অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল জীবন্ত মানুষের মাথা প্রতিস্থাপনের কথা। এবার সে পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল মানব সম্প্রদায়। ইতালির নিউরোসার্জন প্রফেসর সার্জিও ক্যানাভারো দু’বছর আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি মানব মস্তক প্রতিস্থাপন করবেন। গত ১৬ নভেম্বর একটি মৃতদেহে মাথা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে নিজের যুগান্তকারী এই দাবিকে সফলতার দিকে অনেকখানি এগিয়ে নেন তিনি।
গত শুক্রবার অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রফেসর ক্যানাভারো জানান যে, তিনি চীনে একটি মৃতদেহে মস্তক প্রতিস্থাপনের কাজ সম্পন্ন করেছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, মেরুদন্ড, স্নায়ুগুচ্ছ ও ধমনীসমূহ সংযুক্তকরণে তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সফল হয়েছে। তুরিন অ্যাডভান্সড নিউরোমড্যুলেশন গ্রুপের ডিরেক্টর প্রফেসর সার্জিও ক্যানাভারো ২০১৫ সালে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি একটি প্যারালাইজড মানুষের মাথা একটি ডোনার মৃতদেহে সংযুক্ত করতে চান। তারই প্রস্তুতি হিসেবে গত ১৬ নভেম্বর, চীনে ১৮ ঘন্টার দীর্ঘ একটি অপারেশনের মাধ্যমে একটি মৃতদেহে মাথা স্থাপনে সফল হন তিনি। অপারেশন শেষে তার ওয়েব পেজে তিনি লিখেন– “YES, WE DID IT! Congratulations to my great friend Prof. Xiaoping Ren, the team of Harbin Medical University and the great People’s Republic of China.”
ক্যানাভারোর মতে, এবার জীবন্ত মানব মস্তক প্রতিস্থাপন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এর আগে, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ক্যানাভারো একটি বানরের দেহে সফলভাবে মাথা প্রতিস্থাপন করেন, যা ২০ ঘন্টা পর্যন্ত বেঁচেছিল। তিনি একটি জীবন্ত ইঁদুরের দেহে অপর একটি ইঁদুরের মাথা লাগিয়ে দুই মাথাওয়ালা ইঁদুর তৈরি করতেও সক্ষম হন। এছাড়া একটি কুকুরের স্পাইনাল কলাম কাটার পর এর ৯০% সংযুক্ত করতে পারারও দাবি করেছিলেন ক্যানাভারো। সাম্প্রতিক সফল অপারেশনের পরে তিনি দ্বিগুণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছেন যে, ধড় থেকে মাথা অবধি মেরুদন্ড, স্নায়ুগুচ্ছ, ধমনী, শিরা এবং ত্বক পুনঃসংযুক্ত করা সম্ভব। ক্যানাভারোর সাফল্যের পরবর্তী ধাপ একজন জীবন্ত মানুষের মাথা প্রতিস্থাপন করা। এর জন্যে একজন ভলান্টিয়ারও তিনি পেয়ে গেছেন। ৩০ বছর বয়সী রাশিয়ান কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট ভ্যালেরি স্পিরিদোনোভ এই জটিল অস্ত্রোপচার নিজের উপর করানোর জন্য সম্মত হয়েছেন। ভ্যালেরি