সময়ের প্রয়োজনে আসে নতুন নতুন চিন্তা; দেখা পাওয়া যায় নতুন সৃষ্টির। এই পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় এই সত্যের। তাই নতুন কিছু করার আবেদন মানুষের আদিম ও মজ্জাগত এক আকুতি। পুরনোকে পুঁজি করে যুগের প্রয়োজনে নতুন ধারা এসেই থাকে। সেই ধারাবাহিকতারই ফসল ঢাকার রাস্তায় যানজট থেকে মুক্তির এক নতুন নাম ‘পাঠাও’।
যানবাহনের কোলাহল আর যানজটের অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে যাত্রা শুরু হয়েছে এই নতুন ধরণের সেবা যা অনেকের কাছেই এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কর্মব্যস্ত এই ঢাকা শহরে ‘পাঠাও’ যেন এক নতুন ধরণের প্রশান্তি। শুধুমাত্র যাত্রীসেবাই নয়, ঢাকার মধ্যে বিভিন্ন স্থানে পণ্য ডেলিভারি ব্যবস্থাও রয়েছে।
২০১৫ সালের ১লা অক্টোবর থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘পাঠাও’ এর ডেলিভারি কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে ‘পাঠাও’ মোটরবাইকে করে যাত্রী পরিবহন শুরু করে। ‘পাঠাও’র বর্তমান সিইও ইলিয়াস হোসাইন তার বন্ধু সিফাতকে নিয়ে এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের চিন্তা-ভাবনা করেন। ‘পাঠাও’ প্রথমে কাজ শুরু করে তাৎক্ষণিক ডেলিভারি বা দিনে দিনে ডেলিভারি দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে। শুধুমাত্র তিনজন ডেলিভারি এজেন্ট নিয়ে শুরু করা ‘পাঠাও’ এর কার্যক্রম প্রসার পেয়ে বছর না ঘুরতেই ৬০-এ উন্নীত হয়েছে যা যেকোনো ব্যবসার জন্যই চমকপ্রদ। ডেলিভারি সেবার সাফল্যের সাথে সাথে জনসাধারণের কথা চিন্তা করে যে নতুন ধরণের চিন্তা ‘পাঠাও’ তৈরি করেছে তা সকলেরই নজর কেড়েছে। রেজিস্টার্ড বাইকের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে যা গ্রাহকদের সন্তুষ্টিরই প্রতিফলন হিসেবেই ধরা হচ্ছে।
যারা এতদিন ‘পাঠাও’ সম্পর্কে জানতেন না বা এখনও ‘পাঠাও’ মোটরবাইকে চড়া হয়ে ওঠেনি, তারা নিশ্চয়ই ভাবছেন কী করে আপনিও নিতে পারেন এই সুবিধা! তেমন কিছুই করার দরকার নেই, আপনার ইচ্ছাটাই আসল। সাথে দরকার শুধু একটি এন্ড্রয়েড ফোন আর ইন্টারনেট। প্রথমেই ডাউনলোড করে নিতে হবে ‘পাঠাও’ এর অ্যাপ যা যেকোনো এন্ড্রয়েড মোবাইলের প্লে স্টোর থেকে নিয়ে নিতে পারেন বিনামূল্যে। এরপর রেজিস্ট্রেশন করে নিন প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য ও মোবাইল নাম্বার দিয়ে খুব সহজেই!
এরপর আপনার বর্তমান স্থান থেকে গন্তব্য স্থান বাছাই করুন আর সাথে পেয়ে যাবেন সম্ভাব্য ভাড়া। কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে মোটরসাইকেলের জন্য। মোটরসাইকেলে ওঠার পর থেকেই শুরু হবে ভাড়া গণনা। একটি রাইডের জন্য রাইডের আবেদন করলে ২৫টাকা, প্রতি কিঃমিঃ ১২ টাকা এবং প্রতি মিনিট অপেক্ষা করার জন্য ৫০ পয়সা করে খরচ হবে।
প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত পাওয়া যাবে ‘পাঠাও’ এর সেবা। যদি কোনো রাইডের আবেদন করার পর আপনার সেটা বাতিল করার প্রয়োজন হয়, তাহলে খুব সহজেই ‘বাতিল’ অপশন থেকে আবেদনটি বাতিল করে দেওয়া যাবে। ‘পাঠাও’ কার্যক্রমের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো যানজটে যদি বসেও থাকতে হয়, তবে আলাদাভাবে কোনো অপেক্ষমান খরচ বা ওয়েটিং চার্জ দিতে হবে না। তাই যানজটে বসে মিটারে ভাড়া বেড়ে যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারেন ‘পাঠাও’ এর মোটরসাইকেলে!
