পৃথিবীতে ধনী পুরুষদের পাশাপাশি ধনী নারীদের সংখ্যা কম না হলেও, তাদের গল্পগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের অজানা রয়ে যায়। এই ধনী নারীদের অনেকেই কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে ধনী হয়ে ওঠেননি, বরং নিজ মেধা এবং বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে নিজস্ব কোম্পানি গড়ে তোলা থেকে শুরু করে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং নিজ ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করেছেন।ওয়েলথ এক্স এবং ফোর্বসের তথ্যানুযায়ী ও বিজনেস ইনসাইডারের রিপোর্টের আলোকে নিজ চেষ্টায় সম্পদশালী হয়ে ওঠা এমন দশজন নারীর গল্পগুলো জানবো আজ।
ঝোয়াউ কোয়ানফেই
মোট সম্পদ- $৭.৪০ বিলিয়ন/৳৫৮,২৭৪ কোটি (ফোর্বস)
দেশ- চীন
বয়স- ৪৬
কোম্পানি- লেন্স টেকনোলজি
চীনের হুনান প্রদেশের ছোট্ট একটি গ্রামে নিদারুণ দরিদ্রতার মাঝে বেড়ে ওঠেন, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারান, পেরোতে পারেননি স্কুলের গণ্ডি- জীবনের এমন কিছু কঠিন বাস্তবতাকে পেছনে ফেলে দিয়ে ঝোয়াউ কোয়ানফেই আজ ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার সূচক ও ফোর্বস সাময়িকীর শ্রেষ্ঠ ধনীর তালিকানুযায়ী বিশ্বের অন্যতম সেরা ধনী নারী।
ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ও পরিশ্রমী ঝোয়াউ মাত্র ১৬ বছর বয়সে অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ফ্যাশন ডিজাইনার হবার ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দিয়ে দৈনিক মাত্র ১ ডলারের বিনিময়ে তিনি কাজ শুরু করেন শেনজাং শহরের একটি ঘড়ির কারখানায়। অদম্য চেষ্টায় নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে ১৯৯৩ সালে মাত্র ৩ হাজার ডলার নিয়ে নিজেই ব্যবসা শুরু করেন। ২০০৩ সালে মটোরোলা তাকে মোবাইলের স্ক্রিনের উন্নত ভার্সন নিয়ে কাজ করার অফার দেয়, সেই থেকে শুরু। এরপর ধীরে ধীরে নোকিয়া, স্যামসাং সহ আরো অনেক নামীদামী কোম্পানির জন্য কাজ করেন তিনি। ২০০৭ সালে আইফোনের স্ক্রিন তৈরির কাজে নিয়োজিত হওয়ার পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
৪৭ বছর বয়সী ঝোয়াও ‘লেন্স টেকনোলজি’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। তার প্রতিষ্ঠানটির সর্ববৃহৎ ক্লায়েন্টদের মধ্যে অ্যাপল ও স্যামসাং অন্যতম। ২০১৫ সালে লেন্স টেকনোলজি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়।
উ ইয়াজুং
মোট সম্পদ- $৭.১ বিলিয়ন/৳৫৫,৯১২ কোটি (ফোর্বস)
দেশ- চীন
বয়স- ৫১
কোম্পানি- লংফর প্রোপার্টিজ
ফ্ল্যাট কেনার সময় বাজে অভিজ্ঞতার স্বীকার হন ইয়াজুং এবং তার স্বামী চাই কুই। এরপর তারা সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেরাই একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি খুলবেন। দুজন মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘লংফর প্রোপার্টিজ’।