বিরল ওয়ের্ডনিগ-হফম্যান নামক এক রোগে ভুগছেন। এই রোগের কারণে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে মাংসপেশীতে সিগন্যাল প্রেরণকারী মোটর নিউরনগুলো নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে তা মাসল অ্যাট্রফিতে গড়ায় এবং খাদ্য গলাধঃকরণ ও শ্বসনে সমস্যা শুরু হয়। অর্থাৎ বেঁচে থাকার সকল রসদ এক এক করে বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। এমন ভয়াবহ জীবন অতিবাহিত করার চেয়ে ভ্যালেরি তাই জীবন নিয়ে একটি বড়সড় ঝুঁকি নেয়ারই মনস্থ করেছেন।
হ্যাঁ, ঝুঁকি তো অবশ্যই। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন ক্যানাভারোর সফলতার উপর। এমন বক্তব্যও এসেছে যে, সাম্প্রতিক মস্তক প্রতিস্থাপনকে আদৌ সফল বলা যায় কিনা। কারণ, এই প্রতিস্থাপনটি ঘটেছে একটি মৃতদেহে। এর আগে যে বানরটির মাথা প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল, সেটি কখনোই জ্ঞান ফিরে পায়নি এবং এটি মাত্র ২০ ঘন্টা পর্যন্তই বেঁচেছিল। এর স্পাইনাল কর্ডগুলোও সংযুক্ত করার কোনো পদক্ষেপ তখন নেয়া হয়নি। অর্থাৎ, এটি বাঁচলেও প্যারালাইজড হয়ে থাকতো। এছাড়া একটি মাথা থাকা অবস্থাতে ইঁদুরের দেহে আরেকটি মাথা লাগানোকে সাফল্য বলতেও নারাজ অনেকে। তার উপর, সে ইঁদুরটিও ৩৬ ঘন্টার বেশি বাঁচেনি। ডিন ব্রুনেট দ্য গার্ডিয়ানে একটি ফিচারে লিখেছেন,
“হয়তো তার প্রক্রিয়া স্নায়ুগুচ্ছ ও রক্তের ধমনীগুলোর বৃহৎ পরিসরে সংযুক্তকরণ দেখিয়েছে, কিন্তু তাতে কী?… আপনি দু’টো আলাদা আলাদা গাড়ির ভগ্নাংশ ওয়েল্ড করে জোড়া লাগিয়ে একে ‘সাফল্য’ বলতে পারেন, কিন্তু যে মুহূর্তে আপনি চাবি ঘুরাবেন, পুরো জিনিসটার বিস্ফোরণ ঘটবে।”
এ লেখায় তিনি আরও বলেন, “প্রত্যেকের মস্তিষ্ক তার শরীরের সাথে সঙ্গতি রেখেই গড়ে ওঠে। আপনি যদি একজন বিল্ডারের দেহে একজন মিউজিশিয়ানের মাথা লাগিয়ে দেন, এটা অনেকটা প্লে-স্টেশনে এক্সবক্স গেম খেলার মতো ব্যাপার হবে, তার চেয়ে বেশি সীমাহীন ট্রমার কারণও হতে পারে।
আমরা জানি না কী হতে যাচ্ছে। ভ্যালেরির মাথা নতুন দেহ গ্রহণ করবে কিনা, নতুন দেহের সাথে তার স্পাইনাল কর্ড সুসঙ্গগতভাবে জুড়ে যাবে কিনা, যে সুস্থ- স্বাভাবিক জীবনের আশায় ভ্যালেরি স্বেচ্ছায় এই এক্সপেরিমেন্ট এর অংশ হতে যাচ্ছেন, তা সফল হবে কিনা, আমরা জানি না। ভ্যালেরি বলেছেন,
“আমি যখন বুঝলাম যে আমি সত্যিকার অর্থে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কোনোকিছুর অংশ হতে যাচ্ছি, আমার মনে কোনো সন্দেহের অবকাশ রইল না এবং আমি এদিকেই কাজ শুরু করলাম।”
