Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দূষণ-দুর্যোগ ঠেকাতে রাজধানীর ‘ব্যাক-আপ’ শহর তৈরি করছে ফিলিপিন্স

ফিলিপিন্স। একটু ভেবে দেখুন তো, আন্তর্জতিক গণমাধ্যমে দেশটি সম্পর্কে কোন খবর সবচেয়ে বেশি দেখতে পান? টাইফুন, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, অগ্ন্যুৎপাত? প্রকৃতি যেন দাঁড়িপাল্লায় মেপে দেশটিকে দিয়েছে সমানে সমান সৌন্দর্য আর দুর্যোগ। এবার দেশটি আবারও সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে, তবে সেটি দুর্যোগে ভোগা নিয়ে নয়, দুর্যোগ ঠেকানো নিয়ে।

হ্যাঁ, দুর্যোগ আর দূষণ ঠেকাবার মহাপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে দেশটি এবার নির্মাণ করতে যাচ্ছে ‘অত্যাধুনিক ‘সবুজ শহর‘। দুর্যোগে রাজধানী ম্যানিলার কিছু হলেও গোটা দেশ যাতে স্থবির না হয়ে পড়ে, সেজন্য ‘ব্যাক-আপ সিটি’ হিসেবে একে গড়ে তোলা হবে। মজার ব্যাপার, দুর্যোগ প্রতিরোধী এ শহর গড়ে তুলতে ব্যবহৃত হবে দুর্যোগেরই অবশিষ্টাংশ।

যেমন হবে এই শহরটি © BCDA Group

রাজধানী ম্যানিলা থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এ জায়গাটি ‘নিউ ক্লার্ক সিটি’ নামে পরিচিত। এখানেই নির্মিতব্য নতুন শহরের আয়তন হবে সাড়ে ৯৫ বর্গ কিলোমিটার, যা আমাদের রাজশাহী কিংবা পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া শহরের প্রায় সমান। শহরের দুর্যোগসহনশীল ভবনগুলোতে ঠাঁই হবে প্রায় ১২ লক্ষাধিক লোকের।

‘সবুজ শহর’ বানানো হবে, আর শক্তির পুনর্ব্যবহারে জোর দেওয়া হবে না, তা কী হয়! শহরটিতে তাই সৌরশক্তি, বর্জ্য-বিদ্যুৎ ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাসই ব্যবহৃত হবে দৈনন্দিন জনচাহিদা মেটাতে। আর ভবনগুলোকেও এমনভাবে তৈরি করা হবে, যাতে শক্তির অপচয় সম্পূর্ণভাবে রোখা যায়। সুনিপুণ পরিকল্পনার দ্বারা শহরটির নকশাই সাজানো হচ্ছে এমনভাবে, যাতে গাছ কাটা পড়ে সর্বনিম্ন পরিমাণে আর নদীর প্রবাহ ও পরিচ্ছন্নতাও থাকে অটুট।

হাঁটা ও সাইক্লিং এর জন্যই থাকবে অধিক জায়গা; Image Source: CNBC

সরকারি মালিকানাধীন ভূমি নিয়ন্ত্রণ, রূপান্তর ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিসিসিডি)-এর সভাপতি ভিভেন্সিয়ো ডাইজোন স্পষ্ট করেই বললেন, “আমরা মানুষের জন্য শহর বানাচ্ছি। গাড়ির জন্য নয়! এটাই মূল পার্থক্য।”

দূষণমুক্ত শহর গড়বার প্রথম পদক্ষেপ হলো যানজট কমানো। সে লক্ষ্যে শহরটির একটি বড় অংশকে কেবল পথচারীদের হাঁটার উপযোগী করেই তৈরি করা হবে। শহরের ডানপাশ ঘেঁষে থাকবে নদীসম্বলিত হাঁটারাস্তা। সেই সঙ্গে থাকবে পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা, যা ব্যক্তিগত গাড়ির প্রয়োজনীয়তা কমাবে। উল্লেখ্য, ওয়েজ-এর তথ্যানুসারে ম্যানিলাকে বলা হয় ‘নিকৃষ্টতম ট্রাফিকের শহর’। ঢাকার দুঃসহনীয় যানজটে বসে অনেকেই হয়তো এই লেখাটি পড়ছেন। তথ্যটি শুনে তারাও হয়ত ম্যানিলার দুর্দশা আন্দাজ করতে পারছেন। সেই ম্যানিলাকেই ‘ব্যাক-আপ’ দেবে নিউ ক্লার্ক সিটি!