ইয়াজুং ১৯৮৪ সালে নেভিগেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন চীনের নর্থওয়েস্টার্ন পলিটেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে। একই বছরে একটি ইন্সট্রুমেন্ট এন্ড মিটার ম্যানুফ্যাকচারার (জাহাজের) কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন তিনি। ১৯৮৮ সালে আত্মপ্রকাশ করেন একজন সাংবাদিক হিসেবে, চীনের ‘শিরং নিউজ এজেন্সি’তে। ছয় বছর কাজ করার পর, ১৯৯৫ সালে তিনি এবং তার সাবেক স্বামী মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘লংফর প্রোপার্টিজ’। ১৯৯৭ সালে তারা তাদের প্রথম রেসিডেন্সিয়াল প্রজেক্ট বিক্রি শুরু করলেন। নিজেদের শহর চোংগিং থেকে বেরিয়ে চীনের সব থেকে বড় বড় শহরগুলোয় (বেইজিং, সাংহাই, চেন্দেগু ইত্যাদি) বিস্তৃত হতে থাকলো তাদের ব্যবসা। ২০০৯ সালে তাদের প্রতিষ্ঠান পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয় হংকং স্টক এক্সচেঞ্জে।
উ ইয়াজুংয়ের সম্পদ দেখাশোনার জন্য ২০১৩ সালে ‘উ ক্যাপিটাল’ নামে একটি ফার্ম খোলা হয়। এরপর উ ইয়াজুং প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ শুরু করেন। বিশ্ববিখ্যাত ক্যাব সার্ভিস ‘উবারের’ একজন ইনভেস্টর তিনি। ২০১২ সালে উ চাই কুইকে ডিভোর্স দেন, যার ফলে চীনের সবচেয়ে ধনী নারীর খেতাব থেকে বঞ্চিত হন তিনি। তারপরও উ বর্তমানে লংফর প্রোপার্টিজের ৪৩% শেয়ারের মালিক এবং চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
উ ইয়াজুংয়ের জন্ম ১৯৬৪ সালে চায়নার চোংগিং শহরে। তিনি ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের একজন সদস্য। ২০১৪ সালে ফোর্বসের তথ্যানুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান নারীর দৌড়ে তার অবস্থান ছিল ৪১তম।
চেন লিহুয়া
মোট সম্পদ- $৬ বিলিয়ন/৳৪৭,২৪৯ কোটি (ফোর্বস)
দেশ- চীন
বয়স- ৭৪
কোম্পানি- ফুয়াহ ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ
চীনের সবচেয়ে বড় কমার্শিয়াল ডেভেলপার কোম্পানি ফুয়াহ ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারপার্সন চেন লিহুয়া।
৩০০ বছর চীন শাসন করা ‘মাঞ্চু কিউং’ রাজবংশের বংশধর তিনি। তার জন্ম হয় ১৯৪১ সালে। জাপানের চীনে আক্রমণের পরপরই তাদের আর্থিক অবস্থা ভেঙে পড়েছিল। স্কুলের গণ্ডিও পেরোতে পারেননি চেন, শুরু হয় দরিদ্রতার সাথে লড়াই। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে আসবারপত্র ঠিক করার দোকান খুলে বসেন তিনি। ১৯৮০ সালের শুরুতে চেন হংকংয়ে গিয়ে একই ব্যবসা শুরু করেন। ৮০’র শেষে বেইজিং চলে এসে শুরু করলেন আবাসন ব্যবসা। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ফুয়াহ ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ, যেটি বর্তমানে চীনের অন্যতম প্রভাবশালী আবাসন প্রতিষ্ঠান। চীন ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডেও তার আবাসন ব্যবসা বিস্তৃত। আবাসন বাদে কৃষি, পর্যটন, ইলেক্ট্রনিক্স সহ আরও নানান ব্যবসায় জড়িত আছে ফুয়াহ কোম্পানি।
১৯৯৯ সালে ২৪ মিলিয়ন ডলার খরচ করে চেন প্রতিষ্ঠা করেন তার স্বপ্নের ‘চায়না রেড সানডালউড জাদুঘর’। বিভিন্ন দুর্লভ কাঠের আসবাবপত্র এবং ভাস্কর্য গবেষণা ও সংগ্রহের জন্য এটি বিশ্বের বৃহত্তম জাদুঘর।