আগামী ডিসেম্বরে হতে যাচ্ছে একজন জীবন্ত মানুষের মস্তক প্রতিস্থাপন। দুনিয়াজোড়া অনেক মেডিক্যাল প্রফেশনাল একে অদ্ভুত ও অসম্ভব আখ্যা দিয়ে এর ঘোর বিরোধিতা করছেন। কিন্তু ভ্যালেরির মতো কিছু মানুষ ভাবছেন, একটা ঝুঁকি নিয়েই দেখা হোক। এই অস্ত্রোপচারে সার্জিও ক্যানাভারোর সাথে থাকবেন চীনের হারবিন মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির নিউরোসার্জন শাওপিং রেন। শাওপিং রেন এর আগে ১,০০০ ইঁদুরের মাথা প্রতিস্থাপনের পরীক্ষা করেছেন। ইঁদুরগুলো শ্বাস নিতে, পান করতে, এমনকি দেখতেও পেতো, যদিও কোনোটিই কয়েক মিনিটের বেশি বাঁচেনি। এই দক্ষ দুই সার্জন এবার জুটি বেঁধে প্রস্তুতি নিচ্ছেন যুগান্তকারী এক ঐতিহাসিক দিনের। ১৪ মিলিয়ন ইউরো ব্যায়ে হতে যাওয়া এই অস্ত্রোপচারটি হবে ৩৬ ঘন্টার সুদীর্ঘ এক প্রক্রিয়া। ১৫০ জনেরও বেশি ডাক্তার ও নার্স এই অংশ নেবেন এই প্রক্রিয়ায়। প্রক্রিয়া সম্পর্কে ক্যানাভারো জানান, দাতা দেহ ও গ্রাহক মাথার স্পাইনাল কর্ড ডায়মন্ড ব্লেড দিয়ে কাটা হবে। তার আগে গ্রাহক মাথার মস্তিষ্ক তীব্র হাইপোথার্মিয়ায় (অতি নিম্ন তাপ) শীতল করে রাখা হবে। স্পাইনাল কর্ড কাটার পরে হবে প্রতিস্থাপন। পরের ধাপটিই সবচেয়ে কঠিন ও সূক্ষ্ম। এ ধাপে অতি সাবধানতায় কর্তিত স্পাইনাল কর্ডগুলো জোড়া লাগানো হবে। এজন্যে ব্যবহৃত হবে পলিইথিলিন গ্লাইকল নামক একটি যৌগ। এ যৌগটি চর্বি জাতীয় কোষপ্রাচীর জোড়া লাগাতে সাহায্য করবে। যদি ঠিকঠাক সবকিছু সম্পন্ন হয়, যদি ভ্যালেরির মাথা নতুন দেহ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, তবে চিকিৎসায় এ হবে এক নতুন বিপ্লব।
ক্যানাভারোর ভাষায় এটি হলো অমরত্বের সম্ভাবনা। তিনি বলেন,
“দীর্ঘকালব্যাপী প্রকৃতি তার নিয়ম-কানুন আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। আমরা জন্ম নিই, বেড়ে উঠি, বৃদ্ধ হই ও মারা যাই। মিলিয়ন বছর ধরে মানুষ বিবর্তিত হয়েছে, আর এ ধারায় প্রায় ১১০ বিলিয়ন মানুষ মারা গেছে। এটি হলো এক বৃহৎ পরিসরের গণহত্যা। আমরা এমন এক যুগে প্রবেশ করেছি, যেখানে আমরা আমাদের নিয়তি আমাদের হাতেই নেবো।”
মস্তক প্রতিস্থাপন সম্ভবপর হলে মানুষ পারবে ইচ্ছেমতো দেহ পরিবর্তন করতে, পারবে জীর্ণ-জ্বরাগ্রস্ত দেহ বদলে নতুন দেহ নিতে।
ক্যানাভারো কি সফল হবেন? ভ্যালেরি কি ফিরে পাবেন স্বাভাবিক জীবন। ৩৬ ঘন্টার সুদীর্ঘ প্রাণঘাতী অস্ত্রোপচারের শেষে তিনি কি দেখবেন নতুন আলো? প্রশ্ন অনেক। আশা আরও বেশি। পেছনে ছড়ানো-ছিটানো টুকরো টুকরো সাফল্য, টুকরো টুকরো ব্যর্থতা। এক যুগান্তকারী বিপ্লব কি আমাদের দোরগোড়ায়? নাকি সাফল্য আরও অনেক দূর? সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে ডিসেম্বরে। ততদিন ভরসা রাখি, বিশ্বাস রাখি চিকিৎসাবিজ্ঞানে, বিশ্বাস রাখি চিরন্তন মানব কল্যাণ কামনায়।