ম্যানিলার অফিস-আওয়ারের যানজট; Image Source: Malay Mail

পাঠক হয়তো ভাবছেন, এসব পরিকল্পনা দিয়ে তো আর ভূমিকম্প কিংবা ঘূর্ণিঝড় আটকানো যাবে না। দুর্যোগ ঠেকানোর জন্য তবে বিশেষ কী করা হচ্ছে এখানে?

শহরটির স্থায়ীত্ব বাড়াতে নেওয়া হয়েছে খুবই ব্যতিক্রমী একটি পরিকল্পনা। এখানে স্থাপনা তৈরিতে ব্যবহৃত হবে স্থানীয় বিশেষ এক উপকরণ, যার নাম লাহার। মূলত এটিকেই দুর্যোগসহনীয়া ‘ব্যাক-আপ’ শহরটির মূল একক ধরা হচ্ছে।

লাহার হলো ফুটন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে উদগারিত একধরনের শিলাপ্রবাহ। এতে থাকে পাথর, ছাই ও লাভার অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ। এটি আগ্নেয়গিরির আশেপাশের উপত্যকায় স্তরে স্তরে জমা হয়ে কঠিন আকার ধারণ করে। এই লাহার পেতে শহর থেকে খুব বেশি দূরে অবশ্য যেতে হবে না। কেননা মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে মাউন্ট পিনাটুবো আগ্নেয়গিরি।

ভয়ঙ্কর সুন্দর বুঝি একেই বলে, মাউন্ট পিনাটুবো; Image Source: SubSelfie

কংক্রিটের সাথে আনুপাতিক ভিত্তিতে মেশানো হবে এই লাহার। এতে লাভ হবে দুটো।

১. কংক্রিট হবে আরো মজবুত।

২. কংক্রিট তৈরিতে বিপুল পরিমাণ পানি ও শক্তি শোষিত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলেও সালফার ডাই অক্সাইডের মতো অনেক ক্ষতিকর উপাদান অবমুক্ত হয়। কংক্রিটের সাথে লাহার মেশানো হলে বায়ুতে এই ক্ষতিকর উপাদান মেশার হারও হবে অনেক কম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত ক্ষতিকারক উপাদান থাকা অবধি আপনি নিরাপদ। কিন্তু ম্যানিলায় এর পরিমাণ হলো ১৭ মাইক্রোগ্রাম, যা নিরাপদ-সীমা থেকে ৭০% বেশি। সেকারণেই বায়ু দূষণ কমাতে এতটা তৎপর ফিলিপিনো কর্তৃপক্ষ।

সবুজায়নে দেওয়া হবে বিশেষ জোর; Image Source: Business Insider

পাঠক কিছুক্ষণ আগেই জেনেছেন শহরটির ৪০ কিলোমিটার দূরের মাউন্ট পিনাটুবো আগ্নেয়গিরির কথা। নিশ্চয়ই ভাবছেন, এত নিরাপদ যে শহরটিকে ভাবা হচ্ছে, আগ্নেয়গিরির পাশে অবস্থান থাকা সত্ত্বেও তার কি কোনোই বিপদের সম্ভাবনা নেই?