এক ছেলে এবং দুই মেয়ের জননী চেন লিহুয়া। তার সন্তানেরা ফুয়াহ ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের ডিরেক্টর এবং প্রেসিডেন্ট পদে আছেন। বর্তমানে তিনি নিজের নির্মিত জাদুঘরেই ব্যস্ত থাকেন। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায় এই পর্যন্ত ১০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি দান করেছেন চেন।
ডায়ান হেন্ড্রিকস
মোট সম্পদ- $৪.৭ বিলিয়ন/৳৩৭,০১২ কোটি (ফোর্বস)
দেশ- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
বয়স- ৬৯
কোম্পানি- এবিসি সাপ্লাই কোম্পানি
ডায়ান হেন্ড্রিকসের জন্ম ১৯৪৭ সালে। তার বাবা ছিলে দুগ্ধ খামারের ব্যবসায়ী। ১৯৭৫ সালে বিভিন্ন কাস্টম মেইড বাড়ি বিক্রির কাজ শুরু করার সময় তার পরিচয় হয় কেন হেন্ড্রিকসের সাথে। কেন তখন বিভিন্ন বাসা-বাড়ির ছাদ ঢালাই কাজের কন্ট্রাকটর ছিলেন। পরিচয় থেকে বিয়ে। ১৯৮২ সালে তারা দুজন মিলে শুরু করেন এবিসি সাপ্লাই নামের একটি কোম্পানি। বাসা-বাড়ি তৈরির সকল ধরনের কাঁচামাল সরবরাহ করা হতো এই কোম্পানি থেকে। খুব শীঘ্রই পুরো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে তারা কাঁচামাল সরবরাহ করতে থাকলেন।
বর্তমানে তাদের কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন খাতের সর্ববৃহৎ কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। প্রায় ছয়শ’টির মতো জায়গায় তাদের অফিস রয়েছে। বর্তমানে ডায়ান হেন্ড্রিকস হেন্ড্রিকস হোল্ডিং কোম্পানির মালিক এবং এবিসি সাপ্লাইয়ের চেয়ারপার্সন। এছাড়াও তার আরও বড় একটি পরিচয় হচ্ছে, তিনি হলিউডের সিনেমার একজন বিনিয়োগকারী। পাশাপাশি নানান দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করে যাচ্ছেন তিনি নিয়মিত।
ডায়ান সাত সন্তানের জননী, ১৭ জন নাতি-নাতনি রয়েছে তার। বর্তমানে তিনি বাস করছেন উইসকনসিনের আফটন শহরে।
পলিয়ানা চু
মোট সম্পদ- $৪.৬ বিলিয়ন/৳৩৬,২২৪ কোটি (ফোর্বস)
দেশ- হংকং
বয়স- ৫৮
কোম্পানি- কিংস্টন ফিনান্সিয়াল গ্রুপ
পলিয়ানা চু’র জন্ম হংকংয়ে। ১৮ বছর বয়সেই তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। গোল্ডেন গেইট ইউনিভার্সিটি থেকে চু স্নাতক করেন ম্যানেজমেন্টে। পরবর্তীতে তিনি বিজনেস ম্যানেজমেন্টে পিএইচডি করেন ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে। স্নাতক করার সময় তার পরিচয় হয় নিকোলাসের সাথে। পরিচয় থেকে প্রণয়, তারপর বিয়ে। ১৯৯২ সালে চু তার বাবার পরামর্শে স্বামী সহ ফিরে আসেন হংকংয়ে এবং প্রতিষ্ঠা করেন কিংস্টন ফিনান্সিয়াল। তাদের একমাত্র ছেলে কিংস্টনের নামে রাখেন প্রতিষ্ঠানটির নাম। কোম্পানিটি প্রথমে মার্কেটে আইপিও ডিস্ট্রিবিউশন, মার্জারস এবং একুইজিশনের উপর জোর দেয়। এরপর সফলতা কড়া নাড়তে শুরু করে তাদের দ্বারে। ২০১০ সালের মধ্যে এই খাতে সেরা পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় কিন্সটন ফিন্যান্সিয়াল। পরবর্তী বছর এই দম্পতি কিন্সটন ফিন্যান্সিয়ালকে