২০১৩ সাল থেকে শুরু করে প্রতিবছর বড়দিনে দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকীর পক্ষ থেকে বিশ্বের কোনো একটি দেশকে এর সফলতার দিক বিবেচনা করে বর্ষসেরা দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তবে দুর্বৃত্ত জাতি হিসেবে খ্যাতি পাওয়া দেশগুলো আগেভাগেই বাদ পড়ে যায় সেই তালিকা থেকে। এছাড়া দেশের বৃহদাকৃতি কিংবা অর্থনৈতিক শক্তির দিক থেকে প্রভাব বিচার না করে তারা এমন কোনো দেশের সন্ধান করে, যারা গত ১২ মাসে উল্লেখযোগ্য হারে বদলে গেছে, পৃথিবীকে করে তুলেছে আরো একটু সুন্দর। সে হিসেবে বাদ পড়ছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র। কেননা এই দুই দেশের সাথে পাল্লা লড়তে গেলে এদের পিছনে ফেলাটা দুষ্কর হয়ে যাবে বৈকি।
তবে সে নির্বাচন যে সবসময় সঠিক হয়, সেটা দাবি করা চলে না। যেমন ২০১৫ সালে তাদের চোখে সেরা রাষ্ট্র ছিল মিয়ানমার। আপাতদৃষ্টিতে তাদের সেই সিদ্ধান্ত আসলে ভুল নাও মনে হতে পারে। কারণ সামরিক শাসনের জাল ছিন্ন করে দেশটি যেভাবে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল, এতে করে তারা কিছুটা হলেও প্রশংসা ও প্রেরণার দাবী রাখে। হ্যাঁ, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের উপর সামরিক বাহিনীর অত্যাচারের ব্যাপারটি তাদের মাথায় ছিল। তবে কে ভেবেছিলো এতো অল্প সময়ে সেটা এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে? মায়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ধর্ষণ এবং হত্যার হাত থেকে বাঁচার জন্যে এ বছর প্রায় ৬ লক্ষ রোহিঙ্গা নিজের গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে।
যে দেশে নিজেদেরই অভ্যন্তরীণ সমস্যা আর জটিলতার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে সেখানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়াটা বিড়ম্বনা সৃষ্টি করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শত বিড়ম্বনা সত্ত্বেও এই বিশাল জনগোষ্ঠী এখন অবস্থান করছে বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরেই। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ত্রাণ আসছে প্রতিনিয়ত। তাদের মধ্যে সেই ত্রাণ বিতরণ ছাড়াও সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়োজিত আছেন দেশের তরুণ সেনা সদস্যরা। আর অনেকটা সে কারণেই, দ্য ইকোনোমিস্টের সেরা দেশের তালিকায় নাম এসেছে বাংলাদেশেরও। তবে তালিকায় থাকলেও বছরের সেরা দেশ হিসেবে স্বীকৃতি জোটেনি এ বছর। সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের অধিকারের প্রশ্নে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে হয়েছে দ্য ইকোনমিস্টের। পাশাপাশি ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বলে মন্তব্য তাদের।
তালিকার আরেক প্রার্থী হচ্ছে আর্জেন্টিনা। লম্বা একটা সময় ধরে কির্চনার পরিবারের শাসন থেকে মুক্তি পাবার পর, দেশকে আর্থিক সঙ্কট থেকে রক্ষা করতে লড়ে চলেছেন দেশটির নতুন রাষ্ট্রপতি মাওরিসিও মাকরি।
তালিকায় রয়েছে আরো দুটি দেশ দক্ষিণ কোরিয়া এবং ফ্রান্স। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া এবার চমৎকার একটি বছর কাটিয়েছে বলতে হবে। ক্ষেপণাস্ত্রপ্রেমী উত্তরের প্রতিবেশীদের হুমকি সামলে নিয়েছে বেশ শান্তভাবেই। অবশ্য উত্তর কোরিয়দের এই হুমকি-ধামকি নতুন কিছু নয়। তারা কয়েক দশক ধরেই দক্ষিণ কোরিয়াকে উড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে। তবে এ বছর ডোনাল্ড ট্রাম্প আর কিম জং উন একজন আরেকজনকে রকেট ম্যান আর ভীমরতিগ্রস্ত বৃদ্ধ বলে বিদ্রূপ করার পর উত্তেজনা বেশ বেড়েছে। এগুলোর পাশাপাশি ঘরোয়া কিছু সংকটের মোকাবেলাও করতে হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়দের। দুর্নীতির দায়ে কারাবন্দী সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং দেশটির প্রভাবশালী কোম্পানির (সামসাং) সহ সভাপতি। তবুও দেশটির অর্থনীতি ও রাজনীতির বেশ উন্নয়ন ঘটেছে এ বছর।
অন্যদিকে, এ বছর নতুন এক বিপ্লব ঘটেছে ফ্রান্সে। বছরের প্রথম দিকেই ঐতিহ্যবাহী কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছাড়াই, দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তরুণ প্রাক্তন ব্যাংকার এমানুয়েল ম্যাক্রন। ফরাসীদের ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে কম বয়সী রাষ্ট্রপতি। তরুণ রাজনীতিবিদে ভরা তার লা রিপাবলিক এন মার্চে দলটি জয় করে নিয়েছে জাতীয় পরিষদের অধিকাংশ আসন। নিজেদের নির্বাচনী প্রচারণার সময় জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলে দেশব্যাপী সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ম্যাক্রন। গত ছয় মাসে তিনি সংবেদনশীল সংস্কার, দুর্নীতিবিরোধী বিল পাশ করা সহ দেশের কঠোর শ্রমিক আইন সংশোধন করেছেন।
তবে সমালোচকরা ম্যাক্রনের মাহাত্ম্যকে ভালো চোখে দেখছে না। অনেকেই সেটাকে শ্রেষ্ঠত্বের অবাস্তব ধারণা বলে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়ছে না। তাদের মতে, তিনি বিষয়গুলো আরো রক্ষণশীল উপায়ে মোকাবেলা করলে আরো ভালো কিছু করতে পারতেন। পারতপক্ষে তাদের বক্তব্যকে ঠিক ভুল বলা যাবে না। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন, ম্যাক্রনের সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ফ্রান্সের অবস্থা দিন দিন অসংশোধনের পর্যায়ে উপনীত হচ্ছিল। ম্যাক্রন দেশটিকে সে বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। সমাজের এই উন্মুক্ত ও বন্ধ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যকার সংগ্রামটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। আর ফ্রান্স সেই সংগ্রাম জয় করতে পেরেছে বলেই এ বছরের সেরা দেশের স্বীকৃতি উঠছে তাদের ঘরেই।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনোমিস্ট; ফিচার ইমেজ: AFP