উল্লেখ্য, মাউন্ট পিনাটুবো হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। তবে এটি সুপ্ত হয়েছে বেশিদিন হয়নি। ১৯৯১ সালেই এ থেকে ঘটেছিল বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভয়াবহতম অগ্ন্যুৎপাত। তবে মূল বিষয়টি হচ্ছে, বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী এ আগ্নেয়গিরি থেকে অন্তত আর ১০০ বছরে কোনো অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাবনা নেই।  

১৯৯১ সালের অগ্ন্যুৎপাত; Image Source: Stripes

দুর্যোগ প্রতিরোধের জন্য ভৌগোলিক অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত একটি দেশের রাজধানীকে ভৌগোলিকভাবে তুলনামূলক নিরাপদ জায়গাতেই রাখা হয়, যাতে তা সহজেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা আক্রান্ত না হয়। ম্যানিলাও সে হিসেবে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হলেও সেখানে কিছুটা বন্যার ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু নিউ ক্লার্ক সিটির অবস্থান আরো উঁচুতে হওয়ায় বন্যার ঝুঁকি সেখানে আরো কম থাকবে। সুপরিসর পানি প্রবাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকবে শহরটিতে। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত জলাবদ্ধতা তৈরিরও ভয় নেই। শহরটিকে ঘিরে থাকছে বিস্তীর্ণ পর্বতশ্রেণী। টাইফুনের শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহকে তা আটকাতে সক্ষম হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

‘পাখির চোখে’ যেমন দেখাবে নিউ ক্লার্ক সিটি; Image Source: CNN

ম্যানিলা ভৌগোলিকভাবে ভূমিকম্পের ঝুঁকিপীড়িতও বটে। এর অবস্থান মারাত্মক ত্রুটিযুক্ত ভূ-ভাগে। যেখানকার ভূগর্ভস্থ ফাটল সরে ভয়াবহ ভূমিকম্পের জন্ম দিতে পারে যেকোনো দিন। বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করেছেন, নিউ ক্লার্ক সিটি তেমন কোনো অবস্থানগত ঝুঁকিতে একেবারেই নেই।

ইউজিয়াপু আর জিইয়াংলৌ বে- এ দুইটি মেট্রো এলাকাকে বলা হয় চীনের ‘ম্যানহাটন’। আকারে ও পরিকল্পনায় ম্যানহাটনের মতো সুনিপুণ বলেই বলা হয় এমনটা। কিন্তু এত অসাধারণ শহর দুটি জনগণের মন কাড়তে কোনো এক ভুতূড়ে কারণে ব্যর্থ হয়েছে। নিউ ক্লার্ক সিটিরও মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ম্যানিলার জনচাপকে অনেকটাই নিজের দিকে টেনে আনা। সফল হবে তো শহরটি? নাকি চীনের শহর দুইটির মতো এটিও হবে ‘বাজে খরচ’? উদ্যোগটির বেসরকারি উদ্যোক্তা সুরবানা জুরং-এর প্রধান নির্বাহী হেয়াং ওয়োং-এর বিশ্বাস, নিউ ক্লার্ক সিটি ম্যানিলার ‘যমজ’ হতে যাচ্ছে।

চীনের জনশূন্য জিইয়াংলৌ বে শহর; Image Source: Business Insider

শহরটি নির্মাণের প্রত্যাশিত সময়কাল ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ বছর। ডাইজোনের মতে, শহর নির্মাণের মোট পাঁচটি পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতে মিলিত ব্যয় হতে পারে প্রায় ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য সাউথ এশিয়ান গেমসকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই সেখানে ক্রীড়া কমপ্লেক্স, সরকারি কার্যালয় ও সরকারি চাকুরেদের আবাসন নির্মাণ শুরু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, শহরটির প্রথম পর্যায়ের নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০২২ সাল নাগাদ।

নগরের অত্যাধুনিক ‘স্পোর্টসজোন’ তৈরির কাজ শেষ হবে ২০২২ সাল নাগাদ; Source: CNBC

বোঝাই যাচ্ছে, প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জিং একটি প্রোজেক্ট হতে যাচ্ছে এটি। যেটি বাস্তবায়ন কঠিন হলেও অসম্ভব নয় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি বিসিসিডি-র সভাপতি ডাইজোন একে ‘উচ্চাভিলাষী’ পরিকল্পনা হিসেবেও মানতে চাইলেন না!  দেখা যাক, ফিলিপিন্স সফল হতে পারে কিনা। ওদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আজীবন পীড়িত ও দূষণেভরা বাংলাদেশ এখান থেকে নতুন ভাবনা নিতে পারে কি? 

Featured Image Source: Businessinsider.com

Related Articles