একীভূত করেন পলিয়ানা চু’র বাবার প্রতিষ্ঠিত গোল্ডেন রিসোর্ট এর সাথে। এরপরের সময়টা শুধুই এগিয়ে চলার। ২০১৫ সালে পলিয়ানা ১৬৩ মিলিয়ন ডলার আয় করেন, যেখানে ২০১৪-তে তার আয় ছিল ৯৯ মিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে তাদের একমাত্র ছেলে কিংস্টন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন তারই নামে রাখা কিংস্টন ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপে।
এলিজাবেথ হোমস
মোট সম্পদ- $৪.৫ বিলিয়ন/৳৩৫,৪৩৭ কোটি (ফোর্বস)
দেশ- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
বয়স- ৩২
কোম্পানি- থেরানোস
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী ছিলেন এলিজাবেথ হোমস। রক্ত পরীক্ষা হবে শুধু মাত্র এক ফোঁটা রক্ত দিয়ে এবং যাবতীয় তথ্য মিলবে এই এক ফোঁটা রক্তের মাধ্যমে- এই চিন্তা মাথায় আসা মাত্রই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এর বাস্তবায়ন ঘটানোর। ছেড়ে দিলেন পড়াশোনা। লেখাপড়া করার জন্য জমানো টাকা দিয়ে ২০০৩ সালে খুলে বসলেন নিজের কোম্পানি থেরানোস।পরবর্তী ১০ বছর অনেকটা নিভৃতে কাজ করতে থাকলেন। এর মাঝেই চিপ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এক ফোঁটা রক্তের মাধ্যমে দ্রুত এবং সস্তায় রক্ত পরীক্ষা করার কৌশল উদ্ভাবন করেন হোমস। ২০১৫ সালে ফোর্বসের সেরার তালিকায় স্থান অধিকার করেছিল তার কোম্পানি। নিজ চেষ্টায় এবং সাধনায় তিনি ছিলেন পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ নারী বিলিয়নিয়ার।
‘এন আইডিয়া ক্যান চেঞ্জ ইওর লাইফ’ অর্থাৎ, জীবনের আমূল পরিবর্তনের জন্য একটি মাত্র আইডিয়াই যথেষ্ট- এই বাক্যটির অন্যতম সুন্দর উদাহরণ হতে পারতেন এলিজাবেথ হোমস। কিন্তু শেষমেশ সব ঠিকঠাক হয়নি। ২০১৬ সালে ঘটে যায় এক অঘটন। রক্ত পরীক্ষার পদ্ধতিতে চারদিক থেকে ওঠে ত্রুটির অভিযোগ। অভিযোগের তদন্তে নামে মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, অ্যারিজোনা ও পেনসিলভানিয়ার স্বাস্থ্য বিভাগ, দেশটির সেন্টার ফর মেডিকেয়ার অ্যান্ড মেডিকেয়ার, ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। মামলা হয় থেরানোসের বিরুদ্ধে। কোম্পানির শেয়ারের দাম শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকে। এই ঘটনায় নিজ সম্পদের একটা বড় অংশ হারাতে হয় হোমসকে।
ডরিস ফিশার
মোট সম্পদ- $৩.৬ বিলিয়ন/৳২৮,৩৪৯ কোটি (ফোর্বস)
দেশ- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
বয়স- ৮৪
কোম্পানি- গ্যাপ
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের কথা। ডেনিম জিন্সের জগতে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনার লক্ষ্য নিয়ে ডরিস ফিশার এবং তার প্রয়াত স্বামী ডোনাল্ড ফিশার মিলে ১৯৬৯ সালে সান-ফ্রান্সিসকোতে খুললেন নিজেদের প্রতিষ্ঠিত গ্যাপের প্রথম শো-রুম। তখনও নিজেদের কোনো প্রোডাকশন ছিল না তাদের। শুরুর দিকে বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড ‘লেভিস’ থেকে পণ্য এনে ব্যবসা করলেও খুব দ্রুত নিজেদের