২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকাতে কমপক্ষে ১৪২ জন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে এমন রোগী মারা যায়। রোগী মারা যাবে কিনা সেটা রোগের তীব্রতা এবং সাথে আরও অনেক প্রভাবকের উপর নির্ভর করে। কিন্তু শুধুমাত্র অবহেলার কারণে এতগুলো রোগী, যারা কিনা মানসিকভাবে সুস্থ নয়, তারা যখন মারা যায় সেটা মেনে নেয়া কঠিন। এমনই জুটেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু হতভাগা মানুষদের কপালে। তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল শুধুমাত্র তাদের প্রতি অবহেলার কারণে। যখন কোনো রোগী পানি পায় না, খাবার পায় না- তখন অবহেলাগুলো কোন পর্যায়ের সেটা মানসিকভাবে সুস্থ মানুষের বুঝে যাওয়ার কথা। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার শাসকশ্রেণীর উপরিমহলের বিশিষ্ট মানুষেরা সেটা বুঝতে পারেনি। আসলে কী হয়েছিলো সেখানে?
লাইফ এসিডেমিনি (Life Esidimeni) নামের একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ছিল, যেটাকে কোনো কারণ ছাড়াই দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার বন্ধ করে দেয়। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১,২০০ মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীর চিকিৎসা চলছিলো। প্রায় রাতারাতি বন্ধ করে দেয়ার কারণে এই মানুষগুলোর এবং তাদের পরিবারের লোকজনদের মধ্যে একটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতি চলে আসে। এই রোগীগুলোকে ধরে বেঁধে ট্রাক এবং পিকআপ ভ্যানে করে অন্য একটি কেয়ার হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়ে যাওয়ার পর এখানে তাদের সেবা-শুশ্রূষা ঠিকভাবে না হওয়ার কারণে একে একে প্রতি দশ জনে একজন করে মারা যেতে শুরু করে। এই কেয়ার হোমটিতে আগেও এক বছরে ৫৮ জন রোগীর মধ্যে ২৩ জন মারা যায় সঠিক সেবার অভাবে এবং যখন অনুসন্ধান চালানো হয় তখন দেখা যায় যে এসব রোগীর দেখাশোনার দায়িত্ব যাকে দেয়া হয় সেই নার্সের অভিজ্ঞতা ছিল কম। নতুন নতুন হাঁটতে শিখেছে এমন বাচ্চাদের দেখাশোনা করার অভিজ্ঞতা এবং সনদপত্র ছিল তার। যে মানসিক হাসপাতালে এই ১,২০০ রোগীকে নেয়া হয়েছিলো সেই হাসপাতালের কোনো লাইসেন্সও ছিল না। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শে তাদের স্থান বদলে দেয়া হয়েছিলো। মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে একজনের মা তার মেয়ের মারা যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে,
“আমার মেয়ের বয়স ছিল ৪৬ বছর। জায়গা পরিবর্তনের তিন দিন পর সে মারা যায়। মারা যাওয়ার সময় তার সাথে কেউ ছিল না। ময়নাতদন্ত করার পর তার পেটে দুটি প্লাস্টিকের টুকরো এবং কাগজের বল পাওয়া যায়। সে ক্ষুধার্ত ছিল এবং একপর্যায়ে হাতের কাছে কিছু না পেয়ে রুমে যা পেয়েছে তাই খাওয়া শুরু করেছিলো। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক মৃত্যু ছিল”।
আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা অত্যন্ত উন্নত একটি দেশ। কিন্তু এমন একটি ঘটনা তাদের মানসিক হাসপাতালের শোচনীয় অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে এবং এসবের প্রতি সরকারি পর্যায় থেকে যে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না সেটাও প্রকাশ পায়। দ্য ইকোনমিস্টে বলা হয়েছে যে, জ্যাকব জুমার সময়ে তাদের দেশের এরকম অরক্ষিত একটি গোষ্ঠীর দিকে তাদের কোনো নজর ছিল না।
কিছু কিছু সংবাদের কল্যাণে আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো যে এমন কিছু একটা ঘটবে। যখন প্রথম এমন কথা শোনা যায় যে রোগীদেরকে অন্য কোনো একটি জায়গায় স্থানান্তর করা হবে তখন থেকেই রোগীদের পরিবারের সদস্য, ডাক্তার, রোগীদের স্বপক্ষের আইনজীবীরা সরকারের কাছে এই বিষয়ে আরজি জারি করেন এবং অনুরোধ করেন যেন সরকার এতে বাঁধা প্রদান করে। অনেকে আদালতে গিয়ে মামলা পর্যন্ত করেছিলো। তখনকার মতো সামাল দেয়ার জন্য পরে গিয়ে সরকার রোগীদের পক্ষে কথা বলে এবং তাদের আশ্বস্ত করে যে রোগীদের স্থানান্তর করা হবে না। কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখা যায় যে সরকার তাদের কথা রাখেনি, বরং তাদের আদেশেই এমনটি করা হচ্ছে। সবচেয়ে অমানবিক ব্যাপার ছিল, যেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেখানকার পরিবেশ এবং রোগীদের জন্য ব্যবস্থা এসিডেমিনির তুলনায় ভাল ছিল না। সরকার কেন যেন খুব তাড়াতাড়ি রোগীদেরকে স্থানান্তর করতে চাচ্ছিল এবং সে জন্য রোগীদের মেডিকেল রেকর্ড রাখা সম্ভব হয়নি। রোগীদের তথ্য ওলটপালট হয়ে যায়, যে কারণে মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে ৯ জনের পরিচয় জানা সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। এরকম পরিস্থিতির কারণ সম্পর্কে কেউই কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। তবে ধারণা করা হচ্ছে যে রোগীদের সেবায় এত অবহেলা করা হয় অর্থের প্রতি লোভের কারণে এবং সরকারি পর্যায়ে অর্থ বাঁচানোর জন্য।