এখন প্রশ্ন হলো কীভাবে রাইডের খরচ হিসেব করা হবে? রাইড নির্বাচন করার সময় একটা প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যেতে পারে তা আগেই বলেছি। এছাড়াও বাইকারদের কাছে থাকা অ্যাপে মিটার ইন্সটল করে দেওয়া থাকে। যা থেকে খুব সহজেই কত কিলোমিটার অতিক্রম করা হয়েছে সে সম্পর্কে জানা যায়। তারপর গন্তব্যে পৌঁছানোর পর ‘পাঠাও’ এর নির্দিষ্ট ভাড়া কিলোমিটার হিসেব করে ভাড়া প্রদান করার সুবিধা রয়েছে। তবে একটি মোটরসাইকেলে একজনের বেশি যাত্রী কোনোভাবেই নেয়া সম্ভব নয়। কারও যদি মোবাইল না থাকে বা মোবাইলে ‘পাঠাও’ অ্যাপটি ইন্সটল করা না থাকে, তবে অন্যের একাউন্ট থেকেও রাইডের জন্য আবেদন করা যেতে পারে।
এবার আসা যাক সেই প্রশ্নে যা অনেকের মনেই উঁকি দিচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। প্রশ্নটি হলো এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। কী করে আমরা নির্বিঘ্নে অন্যের মোটরসাইকেলে উঠতে পারি যেখানে নিরাপদে ট্যাক্সি বা সিএনজি তে পর্যন্ত উঠা যায় না! তবে এটি জেনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন যে, শুধুমাত্র একটি মোটরসাইকেল থাকলেই যে কেউ ‘পাঠাও’ এর রাইডার হয়ে যেতে পারবে না। রাইডার নিযুক্তিতে ‘পাঠাও’ বেশ সতর্কতার পরিচয় দিচ্ছে। ‘পাঠাও’ এর রাইডার হতে হলে প্রথমে মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে আবেদন করতে হয়। এরপর কিছু আনুষ্ঠানিক নিয়মের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হয়। যারা সফলতা ও দক্ষতার সাথে উত্তীর্ণ হয় শুধু তাদেরকেই নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে।
এরপর নবনিযুক্ত রাইডারদের জন্য আবার বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে। এসব ব্যবস্থার কারণে প্রত্যেক রাইডার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ‘পাঠাও’ এর ডাটাবেজে সংগৃহীত থাকে। কোনো রাইডার সম্পর্কে যেকোনো অভিযোগ তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করা হয় এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। চালকের পাশাপাশি ‘পাঠাও’ প্রতি সপ্তাহে প্রতিটি বাইকের অবস্থা ও যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করে থাকে এবং মেরামত বা পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে তা খুব দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে করা হয়। প্রতিটি রাইডে হেলমেট ব্যবহার করতে দেওয়া হয় এবং বৃষ্টির সময় রেইনকোটের ব্যবস্থাও রাখা হয়। কোনো কারণে রাইডার যদি না আসে বা আসতে দেরি করে তবে ‘পাঠাও’ এর হটলাইনে অভিযোগ করা যেতে পারে।
বর্তমানে পুরো ঢাকা শহর ‘পাঠাও’ কাভারেজের মধ্যে রয়েছে। খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগে ‘পাঠাও’ এর কার্যক্রম ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। যাত্রীর পাশাপাশি ‘পাঠাও’ ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশে কুরিয়ার সার্ভিসও দিয়ে থাকে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই পণ্য পৌঁছে দেবে আপনার গন্তব্যে; আর এই পাঠানোর খরচ বা চার্জ নির্ভর করে পণ্যের ধরণ ও ওজনের ওপর। বর্তমানে দুই ধরণের পণ্য ডেলিভারি ব্যবস্থা চালু আছে। একটি ‘স্ট্যান্ডার্ড’ এবং অন্যটি ‘ঢাকা উপশহর’। স্ট্যান্ডার্ড ব্যবস্থায় সর্বনিম্ন চার্জ ৬০ টাকা যা ৫০০ গ্রাম ওজনের জন্য প্রযোজ্য; কিন্তু ঢাকার উপশহরগুলোর জন্য এই খরচ ৮০ টাকা।
তবে সব চাইতে দুশ্চিন্তার ব্যাপার হল, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি (বিআরটিএ) এই সেবাগুলোকে এখনও অনুমোদন দেয়নি। বিআরটিএ’র নির্দেশনা অনুযায়ী ভাড়ায় মোটরবাইক চালানো যায় না। এছাড়া ‘ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস গাইডলাইন-২০১০’-এ বলা হয়েছে, ট্যাক্সিক্যাবকে অবশ্যই কোম্পানিভিত্তিক পরিচালনা করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে চালু থাকা সেবার অনেকগুলোই নিজস্ব বাহন নয়, বরং গাড়ির মালিকের সঙ্গে চুক্তি ভিত্তিতে চলছে। এ নীতিমালায় কোম্পানির নিজস্ব রেডিও টেলিফোন লিংক, সেলফোন ও জিপিএসের ব্যবস্থাসংবলিত কন্ট্রোলরুম থাকার কথা বলা হলেও অ্যাপের কথা উল্লেখ নেই। তাই এসব নিয়ে ‘পাঠাও’ এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রয়েছেন।
তবে এ বিষয়ে দৈনিক প্রথম আলোর সাথে এক সাক্ষাৎকারে বিআরটিএর পরিচালক নাজমুল আহসান মজুমদার বেশ আশার বাণীই শুনিয়েছেন। তার মতে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবসায়িকভাবে ব্যবহারের সমস্যার কথা তুলে ধরলেও ঢাকার রাস্তায় নতুন এই ধরণের সেবাকে তিনি নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন না। এখন শুধু এই সকল প্রতিষ্ঠানের সরকারিভাবে অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষা যা খুব শীঘ্রই হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
‘পাঠাও’ কার্যক্রমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানে এটি খুব সাহসিকতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। যাদের মোটরসাইকেল রয়েছে তাদেরকে এই পেশায় আগ্রহী করে তুলতে প্রতিনিয়ত বিজ্ঞাপন করে যাচ্ছে। দেশের বর্তমান সময়ে যাত্রী চাহিদা অনুযায়ী ‘পাঠাও’ আরও বেশি রাইডার নিয়োগ করতে আগ্রহী। তবে নারীদের জন্য এখনও কোনো বিশেষ ব্যবস্থার সেবা চালু করে উঠতে পারেনি ‘পাঠাও’। এখন শুধু দেখার পালা কতদূর পর্যন্ত এই অন্যরকম ধারণা সফলভাবে চলতে পারে।