প্রোডাকশন লাইন চালু করেন তারা। সেখানে ছিল জিনস, টি-শার্ট, সোয়েটার সহ আরও আইটেম। ১৯৭৬ সালে গ্যাপ পাবলিক কোম্পানিতে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি নিজেদের দখলে নিতে শুরু করল ‘ব্যানানা রিপাবলিক’ এবং ‘ওল্ড নেভির’ মতো অনেক স্টোর। ২০০৯ সালে ডোনাল্ড ফিশার মারা যাওয়ার পরে গ্যাপকে কিছুটা খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সেই সংকটময় মুহূর্তেও কোম্পানির বিক্রয় ছিল ১৫.৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর ৩,৭০০ আউটলেট এবং ১,৫০,০০০ কর্মী নিয়ে গ্যাপ এগিয়ে গেছে অনেক দূর।
চিত্রকর্ম সংগ্রহের প্রতি ঝোঁক থাকার দরুন ডরিস ফিশার বর্তমানে ফ্যাশন জগত থেকে দূরে আছেন। তার সংগ্রহে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন নামিদামী শিল্পীর এগারোশ’র বেশী চিত্রকর্ম, যা সান-ফ্রান্সিসকো মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয় গেলো বছরে। ডরিসের এক ছেলে রবার্ট ফিশার বর্তমানে গ্যাপের বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের একজন।
জিন সুক চ্যাং
মোট সম্পদ- $৩.১ বিলিয়ন/৳২৪,৪১২ কোটি (ফোর্বস)
দেশ- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
বয়স- ৫২
কোম্পানি- ফরএভার টুয়েন্টি ওয়ান
দক্ষিণ কোরীয় বংশদ্ভূত চ্যাং এবং তার স্বামী ডং উং চ্যাং যুক্তরাষ্ট্রে যান ১৯৮১ সালে। সেখানে প্রথম তিনটি বছর বেশ কষ্টে যায় তাদের। এক সাক্ষাৎকারে পোশাক ব্যবসায় কেন আসলেন জানতে চাইলে চ্যাং বলেন,
“যুক্তরাষ্ট্রে এসে প্রথম প্রথম বেশ কিছু পেশায় কাজ করতে হয়েছে। এর মধ্যে একবার এক গ্যাস স্টেশনে কাজ করার সময় দেখলাম, স্টেশনে আসা অধিকাংশ দামী গাড়িগুলো এই পোশাক ব্যবসায়ীদের। সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে এই ব্যবসা শুরু করা।”
১৯৮৪ সালে মাত্র ১১,০০০ ডলার পুঁজি নিয়ে তারা প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ফরএভার ২১’ নামের একটি পোশাকের দোকান। বর্তমানে পোশাক কিংবা এক্সেসরিজের ক্ষেত্রে বিশ্ববিখ্যাত ক্লথিং ব্র্যান্ড ‘ফরেভার ২১’ অনেকের পছন্দের তালিকায় প্রথম সারিতে অবস্থান করে। প্রথম বছরেই তারা ব্যবসা করেন সাত লাখ ডলারের। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ব্যবসার পরিধি। বর্তমানে ‘ফরএভার ২১’ এর বাৎসরিক টার্নওভার চার বিলিয়ন ডলার। আটচল্লিশটি দেশজুড়ে আটশ’রও বেশি স্টোর আছে তাদের। কর্মী সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়, ৪৩ হাজার। চ্যাং বর্তমানে চিফ মার্চেন্ডাইজিং অফিসার হিসেবে আছেন নিজ প্রতিষ্ঠানে। স্বামী উং চ্যাং সিইও এবং তাদের দুই মেয়ে এশার এবং লিন্ডা যথাক্রমে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর এবং হেড অফ মার্কেটিং হিসেবে আছেন এখানে।
গত কয়েক বছর ধরে বেশ কিছু অভিযোগের তীর আসছে ‘ফরএভার ২১’ এর বিরুদ্ধে। এর মধ্যে শ্রম আইন লঙ্ঘন, কপিরাইট আইন ভঙ্গ সহ বেশ কিছু অভিযোগ অন্যতম।
অপরাহ উইনফ্রে
মোট সম্পদ- $৩ বিলিয়ন/৳২৩,৬২৪ কোটি (ফোর্বস)