আন্তর্জাতিক মহলে এই বিষয় নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন বের হয়। বিশেষ করে স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো থেকে আরও বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। সেখানকার প্রতিবেদন থেকে সরকারি পর্যায়ের দুর্নীতির কথাই বার বার বলা হয়েছে। এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত মানুষজনের বেআইনিভাবে ছাড়া পাওয়া, সরকারি পর্যায়ে আইনের যথোপযুক্ত প্রয়োগ না ঘটার কারণেই এমন দুর্নীতির সুযোগ পাওয়া যায়। বিশেষ করে স্বাস্থ্য আইন শাখায় এই ধরনের অনিয়ম বেশ প্রকট। কারণ আফ্রিকাতে প্রায়ই অজানা রোগ প্রকট আকারে হওয়া দেখা যায়। তাই সেখানে স্বাস্থ্যখাতে প্রচুর অর্থলগ্নি করা হয়। তাই দুর্নীতি হওয়ার জন্য এটি একটি আদর্শ জায়গা।
লাইফ এসিডেমিনিতে যে ঘটনা ঘটেছে সেটার পেছনে যে সরকারি মহলের উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তা জড়িত তার অনেক প্রমাণ আছে। মজার বিষয় হচ্ছে যখন এদের একেকজনকে ধরা হলো তখন তারা একে অন্যের নাম নেয় এবং নিজেদেরকে নির্দোষ বলে প্রমাণিত করতে চায়। যেমন- সেই প্রদেশের মানসিক স্বাস্থ্য দপ্তরের পরিচালকের নির্দেশেই জলদি জলদি এসিডেমিনি থেকে রোগীদেরকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়, যে জায়গার অবস্থা ছিল রোগীদের জন্য শোচনীয়। যখন তাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয় তখন সে বলেছিল যে এটা নিয়ে পুরোপুরি তাকে দোষারোপ করা উচিত নয়, কারণ সে তার উপর আসা নির্দেশই পালন করছিলো এবং এই নির্দেশ এসেছিলো উপরমহল থেকে। তাছাড়া সে আরও দাবি করে যে রোগীরা যে মারা যাবে সেটা তাদের ধারণা ছিল না এবং তাদেরকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য নিয়ে এই কাজ করা হয়নি।
সেই পরিচালক, যার আদেশে মেনে কাজটি করেছিল, এরপর যখন তাকে ধরা হয় তখন সে বলে যে তারও এখানে কিছু করার ছিল না। কারণ তাকে খোদ দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এমনটি করার আদেশ দিয়েছিল এবং তিনি শুধু আদেশ পালন করেছেন। এরকম বর্বর আচরণের জন্য সরকারি পর্যায়ের কোনো সরকারি কর্মকর্তার চাকরি কিন্তু যায়নি। তবে চাপের মুখে পড়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। কিন্তু অন্যান্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এত প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে ইচ্ছা করলেই তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যেত। কিন্তু জ্যাকব জুমার শাসনামলে যে সেটা সম্ভব নয় তা সেই দেশের সবাই মোটামুটি জানতো।
তবুও যেসব পরিবার তাদের মানসিক ভারসাম্যহীন সদস্যকে হারিয়েছে তারা কীভাবে এই ক্ষতিকে মেনে নিবে? এসব পরিবারের কেউ কারোর শাস্তি চায় না। তারা শুধু জানতে চায় তাদেরকে কেন মিথ্যা বলা হলো। সেই অসুস্থ মানসিক রোগীদের কী দোষ ছিল সেটা তারা জানতে চায়, তারা উত্তর চায় কেন তারা মারা গেলো, কেন তাদের মেরে ফেলা হলো।
কালে কালে অনেক স্বৈরশাসক এই পৃথিবীতে এসেছে যাদের আচরণ অন্য মানুষের প্রতি ছিল পাশবিক। কালে কালে আমাদের এই পৃথিবী আরও আধুনিক হয়েছে, শিল্পে উন্নত হয়েছে এবং মানুষ আরও অনেক বেশী ভদ্র হয়েছে। কিন্তু মাঝে মাঝে ভদ্রতার নমুনা দেখলে নিজেকে মানুষ বলতে খুব অস্বস্তি বোধ হয়। খোদা আমাদেরকে কী জন্য তৈরি করেছেন আর আমরা কয়েক খণ্ড অর্থ এবং কিছু ক্ষমতার লোভে মানবিকতা ভুলে যাচ্ছি। এই পৃথিবীতে যারা মানসিকভাবে অসুস্থ তাদের কি বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই? যারা নির্দ্বিধায় এরকম বর্বর কাজ করে তাদেরকে কি মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ বলা যেতে পারে?
তথ্যসূত্র
[১] The Economist, Article: How 143 mentally ill South Africans were sent to their deaths, Volume 426, Number 9074. Page 41.
ফিচার ইমেজ: Newskoop