দেশ- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
বয়স- ৬২
কোম্পানি- হারপো প্রোডাকশন
মাত্র ৯ বছর বয়সে যৌন নির্যাতনের শিকার হন, নিজেকে বাঁচাতে পালিয়ে যান বস্তি থেকে- তবুও তিনি জীবনযুদ্ধে পরাজিত হননি, বরং বিশ্বের কোটি নারীর জন্য অনুপ্রেরণার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন অপরাহ উইনফ্রে। হাই স্কুলে পড়ার সময় অপরাহ যোগ দেন এক রেডিও স্টেশনে। প্রথমে সংবাদ পাঠিকা হিসেবে কাজ শুরু করলেও, পরবর্তীতে তার উপস্থিত বক্তব্যে পারদর্শিতা দেখে দিবাকালীন টক-শো ‘এএম শিকাগো’ উপস্থাপনা করতে দেওয়া হয় তাকে। শিকাগোর এই তৃতীয় সারির টক-শো যখন অপরাহর হাত ধরে প্রথম সারিতে জায়গা করে নেয়, তখনই অপরাহ নিজের প্রডাকশন কোম্পানি খোলেন এবং আন্তর্জাতিক প্রচারে চুক্তিবদ্ধ হন। শিকাগোর সেই ‘এএম শিকাগো’ই পরবর্তী সময় ‘দ্য অপরাহ উইনফ্রে শো’ হিসেবে পরিচিতি পায় এবং তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৯৯৮ সালে তিনি ‘অপরাহ’স এনজেল নেটওয়ার্ক’ নামে একটি দাতব্য সংস্থা গড়ে তোলেন, যা প্রায় ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জোগাড় করেছিল। অপরাহ ব্যক্তিগতভাবে ৩০৩ মিলিয়ন ডলার এই প্রতিষ্ঠানে দান করেন। ২০০৫ সালে ‘বিজনেস উইক’ তাকে আমেরিকার শীর্ষ ৫০ জন সর্বোচ্চ দাতাদের একজন বলে তালিকাভুক্ত করে।
জুলিয়ানা বেনেটন
মোট সম্পদ- $২.৭ বিলিয়ন/৳২১,২৬২ কোটি (ফোর্বস)
দেশ- ইতালি
বয়স- ৭৮
কোম্পানি- বেনেটন গ্রুপ
১৯৪৯ সালে চার ছেলেমেয়ে রেখে যখন জুলিয়ানার বাবা মারা যান, তখন ঘোর বিপদে পড়ে যায় তাদের পুরো পরিবার। বড় ভাই লুসিয়ানোর বয়স তখন চৌদ্দ আর জুলিয়ানার তেরো। জুলিয়ানা তখন থেকে শুরু করলেন নিজ হাতে সোয়েটার বানানো। শুরুর দিকে বড় ভাই লুসিয়ানো সেগুলো বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেন, পরবর্তীতে জুলিয়ানা কাজ শুরু করেন এক ক্লথিং স্টোরে। একবার তার তৈরি হলুদ রঙের একটি সোয়েটার দেখে মুগ্ধ হন লুসিয়ানো। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৬৫ সালে চার ভাই-বোনের উদ্যোগে শুরু হয় বেনেটন গ্রুপের যাত্রা। জুলিয়ানা সেখানে চিফ ডিজাইনার হিসেবে সব দেখাশোনা শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে তারা প্রথমবারের মতো নিজ দেশের বাইরে শোরুম দেয় প্যারিসে এবং ১৯৮০ সালে নিউয়র্কে। বর্তমানে বেনেটন গ্রুপের ১২০টি দেশে ৫,০০০ এর বেশি স্টোর রয়েছে। এছাড়া তাদের বার্ষিক টার্নওভার ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। শুধু পোশাক শিল্পে না, বেনেটন গ্রুপ কৃষি, রিয়েল এস্টেট, পরিবহন খাত, হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট সহ বিভিন্ন খাতে জড়িত। বেনেটনের অধীনে থাকা ‘এডিজিয়ন’ নামক ইনভেস্টমেন্ট ফার্মের আয় বছরে ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ইতালির পরিবহন খাতের দুই-তৃতীয়াংশ এখন বেনেটন পরিবারের অধীনে।
জুলিয়ানা বেনেটনের জন্ম ১৯৩৭ সালে ইতালির ট্রেভিসো শহরে। ৪ সন্তানের জননী তিনি। বর্তমানে সন্তান সহ বাস করছেন নিজ জন্মস্থানেই।